অগ্নিসন্ত্রাসের এক হাজার মামলা এখনও তদন্তাধীন

49

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াতের ডাকে হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগে নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা প্রায় এক হাজার মামলা প্রায় পাঁচ বছর ধরে তদন্তাধীন। সারাদেশে অগ্নিসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগে পাঁচ বছর আগে দুই সহস্রাধিক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার মামলার তদন্ত শেষে চার্জশীট প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আরও যে সহস্রাধিক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে তা বিগত পাঁচ বছরেও তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া সম্ভব হয়নি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ’১৩ সালে নির্বাচন পূর্ব থেকে ’১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা পেট্রোলবোমা ও নাশকতার ঘটনায় দেশব্যাপী দুই সহ¯্রাধিক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে পেট্রোলবোমা হামলা, অগ্নিসযোগ, নাশকতাসহ সহিংসতার ঘটনায় প্রায় এক হাজার মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে। ১৩ থেকে ’১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা টানা হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোলবোমার সহিংসতা-নাশকতার মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের ঘটনা চলছে অত্যন্ত শম্বুক গতিতে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এসব মামলার হোতারা।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র মতে, ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নাশকতার মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ’১৩ সালের শেষভাগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন হরতাল-অবরোধে নাশকতায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। নির্বাচনপূর্ব অগ্নিসন্ত্রাসে ২৫ দিনে ১৩৩ জন দগ্ধ হয়েছেন, নিহত হয়েছেন ২৬। বিভিন্ন সহিংসতায় ৩৮২ বাস-ট্রাকে আগুন, রেলে নাশকতামূলক চৌদ্দটি ঘটনায় দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত ও তিনটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহত ও পুলিশের ওপর ৮৫টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে।
সূত্রে জানা গেছে, ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের টানা ৯৩ দিনের অবরোধে সারাদেশে ব্যাপক নাশকতা চালানো হয়। সারাদেশে পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন ও পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। তখন নারী-শিশুসহ দেশব্যাপী অন্তত ৯৫ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ৬৪। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন আরও এক হাজার ৪১৩। আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট্রোলবোমায় দগ্ধমুখ নিয়ে বলা চলে বন্দী জীবনযাপন করছেন। মুখের আকৃতি বদলে যাওয়ার নিজের সন্তানও কাছে আসে না। এমন অসহনীয় জীবন তারা চান না। ক্ষমতার জন্য যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে তাদের ধিক্কার জানিয়ে এমন রাজনীতি পরিহার করারও অনুরোধ করেছে তাদের অনেকে। অথচ বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের সময় নাশকতায় দায়ের অধিকাংশ মামলার তদন্ত চলেছে ধীরগতিতে।
’১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে নাশকতার অভিযোগে ১ হাজার ৭৭৫ মামলা দায়ের করা হয়। আসামির তালিকায় রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ মাঠপর্যায়ের কয়েক হাজার কর্মী। এর মধ্যে যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যার অন্তত চারটি ঘটনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর এলাকায় গভীর রাতে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা আইকন পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে আট যাত্রী নিহত হন। চৌদ্দগ্রাম থানার পুলিশের এক এসআই বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দুটি দায়ের করেন। মামলায় ৫৬ জনের ও নামোল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ২০ জনের কথা বলা হয়। একটি মামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে আসামি করা হয় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এসব মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনেকে এখন জামিনে। গাইবান্ধার তুলসীঘাটে নাপু পরিবহন নামে একটি বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় আট যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি মোস্তফা মঞ্জিল গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গ্লোরি পরিবহনে পেট্রোলবোমায় বাসের ভেতরের ২৯ যাত্রী দগ্ধ হন, মারা যান একজন। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় এক এসআই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তরিত হয়। এই মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আরও ৩৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি এলাকায় দায়ের ৪৫৭ নাশকতা মামলার মধ্যে তিন শতাধিক মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র মতে, পাঁচ বছর আগের দায়ের মামলাগুলোর যারা হোতা তাদের এখনও বিচার হয়নি। এমনকি মূল হোতাদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাশকতা ও পেট্রোলবোমার মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার এবং তদন্তে অবহেলার কারণেই তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দাখিল হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তখনকার ঘটনার মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেরিতে হলেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পেট্রোলবোমা হামলা মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দেশ পুলিশ সদর দফতরের। পেট্রোলবোমার সঙ্গে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতাসহ অন্যান্য ঘটনায় দায়ের মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্নসহ আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হরতাল ডেকে পেট্রোলবোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ, বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো ও নাশকতা চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট। এসব ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো দুই বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়া এবং আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর জানায় ’১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ছাড়াও শুধুমাত্র পেট্রোলবোমা হামলা সংক্রান্ত মামলা হয়েছে প্রায় ৫শ’ মতো।
এর মধ্যে চার্জশীট দেয়া হয়েছে মাত্র পঞ্চাশটির মতো। দেশব্যাপী ওই সময়ে সব ধরনের নাশকতার ঘটনায় ১ হাজার ৭১৭ মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে মাত্র ৫২ মামলার তদন্ত শেষে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের দায়ের মামলায় প্রায় ১৬ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুই সহ¯্রাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে এজাহারে। এই সময়ে রেলপথে ৩৫ ও নৌপথে ছয়টি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আর সারাদেশে দুই হাজার ২৮৬ ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ’১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের নাশকতায় বোমা হামলায় মারা গেছেন ৫২। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ২৮১। ককটেল ও অন্যান্য হামলায় আহত হয়েছেন ৫৪৯। অন্যভাবে নিহত ২১। তবে বিভিন্ন সূত্রের খবরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিন মাসে ১৩৮ জন মারা গেছেন, যাদের ৭৭ জনই পেট্রোলবোমায় নিহত, আহত অন্তত ৮৩০। পেট্রোলবোমায় যারা নিহত-আহত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক ও বাসের যাত্রী। মাগুরার মঘিররঢালে বালুবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে সাতজন মারা যান। এ ঘটনায় জামায়াতের এক নেতা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ডাকা পাঁচ বছর আগে হরতালের নামে পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও নাশকতার মামলার মধ্যে যেসব মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় যারা আসামি আছে তাদেরও গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। হরতালের নামে রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে দেশব্যাপী পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও নাশকতার মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন, আসামিদের গ্রেফতার ও বিচার না হওয়ায় এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে।