কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অধিকতর গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী ও গবেষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সব ক্ষেত্রে গবেষণাই হচ্ছে একমাত্র পথ। গবেষণার মধ্য দিয়েই সমাজকে আমরা গড়ে তুলতে পারি। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আরও ভাল করে গবেষণা করুন, কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরও বেশি উৎকর্ষ লাভ করতে পারে এবং কোথায় আমাদের আরও বিনিয়োগ করা দরকার। আমাদের দেশের জলবায়ু, মাটি, পানি সবকিছু নিয়েই আপনাদের কাজ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে টেকসই করতে গবেষণা অপরিহার্য। কাজেই সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সবাই কাজ করবেন সেটাই আমি চাই। কারণ বিশ্বের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলব সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ এবং গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ওই সময় গবেষণার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিই কারও মাথায়ই ঢোকেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি প্রথমবার সরকারে এসেই লক্ষ্য করলাম- আমাদের দেশে গবেষণার জন্য কোন বরাদ্দ দেয়া হতো না। গবেষণার জন্য কোন বিশেষ সহযোগিতা ছিল না বা গবেষণাকে কোন গুরুত্বই দেয়া হতো না। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সচরাচর নিয়মিত শিক্ষার ক্ষেত্রে যতটুকু গবেষণা করা- সেটুকুই করত। এর জন্য যে বিশেষভাবে প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন এবং গবেষণার জন্য যে আলাদা একটা বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন, সুযোগটা সৃষ্টি করে দেয়া প্রয়োজনÑ এই কথাটাই তাদের মাথায় কখনও ঢোকেনি।’
তিনি বলেন, ক্ষমতায় এসেই প্রথমেই একটা থোক বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট করে দিলাম। কারণ যখন সরকার গঠন করেছিলাম তখন এশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দাও ছিল। তারপরও আমাদের সেই সীমিত সম্পদ দিয়ে আমাদের রিজার্ভ মানিও কম ছিল, মাথাপিছু আয় কম ছিল। তারপরও আমার মনে আছে, প্রথমে আমি ১২ কোটি টাকা শুধু গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখলাম। পরের বছর যখন বাজেট করলাম তখন ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ আমরা গবেষণা এবং তথ্যপ্রযুক্তির জন্য আলাদাভাবে রেখে দিলাম। তখন থেকে যে আমরা গবেষণা শুরু করলাম, তার ফলে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছিলাম বলেই আজকে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা উৎকর্ষতা লাভ করতে পেরেছি।
গবেষণার জন্য সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগের কথাও তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আজ বাংলাদেশে আপনারা একটু লক্ষ্য করবেন পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই এই ২১ বছর আর ২০০১ থেকে ২০০৮ এই ২৯ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কোন চিহ্ন তারা রাখতে পারেনি বা করেনি। আর করবে না এটাই স্বাভাবিক। যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনি আর যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত আর যারা এখনও অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করে, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসকে যারা লালন-পালন করে তারা দেশের উন্নতি চায় না। স্বাধীনতার আদর্শেই যদি কেউ বিশ্বাস না করে তারা দেশের মানুষের উন্নতি চাইবে কেন?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করেছিলেন। সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সংবিধানের এ দুটি ধারা সংশোধন করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক। পৃথিবীতে এ ঘটনা নজিরবিহীন। যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের লালন করে। তারা কখনও দেশের উন্নতি চায় না।
সরকার প্রধান আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনৈতিকভাবে এখন আমরা স্বাবলম্বিতা অর্জন করছি। আমরা কারও থেকে পিছিয়ে থাকব না সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কারণ ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। তাদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করতে হবে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান থেকে নিয়ে সর্বক্ষেত্রে আমি মনে করি গবেষণাই হচ্ছে একমাত্র পথ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে আরও বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং গবেষক তৈরি হোক সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অন সায়েন্স এ্যান্ড আইসিটি’ প্রকল্প বাস্তবায়িত করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে এবং সব কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক মেধাবী। কাজেই তারা পিছিয়ে থাকতে পারে না এবং থাকবেও না। সেই সুযোগটা আমাদের করে দিতে হবে। তিনি বলেন, এদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৩ সালে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সরকারও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথ ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে একটি প্রযুক্তিনির্ভর, জ্ঞানভিত্তিক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ গড়তে বদ্ধপরিকর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি-২০১১ প্রণয়ন করেছে। যাতে করে আমাদের অর্থনীতি এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আমরা টেকসই করতে পারি, তার উপর আরও ব্যাপকভাবে যাতে গবেষণা হয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাতে যথাযথ ব্যবহার হয় সেইদিকে আমরা দৃষ্টি দিয়েছি। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ইতোপূর্বে গৃহীত জাতীয় আইসিটি নীতিমালা-২০১৪-কে আরও আধুনিক করে ‘জাতীয় আইসিটি নীতিমালা-২০১৮’ প্রণয়নের কাজ করে চলেছে। তিনি বলেন, আমরা ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ ট্রাস্ট’ গঠন করেছি। এই ট্রাস্টের আওতায় প্রতিবছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য ফেলোশিপ দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, অতীতে দেখা গেছে ট্রাস্ট ফান্ড না থাকার কারণে অনেক গবেষণা কর্মকা-ই অর্ধেক চলার পরে পরবর্তী সরকার এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেটা যেন আর না হয়। ২০০১ সালে যখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল তখন সমস্ত স্কলারশিপ বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেকে আধাআধি পড়ার পরই দেশে ফিরে আসলেন আবার অনেকে অনেক কষ্ট করে বিদেশের মাটিতে থেকে তাদের উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করলেন, কিন্তু তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে হলো।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা এ সময় উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণে তার সরকারের পদক্ষেপসমূহের চুম্বক অংশের উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে এমফিল, পিএইচডি ও পিএইচডি-উত্তর পর্যায়ে ছাত্রছাত্রী ও গবেষকগণের মধ্যে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ প্রদান করা হচ্ছে। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭১৩ জন ছাত্রছাত্রী ও গবেষকের মধ্যে ৮৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ফেলোশিপ প্রদান করেছি। বর্তমান ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ফেলোশিপ প্রদান করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে। আমি মনে করি এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের বিজ্ঞানী গবেষক যারা আছেন তাদের বিরাট অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। আপনারা আরও মনোযোগের সঙ্গে নিজ নিজ কাজটি করবেন সেটাই আমার আশা।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে যে স্বীকৃতি আমরা আদায় করেছি সেই পথ ধরেই ২০২০ সালে যেমন আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করব ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠা করব। এদেশে আর তখন হতদরিদ্র বলে কিছু থাকবে না। তিনি বলেন, তার সরকার সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনার উল্লেখ করে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় ‘ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০’ প্রণয়নেও সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের যেন কোন ক্ষতি না হয়, বাংলাদেশের জনগণ যেন উন্নত জীবন পায় এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা এই দীর্ষমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। শতবর্ষ পর আমাদের যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে তাঁদের জীবন-যাত্রার মান কেমন হবে সেটা মাথায় রেখেই আমাদের এই পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমি মনে করি আমাদের বিজ্ঞানী, গবেষক- তাদের একটা বিরাট দায়িত্ব জাতির কাছে আছে। কাজেই সেই দায়িত্বটা আপনারা পালন করবেন। যেন প্রজন্মের পর প্রজন্মই এদেশটাকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর কোন অশুভ শক্তি যেন বাংলার মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই আমরা গড়ে তুলতে সমর্থ হবো।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক এমপি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে কৃতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ এবং গবেষকদের মাঝে গবেষণা অনুদানের চেক বিতরণ করেন।