অনাবাসী বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের প্রথম কনভেনশন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ॥ শিকড়ের সন্ধান করে উন্নয়ন করুন

56
প্রবাসী প্রকৌশলীদের প্রথম সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্টল পরিদর্শন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের এ মাটিরই সন্তান আখ্যায়িত করে দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডে অবদান রাখার জন্য তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রবাসীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। অনাবাসিক প্রকৌশলীরা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, শিল্পোৎপাদন, যোগাযোগ এবং সমুদ্র সম্পদ আহরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা পলিসি লেভেল চ্যালেঞ্জ এবং ইনস্টিটিউশন লেভেল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের চলমান উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে পারেন।
মঙ্গলবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনাবাসী (এনআরবি) প্রকৌশলীদের প্রথম কনভেনশনের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নটা কেবল শহর কিংবা রাজধানী ভিত্তিকই নয়, তার সরকার পুরো গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন করতে চায়। আজকে আপনারা যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, বাংলাদেশের কোন না কোন গ্রামেই আপনাদের বাড়িঘর, সেখানে আপনাদের শিকড় রয়ে গেছে। শিকড়ের সন্ধান করে আপনাদের যার যার অঞ্চলের কিভাবে উন্নয়ন করতে পারেন, আপনাদের কাছে সে অনুরোধ আমি করব। আপনারা সেদিকটাতেও একটু বিশেষভাবে নজর দেবেন।
প্রবাসী প্রকৌশলীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিদেশে আছেন এটা ঠিক, কিন্তু এই মাটির সন্তান আপনারা। এই দেশ এই মাটি ও মানুষ এটাই আপনাদের মূল জায়গা। এটাই আপনাদের শিকড়। আর এই শিকড়ের সন্ধানেই আপনারা আজকে এসেছেন। এ সময় প্রবাসী প্রকৌশলীদের স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা যে পলিসি লেভেল চ্যালেঞ্জ এবং ইনস্টিটিউশন লেভেল চ্যালেঞ্জ ভালভাবে চিহ্নিত করেছেন সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে এই দেশের যেন আমরা ভালভাবে উন্নয়ন করতে পারি সে বিষয়গুলোও আপনারা দেখবেন। আর আপনাদের এই ফার্স্ট কনভেনশন অব এনআরবি ইঞ্জিনিয়ার্স-২০১৯ এর গ্রহণযোগ্য সুপারিশসমূহ নিয়ে ভাল একটা নীতিমালা আমরা গ্রহণ করতে পারব বলেই আমি মনে করি এবং সেভাবেই এটা তৈরি করবেন।
তাঁর সরকার গত ১০ বছরে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃত। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। তিনি বলেন, জনগণের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮৬-এ উন্নীত হয়েছে, একে আমার দুই অংকে নিয়ে যেতে চাই। আর এই সময়ের মধ্যেই দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি কম থাকলে তার সুফলটা দেশের সাধারণ জনগণ ভোগ করে। যেটা এখন তারা ভোগ করছে। তার সরকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রামকে প্রাধান্য দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে খাদ্য উৎপাদনে যথেষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং তার সরকার এখন উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করছে। খাদ্য মজুদের জন্য সরকার আধুনিক খাদ্য গোডাউন এবং সাইলো তৈরি করছে কারণ আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ বিধায় দুর্যোগ হলেও যেন খাদ্য সমস্যা না হয়। কখনও আর কারো কাছে যেন হাত পাততে না হয়।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে বহির্বিশ্বের কারো কারো মদদে দেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, অন্যের কাছে খাবার আনতে যেয়ে আমাদের দেশে সময় মতো এই খাদ্য না পাঠিয়ে দুর্ভিক্ষ ঘটানোরও চক্রান্তে বাংলাদেশ পড়েছিল। সেটা যাতে না হয় তার জন্যই আমরা আপদকালীন খাদ্য মজুদের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তিনি দেশের বর্তমান উন্নয়নে প্রবাসীদের অংশগ্রহণমূলক সহযোগিতার উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রবাসীদেরও অবদান রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রবাসীদের অর্জিত অর্থ আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখে। কাজেই সেদিক থেকে আমরা সবসময়ই প্রবাসীদের সম্মানের চোখে দেখি।
প্রধানমন্ত্রী মেধা পাচার প্রসঙ্গে বলেন, একটা কথা সবসময় বলা হয় যে, ব্রেইন ড্রেইন। আমি সেটা মনে করি না। বরং আমাদের দেশে তো লোকের অভাব নেই, যুব সমাজের অভাব নেই। আমরা যদি তাদের সুশিক্ষিত করতে পারি তাহলে তারা দেশে থেকেই দেশের উন্নয়ন করতে পারে। তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশটাকে যদি দেখেন তাহলে অবশ্যই সেটা সম্ভব বলে আপনারাও মেনে নেবেন। তিনি এ সময় বলেন, বিদেশে যারা লেখাপড়া করতে গিয়ে থেকে যান বা বিভিন্ন ব্যবসায়িক কারণে বা কর্মসূত্রে বিদেশে গিয়ে যারা প্রবাসী হয়ে যান তারা যে অভিজ্ঞতাটা সঞ্চয় করেন তার মূল্যও কম নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি বিশ্বকে না দেখি, কোথাও না যাই তাহলে আমরা জানব কি করে যে বিশ্বের অন্যত্র কি হচ্ছে, সেখানেও একটি জ্ঞান অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশে শিল্পায়নের জন্য বিনিয়োগ একান্তভাবে দরকার উল্লেখ করে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করায় সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের চুক্তি থাকার ফলে ডাবল ট্যাক্সেশন আমরা এ্যাভয়েড (এড়িয়ে যেতে) করতে পারি। বিনিয়োগকারিরা চাইলেই তাদের মুনাফা এবং আসলসহ তারা চলে যেতে পারবেন। মেশিনারি আমদানিতে ট্যাক্স হলিডে পাবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সারাদেশে যে একশ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে সেখানে সরকার প্রদত্ত সুযোগ গ্রহণ করে বিনিয়োগে বিদেশীদের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশীরাও এগিয়ে আসবেন এটা আমি আশা করি। প্রবাসীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে তিনটা এনআরবি ব্যাংক আমরা করে দিয়েছি। রফতানির ক্ষেত্রে রফতানি বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছি এটা ঠিক। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, একটা জিনিসের রফতানির ওপর নির্ভর করে কোন একটা দেশ চলতে পারে না। আমাদের রফতানিকে বহুমুখীকরণ করতে হবে।
আইসিটি খাতকে দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী হাইটেক পার্ক এবং বিভিন্ন ডিজিটাল পার্ক তৈরিতে তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, সারাদেশে প্রথম পর্যায়ে আমরা ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার করে দিয়েছি। আমরা দেখেছি এখানে গ্রামের মায়েরাও প্রবাসী আপনজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য, তাদের দেখার জন্য আঁচলে কয়েকটি টাকা বেঁধে বসে থাকছে। বাংলাদেশের জনগণ যতটা শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিতই হোক না কেন তারা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া বা দ্রুত শিখতে পারে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের মা ॥ বক্তব্যের এক পর্যায়ে তার কম্পিউটার শিক্ষার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হলেও এখন আমি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের মা। এ দেশে কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়াতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আমাকে সহযোগিতা করেছে। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ অফিসে একটি কম্পিউটার কিনেছিলাম, তখন ওই কম্পিউটারে খরচ পড়েছিল ৩ লাখ টাকা। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ১০ হাজার কম্পিউটার ক্রয়ের বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। তারা অর্ধেক খরচে আমাদের কম্পিউটার দিতে চাইলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলো।