কাজিরবাজার ডেস্ক :
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে এগিয়ে থাকলেও মানের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক স্তরে ১১ বছর পর্যন্ত যা শেখানো হচ্ছে তা মূলত অন্য দেশের বাচ্চারা সাড়ে ছয় বছরের মধ্যেই শিখছে। ফলে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তর শেষ করলেও তারা সাড়ে চার বছর পিছিয়ে থাকছে। বুধবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮: লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হেলসি রগার্স ও প্রতিষ্ঠানটির এডুকেশন গ্লোবাল প্র্যাকটিস বিভাগের প্র্যাকটিস ম্যানেজার ক্রিস্টিয়ান এডো।
ক্রিস্টিয়ান এডো বলেন, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষা কার্যক্রমের অনুন্নত মানের কারণে ১১ বছরের মধ্যে সাড়ে চার বছরই নষ্ট হয় শিক্ষার্থীদের। ৫ম শ্রেণীতে ১১ বছর পর্যন্ত যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা মূলত সাড়ে ছয় বছরে পাওয়ার কথা। ফলে অন্য দেশের তুলনায় সাড়ে চার বছর পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানসম্মত স্কুলের অভাবে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোন রকম অঙ্কে পাস করতে পারে। বাকি ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই পাঠ্যবইয়ের গণিত বোঝে না। আর তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে। বাকি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা বই পড়তে পারে না।
প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে তারা জানান, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর সুস্থ বিকাশ বিষয়ক কারিকুলামের অভাব রয়েছে। শিক্ষকদের পাঠদানের পদ্ধতিও নিম্নমানের। অদক্ষ স্কুল ব্যবস্থাপনা ও তাতে দারিদ্র্যের ছাপও শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে জানান তারা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনভিজ্ঞ প্রশিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ ও স্কুল ম্যানেজমেন্টই প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমানে প্রধান বাধা। স্কুলে শিক্ষকদের উপস্থিতি সম্পর্কে সরকারকে নজর দিতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশের শ্রম শক্তিকে আরও উন্নত করতে হবে। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দিতে এবং উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে হবে।
সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেসব সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিক্ষার মান মূল্যায়ন করতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি ও শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রবার্ট জে সাম বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারী বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম এবং মালয়েশিয়ার অর্ধেক। বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তা দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন। এটি সামগ্রিক খরচ না হলেও ওই অর্থ কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা ভাবতে হবে। শিক্ষা খাতের বাজেটের পুরো অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব শিক্ষার্থী স্কুলে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ক্লাসে যা শেখানো হচ্ছে তা অন্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকছে। মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জার্মানির শিক্ষাথীদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে রবার্ট জে সাম বলেন, ভিয়েতনামের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী যে পরিমাণে জ্ঞান অর্জন করতে পারছে জার্মানির শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পর্যায়েই তা শিখছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। বিগত আট বছরে বাজেটে শিক্ষা খাতে ৫গুণ অর্থ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা খাতে বাজেটের ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা জিডিপির ২ শতাংশ। তিনি বলেন, গত এক বছরে ২ লাখ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সরকার এখন মানসম্মত শিক্ষার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের জন্য সরকারী বিদ্যালয়গুলো আকর্ষণীয় করে তোলা হচ্ছে। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার উন্নয়নে সরকারসহ সকলের সচেতনতা ও দায়িত্ব রয়েছে। গত ৯ বছর ধরে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বর্তমান সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, দ্য লিগো ফাউন্ডেশনের সহ সভাপতি সারাহ বুচি, বিশ্বব্যাংকের এডুকেশন গ্লোবাল প্র্যাকটিসের সিনিয়র ডিরেক্টর জাইমা সাভিদ্রা।
