উপজেলা পর্যায়ে বেতন পাবার ভোগান্তি, দুদকে রিপোর্ট দাখিল

79

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের প্রতিটি উপজেলায় সকল সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা, বিলসহ সকল প্রকার কাজের জন্য নানা প্রকারের দুর্নীতির বা হয়রানির শিকার হতে হয় সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার মোজাম্মেল হক খান একটি অনুসন্ধানী ও পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন দাখিল করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপির কাছে। সোমবার উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়সমূহের ‘দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম কর্তৃক প্রণীত অনুসন্ধানী এবং পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন’ তিনি হস্তান্তর করেন। এ সময় মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘সরকারী সেবা প্রদানের প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা এবং জনহয়রানি বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত টিম এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তিনি বলেন, দুদক ২০১৭ সালে ২৫টি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। প্রতিটি টিমকে সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি, সরকারী অর্থ আত্মসাত-অপচয়ের দিকসমূহ বিশ্লেষণ করে এসব প্রতিষ্ঠানের জনসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সফলতা ও সীমাবদ্ধতা, আইনী জটিলতা, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির কারণসমূহ চিহ্নিত করে তা বন্ধে সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনে প্রস্তাব পেশ করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার আলোকে গত ৩ মার্চ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, ২০১৮ সালে কাস্টমস, ভ্যাট এ্যান্ড এক্সসাইজ ও আয়কর বিভাগ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট টিমসমূহ এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির উৎসসমূহ চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রণয়নপূর্বক কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করে। কমিশন আলোচনা-পর্যালোচনা করে বাস্তবসম্মত কয়েকটি সুপারিশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে। মোজাম্মেল হক খান বলেন, কমিশন বিশ্বাস করে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য, যা অবশ্যই এসব দফতরে সরকারী পরিষেবা প্রদানে ঘুষ, দুর্নীতি, হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস করতে পারে। অন্য প্রাতিষ্ঠানিক টিমের প্রতিবেদন কমিশনের বিচার-বিশ্লেষণ পর্যায়ে রয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক টিমের প্রতিবেদনে ৩৩টি দুর্নীতির সম্ভাব্য উৎস এবং তা নিরসনে ২১টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতির উৎস: সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীর বদলিজনিত কারণে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার পর হিসাবরক্ষণ দফতর কর্তৃক শেষ বেতনপত্র (এলপিসি) নতুন কর্মস্থলে প্রেরণের বেলায় বিলম্ব ঘটে, সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীর কর্ম অবসানে অবসরে গমনকালে সর্বশেষ হিসাবরক্ষণ দফতর কর্তৃক তার প্রত্যাশিত শেষ বেতনপত্র (ইএলপিসি) ইস্যুর ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব ঘটে থাকে, কর্মকর্তাদের সার্ভিস স্টেটমেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদান করা হয় না, কর্মচারীদের সার্ভিস বুক ভেরিফিকেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা হয়ে থাকে, কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সিলেকশন গ্রেড/টাইম স্কেলে বেতন নির্ধারণের বেলায় এবং বেতন নির্ধারণের পর এরিয়ার বিল দাখিল করা হলে অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা আদায় করা হয়ে থাকে, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের পে-ফিক্সেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা প্রদানের দাবি করা হয়। কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের ভবিষ্যত তহবিল (জিপিএফ) হিসাব খোলার সময় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা হয়ে থাকে, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জিপিএফ অগ্রিমের অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা আদায় করা হয়, কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জিপিএফ হিসাব হতে চূড়ান্ত অর্থ পরিশোধের বেলায়ও অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুুবিধার দাবি করা হয়ে থাকে। সরকারী বিভিন্ন অগ্রিম যথা-গৃহনির্মাণ, গাড়ি, মোটরসাইকেল, কম্পিউটার ইত্যাদির বিলের অর্থ প্রাপ্তিতে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা প্রদান করা।
এছাড়া সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকসহ কর্মচারীদের পেনশন সংক্রান্ত আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিয়মিত অর্থ প্রদান করতে হয় ভ্রমণ ভাতার বিল পরিশোধের জন্য একটি নির্দিষ্ট হারে অনিয়মিত অর্থ পরিশোধ করতে হয়। আনুষঙ্গিক ও অন্য খাতের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে অনিয়মিত অর্থ প্রদান করতে হয়। শ্রান্তি-বিনোদন ভাতার বিল উত্তোলনের বেলায় অনিয়মিত অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
বিল দাখিলের ক্ষেত্রে টোকেন প্রদানের সময় হয়রানির শিকার হতে হয়, সরকারী চাকরিতে নবনিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রথম বেতন বিলের টাকা প্রাপ্তিতে অনিয়মিত অর্থ প্রদান করতে হয়, ভুয়া পেনশন সংক্রান্ত বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারী অর্থ আত্মসাত করা হয়ে থাকে, ভুয়া ভ্রমণভাতা বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারী অর্থ আত্মসাত করা হয়ে থাকে। উন্নয়ন প্রকল্প হতে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বেলায় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা হয়ে থাকে।
সরকারী দফতরসমূহ কর্তৃক ক্রয়ের ক্ষেত্রে সংঘটিত অনিয়মসমূহের উপর যথাযথ প্রি-অডিট আপত্তি প্রদান না করে অনিয়মিত অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে বিল পাস করা হয়ে থাকে। সরকারী দফতর কর্তৃক সম্পদ সংগ্রহ বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট বা আইটি বা কাস্টম্স ডিউটি কর্তন না করে সরকারী রাজস্ব আদায়ের প্রতিবন্ধকতা বা বাধা সৃষ্টি এবং রাজস্ব আদায়ের টার্গেটে পৌঁছতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। জুন মাসে যথাযথ প্রি-অডিট না করে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পাস করা হয়। সরকারী ক্রয়ের ক্ষেত্রে মাস ভিত্তিতে সমরূপে ব্যয় না করে অর্থবছরের শেষ প্রান্তে তথা এপ্রিল, মে, জুন মাসে অর্থ ছাড় করা হয় ও বিল সাবমিট করা হয় এবং হিসাব দফতরসমূহ কর্তৃক যথাযথ প্রি-অডিট না করে বিলসমূহ পাস করা হয়। হিসাবরক্ষণ অফিস কর্তৃক বিভিন্ন অফিসের পেরোলে নেই এমন ব্যক্তিদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে সরকারী অর্থের আত্মসাত করা হয়। ব্যাংক কর্তৃক পরিশোধিত মাসিক পেনশনের টাকা হিসাব অফিস কর্তৃক পুনভর্রণের ক্ষেত্রে কখনও কখনও ভুয়া বিল বা ডুপ্লিকেট বিলের মাধ্যমে সরকারী অর্থের ক্ষতি ও আত্মসাত করা হয়ে থাকে। সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিয়মিত বিলের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অডিট আপত্তি উত্থাপন করা হয় না। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশনা অমান্য করে সরকারী সেবা গ্রহীতাদের হয়রানি করা হয়। ইবাস ও বরাদ্দ জটিলতা দেখিয়ে হয়রানি করা হয়। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দ নেই বলে বিলম্ব করা ও ভোগান্তি সৃষ্টি করা, দাখিলকৃত কাগজপত্র সঠিক ও পর্যাপ্ত নয় মর্মে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়। অর্থ প্রদান করলে বিল প্রদান করা হয়। ব্যাংকে কোন কোন ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে এডভাইস প্রদান না করা। ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থ প্রদান করলে এডভাইস পাঠানো হয়। সঠিক বরাদ্দ পাওয়ার পরেও অর্থনৈতিক কোড নিয়ে বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি সৃষ্টি করা হয়। এসব সমস্যা সমাধানকল্পে দুদক ২১ দফা সুপারিশ প্রদান করে।
সুপারিশগুলো হচ্ছে সিজিএ কার্যালয় কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তির ব্যবহার করে সুপারভিশন বা মনিটরিং জোরদার করা। সেবা প্রার্থীদের সেবা পেতে বিলম্ব দূর করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল বৃদ্ধি করা। আইটি সেক্টরকে শক্তিশালী করা ও প্রতিটি অফিসে একজন করে আইটি পারদর্শী নিয়োগ,সমগ্র অফিস অটোমেশনের আওতায় আনা, সব ধরনের বিল ইলেক্ট্রনিক্যালি নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং কতিপয় ক্ষেত্রে (জিপিএফ অগ্রিম গ্রহণ) সেইম ডে সার্ভিস চালু করা, পেপারলেস সাইবার আর্কাইভ তৈরি করা, প্রতিটি অফিসের ওয়েবসাইট তৈরি , অভিযোগ পেজ রাখা ও অভিযোগ সহজে সমাধানের ব্যবস্থা করা, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দাখিল, শুনানি ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। রূপান্তরিত হয়েছে বাজেট সন্নিবেশ, অধিকতর স্বচ্ছতা এবং নির্ভুল ও শুদ্ধ হিসাব প্রণয়নের লক্ষ্যে ট্রেনিং এ্যাকাউন্টিং সিস্টেম চালু ও অডিট এ্যান্ড এ্যাকাউন্টস অফিসার, সুপার, অডিটর এর ডেক্স এ কম্পিউটার সরবরাহ নিশ্চিত করা। দাফতরিক কাজে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে কর্মকর্তা/ কর্মচারীগণকে প্রতি ৩ (তিন) বছর অন্তর বদলির বিষয়টি কঠোরভাবে অনুসরণ করা, পেনশন সংক্রান্ত কার্যক্রমকে স্বচ্ছ, দ্রুত এবং হয়রানিমুক্ত করতে পেনশন কেস ৫ থেকে ৭ দিনে নিষ্পত্তি করা, পেনশনারদের ক্ষেত্রে ইএফটি চালু করা, পেনশন সহজীকরণ বিধিমালা বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করার কথা বলা হয়।
এছাড়া উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের বিল পরিশোধের বেলায় দায়িত্বে অবহেলা ও বিলম্বের জন্য দায়ী কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়, বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস কর্তৃক সরকারী পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংঘটিত অনিয়ম, দায়িত্ব অবহেলা ও দুর্নীতি মনিটরিং- এর জন্য হিসাব মহানিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি ‘হট লাইন’ চালু করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া ‘হট লাইনের’ মাধ্যমে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে যথাযথ ও দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, অডিটর পর্যায়ে তথা সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যায়ে স্থানীয় কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগ না দেয়া, কর্মকর্তাদের সরকারী নিয়ম অনুযায়ী নিয়মিত বদলি নিশ্চিত করা, সকল কাজের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট দফতরকে অনুলিপি অনলাইনে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, সংশ্লিষ্টদের আইটি প্রশিক্ষণ প্রদান করার সুপারিশ করে দুদক।