মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজার জেলায় পরিষদ নির্বাচনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শহর ও গ্রামে ভোটার শূন্য হয়ে পড়ে ভোট কেন্দ্র গুলোতে। জেলার চা বাগান ছাড়া বাকি ভোট কেন্দ্র গুলো ছিল ভোটার শূন্য।
চা শ্রমিক অধ্যুষিত ভোট কেন্দ্র গুলোতে নারী ভোটাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়া শহর এবং গ্রাম এলাকায় দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বেঞ্চে বসে অলস সময় কাটান নিরাপত্তা প্রহরীরা। সবাই অপেক্ষা করেন ভোটারের। কিন্তু মাঝে মধ্যে ২/১জন ভোটার ছাড়া বেশির ভাগ ভোটার ভোট সেন্টারে না আসায় অনেকটাই গল্প গুজবে সময় পার করেছিলেন কেন্দ্রের দায়িত্বরত সংশ্লিষ্টরা।
মৌলভীবাজার পৌর শহরের কাশিনাথ আলাউদ্দিন হাই স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কোন ভোট কাস্ট হয়নি। হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, গোবিন্দশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদ্রাসা, মৌলভীবাজা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বাজার সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহ মোস্তফা কলেজ, বড়কাপন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাহারমর্দন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মোস্তফাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহেন্দ্র কুমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতাপী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এদিকে রাজনগর উপজেলার, জুড়ী ও বড়লেখা এবং কুলাউড়া উপজেলা প্রায় কেন্দ্রেগুলোতে ভোটার শূন্য ছিল।
এদিকে সরজমিনে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, তখন সকাল ১০টা। শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের পুরুষ ভোট কেন্দ্র ছিল একেবারেই ফাঁকা। এই ভোট কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ১৯৮৮। এ সেন্টারে ভোট শুরুর ২ ঘণ্টায় কাস্ট হয়েছে ২০১টি ভোট।
এ কেন্দ্রে নিরাপত্তার কাজে দায়িত্বরত আনসার সুমন বলছিলেন, ‘ভোটার বাড়িতে, মানুষ ভোটে আসতে চায় না, আমরা কী করব? এখানে কোনো ভোটার নেই, পুরো ভোট সেন্টার খালি। মাঝে মধ্যে ১-২ জন ভোটার আসছেন।’
ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আলাউদ্দিন জানান, ‘লাইন ধরার মতো ভোটার আসেনি। সকাল থেকে এ পর্যন্ত ২০১টি ভোট পড়েছে।’
কেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বিকাশ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ভোটার না আসলে আমরা কী করব, হয়তো দুপুরের পর ভোটারের উপস্থিতি কিছুটা বাড়তে পারে।’
সোয়া ২ ঘণ্টায় ৯৫ ভোট! ওই ভোট কেন্দ্রে পাশেই দি বার্ডস রেসিডেন সিয়্যাল স্কুল এন্ড কলেজ সেন্টার। সেখানকার প্রিসাইডিং অফিসার নোমান আহমেদ সিদ্দিকি জানান, এ মহিলা ভোট কেন্দ্রে মোট ভোটার ২১৫৭ জন। এ পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৯৫টি।
ওই কেন্দ্রের ডিউটিরত আনসার আলমগীর বলেন, ভোটার কেনে আয় না, কইতাম (কইতে) পারি না।
১১টা ৪মিনিটে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার উদয়ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মহিলা ভোট কেন্দ্রে ৩ ঘন্টায় ভোট পড়েছে ৯৬টি। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২২৯২ জন। কেন্দ্রে ৬টি বুথে অলস সময় পার করেছেন প্রার্থীর এজেন্টসহ ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার সঞ্জিত কুমার দাস বলেন, ঐ কেন্দ্রটি শুধুমাত্র মহিলাদের হওয়ায় ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে দেরি করছেন। এই কেন্দ্রের একটি বুথের নৌকার পোলিং এজেন্ট জাফর সাদিক বলেন রাত্রে মেঘ হইছে, মহিলারা বাসাত ঘুমার।
আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী অপর চেয়ারম্যান প্রার্থী আনারস প্রতীকের পোলিং এজেন্ট লাভলী ইসয়াসমিন বলেন ভোটার কেনে আইরা না কিছু কওয়া যার না। এই ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার মন্জু মালাকার বলেন, প্রথম দুই ঘন্টায় মানুষ আইছেই না। এখন দুই একজন করিয়া ভোট দিতে আইতাছে।’ তবে সর্বশেষ ওই কেন্দ্রে মোট ভোট কাস্ট হয়েছে ৭.৭ পারসেন্ট। এই ধরণের চিত্র পৌর এলাকার প্রায় সবকটি সেন্টারের।
দুপুর ১ টায় শ্রীমঙ্গল শহরের ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে,সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার অর্চনা বিশ্বাস টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। সাংবাদিক দেখে তার পাশে বসা পোলিং অফিসার তাকে ডাক দেন। এ সময় অর্চনা বিশ্বাস বলেন, কেউ আয়না (ভোটার) আমরা কিতা করতাম। ভোটার আইলে আমরার খুব খুশি লাগে। ওই কেন্দ্রের দায়িত্বরত আনসার সদস্য আবু মিয়া ও সঙ্গে থাকা আরেক আনসার সদস্যকে নিয়ে একটি বেঞ্চে খোঁশ গল্প করছিলেন। তখন সাংবাদিক দেখে চমকে উঠে বললেন স্যার ভোটের কোন চেত-বেত নাই,দেখইন না সেন্টার পুরা খালি,কোন মানুষ নাই। এক বুক নি:শ্বাস ছেড়ে আবু বলছিলেন,স্যার দেশও ভোট মনে হয় উঠি যাইবো আস্তে আস্তে। যে অবস্থা দেখরাম, মানুষ মনে হয় আর কোনদিন ভোটে আইত নাই।
ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার রজত শুভ্র চক্রবর্তী বলেন, সেন্টারও ভোটার কম। আমার মনে হইলো কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার মতো অবস্থা ধরছে। কন্যা আইল, বড় যাত্রীদের নিয়া আর কোন রকম খাওয়াইয়া বিদায় দিলাম। আর এই ভোটেরও এই অবস্থা। একজন প্রার্থীরও দেখা মিলছে না। মোট ভোটার ৩৮৯৩ জন। ভোট কাস্টিং হয়েছে ২৮১ ভোট।
শ্রীমঙ্গল পৌরসভা প্রাথমিক বিদ্যালয় ১১টা ২৪ মিনিট ভোট কাস্টিং হয়েছে ৩২৫ ভোট। সেখানে মোট ভোটার ২১০০ বলে প্রিসাইডিং অফিসার রাহুল ঘোষ জানান।
সকাল ১০ টা ৮ মিনিটে শ্রীমঙ্গল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট ২৩১৮ ভোটার। তারমধ্যে ভোট কাস্টিং হয়েছে ২০০।
বর্ডার গার্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল ১০টা ৩৯ মিনিটে ভোট কাস্টিং হয়েছে ৫০টি,সেখানে মোট ভোটার ৩৩৫০ জন।
ভৈরবগঞ্জ দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২টা ৪০মিনিটে ভোটার শূন্য দেখা যায়। এর আগ পর্যন্ত ভোট পড়ছে ৩৩টি। ওই কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার বাবুল দাস এতথ্য জানালেন।
সাতগাঁও ইউনিয়নের আমরাইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট কেন্দ্রে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ৩৪২৭ ভোটের মধ্যে ১৮০০ ভোট কাস্টিং হয়েছে।
এদিকে, শহর ও গ্রামে ভোটারদের উপস্থিতি না থাকলেও উপজেলার অধিকাংশই চা বাগানে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অনেকটা ভাল।
সকাল পৌনে ১১টার দিকে ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার খায়ের উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তার কেন্দ্রে মোট ৩৪৯৩ ভোট রয়েছে। তার মধ্যে ভোট কাস্টিং হয়েছে ৮০০।
এই চিত্র শুধু ভাড়াউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নয় পুরো উপজেলার চা বাগানের ভোট কেন্দ্রগুলো।
স্থানিয় ইউপি সদস্য মো. ইদ্রিস মিয়া জানান, বাগানের মানুষ ভোট দেওয়ার লাগি ডাট আছে। বাগানের মানুষের কথা আগে ভোট দেও, তারপরে কাজে যাও।
ফুলছড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মোহাম্মদ আলী বলেন, ভোট ২৬২৫ ভোটারের মধ্যে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১৫০০ ভোট কাস্টিং হয়েছে।
ওই এলাকার স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি শান্ত তাঁতি বলেন, ‘ইন্টারেস্ট না এই ভোটে’ মানুষ আসতে চায় না। কাস্ট খুব কম। তিনি আরও বলেন, আমার লাইফে কখনও এই ধরণের ভোট দেখি নাই। আগে বাগানের শ্রমিকরা সবার আগে ভোট দিতে সেন্টারে যাইতো। আগের ভোট এখন বাগানে নাই। এবার অর্ধেক মানুষও ভোটে আইছে না। সবাই বলে ভোটে গিয়ে কি হইবো। ‘যাদের ভোট তাদের লাভ,হামদের লস ছাড়া কোন লাভ নাই’ ।
টিকারিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পুরো সেন্টার ভোটার শূন্য। কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার, নিরাপত্তা রক্ষীরা অলস সময় পার করছেন।
ওই সেন্টারের প্রিসাইডিং অফিসার দেলোয়ার হোসেন জানান, কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩৫৭৮। তারমধ্যে কাস্টিং হয়েছে ৬০০ ভোট।
উত্তরসুর কুলচন্দ্র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোটার শূন্য দেখা যায়। কেন্দ্রের প্রবেশমুখে নিরাপত্তা রক্ষী আনসার সদস্যরা গল্প গুজবে সময় পার করছেন।
ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৭৪২ জন। তার মধ্যে কাস্টিং হয়েছে ৭০০জন হয়েছে বলে জানান, প্রিসাইডিং অফিসার শিমুল মজুমদার।
কূল চন্দ্র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্বরত দুই আনসার সদস্য বলেন, ‘আগে নির্বাচনের পুরা ৮ ঘন্টা পুল ডিউটি করা লাগতো। পাঁচ মিনিট পর পর পুলিশ বাঁশি বাজাইতে হইতো। এখন এসব লাগে না। এখন বসে বসে ডিউটি করছি। ঘুমাওছি, কাজ নাই, কাম নাই। এ রকম নির্বাচন জীবনে দেখছি না। কোন মানুষ নাই, একজন/দুইজন আসছে।’