কাজিরবাজার ডেস্ক :
আবারও ফিরে এসেছে শোকাবহ সেই ২৫ ফেব্রুয়ারি, দেশের ইতিহাসের কলঙ্কময় এক অধ্যায়। বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের দশ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০০৯ সালে তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া খুনের মামলার বিচার গত ২০১৮ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টে শেষ হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের দুই মামলায় এখন আপিল চলছে। ঘটনাটি পরিকল্পিত ছিল, উলেস্নখ করে এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, সরকার ও সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছিল।
রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বিচারিক আদালতের পর হাইকোর্টে মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়ায় এখন বিচারের সর্বোচ্চ ধাপ আপিল বিভাগেই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। তাই সবার সজাগ দৃষ্টি রয়েছে সেদিকেই। এ মামলায় হাইকোর্ট ১৩৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে। যাবজ্জীবন বহাল আছে ১৮৫ জনের এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রয়েছে ২০০ জনের।
বিচার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া আসামিদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হয়েছে। আপিল বিভাগের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তারা।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানার দরবার হলে ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ‘অপারেশন ডাল ভাত’ কর্মসূচির টাকা হেরফেরের অভিযোগ তুলে পিলখানায় দরবার চলাকালে হঠাৎ করেই বিদ্রোহ শুরু করে তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা। বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও সিনিয়র কর্মকর্তাসহ ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার শিকার হন ১৭ জন বেসামরিক ব্যক্তিও। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপে আত্মসমর্পণ করে বিদ্রোহীরা। পিলখানার ভেতর থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মৃতদেহ। বেরিয়ে আসে বিডিআর জওয়ানদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
এই ঘটনায় হত্যা এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় হলেও আপিল আদালতে মামলা এখনো ঝুলে আছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার আলী শিকদার বলেন, সরকার ও সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করাই ছিল বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে। ওই ঘটনা সুপরিকল্পিত বলে উলেস্নখ করেছেন এ ঘটনার বিশ্লেষক আব্দুর রশিদ। ওই সময়ে কেন পাল্টা হামলার নির্দেশ দেয়া হলো না এমন সমালোচনারও ব্যাখ্যা দেন বিশ্লেষকরা।
বিডিআর বিদ্রোহ আর একাত্তর কিংবা পঁচাত্তরের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেও মনে করেন অনেকে।
এদিকে পিলখানা ট্র্যাজেডির দশ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবারগুলোতে এখনো কান্না থামেনি। আপনজন হারানোর যন্ত্রণা প্রতিটা মুহূর্তে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাদের। সেই দিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরা আজও ভুলতে পারেনি। তাদের একটাই প্রশ্ন, কী অপরাধ ছিল সেনা কর্মকর্তাদের?
সরকার বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাটিকে ‘পিলখানা হত্যা দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে এবারও বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় পিলখানাসহ বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন; বিজিবির সব মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।
এক নজরে বিচারিক আদালতের রায়- দন্ড: ১৫২ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদন্ড ১৬১ জনের। ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা ২৫৬ জনের। খালাস ২৭৮ জন। সর্বমোট সাজা ৫৬৮ জনের।
নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দন্ডিত ব্যক্তিরাও জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জনকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০তম দিনে, ১৩ এপ্রিল। সেদিন শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। হাইকোর্ট ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দিনে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
একনজরে হাইকোর্টের রায়: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ দন্ড: ফাঁসি বহাল ১৩৯ জনের, যাবজ্জীবন ১৮৫ জনের, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস ৪৫ জন।