কাজিরবাজার ডেস্ক :
তিন ফসলি জমি রক্ষা করে সমন্বয়ের মাধ্যমে শিল্পায়ন করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে জমি ব্যবহারে সর্বোচ্চ সাশ্রয়ী হওয়ার কথা উল্লেখ করে দেশের জমি ব্যবহারে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের সব জমির যেন সঠিক ব্যবহার হয়। এ জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এই নির্দেশনা দেন। সভায় মোট ৯টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। যেখানে রয়েছে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার মহাপরিকল্পনাও। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ২৪ লাখ পরিবার আসবে নতুন করে বিদ্যুতের আওতায়।
একনেক চেয়ারপার্সন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভার সভাপতিত্ব করেন। একনেক সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানান। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর জন্য ব্যয় হবে প্রায় ১৬ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার অর্থায়ন করবে ১৩ হাজার ৬২০ কোটি, প্রকল্প ঋণ প্রায় ২ হাজার ৫২৭ কোটি এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা।
পরিকল্পনামন্ত্রী ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মিটারগেজ থেকে সব রেললাইন পর্যায়ক্রমে ব্র্রডগেজ করার জন্য। সারাদেশের জমির জন্য একটি ডিটেইল প্ল্যান করার কথা বলেছেন। যেন জমির সঠিক ব্যবহার করা যায়। তিন ফসলি জমিতে যেন কোনভাবেই শিল্প প্রতিষ্ঠান করা না হয়, চর যেন রক্ষা পায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্থাপনা নির্মাণে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি শিল্প কারখানায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ইটিপি) রাখার ওপর আবারও জোড় নির্দেশনা দিয়েছেন বলেও মন্ত্রী জানান।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় যে নয়টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এর মধ্যে নতুন প্রকল্প পাঁচটি আর সংশোধিত প্রকল্প চারটি। এদিকে, অনুমোদন হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণ, রাজশাহী বিদ্যুত বিতরণ সম্প্রসারণ ও রংপুর বিদ্যুত বিতরণ সম্প্রসারণ। একটি সংশোধিত এবং দুটি নতুন প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রায় ২৪ লাখ পরিবার নতুন করে বিদ্যুত সংযোগ পাবে। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে সাড়ে ১৯ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হবে। ২০২০ সালের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রথম ধাপে একটি প্রকল্পে পল্লী বিদ্যুত সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। তবে ২০১৮ সালের নবেম্বর পর্যন্ত ১১ লাখ ১৪ হাজার গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুত দেয়া হয়েছে। একই প্রকল্পের সময়-ব্যয় বৃদ্ধি করে আরও সাড়ে ৪ লাখ গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুত দেয়া হবে। ফলে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথমে প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এখন অতিরিক্ত সাড়ে ৪ লাখ গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুত দিতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রসার, ক্ষুদ্র পরিসরে শিল্পায়ন, নতুন কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ জনগণের উন্নয়নের চলমান প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ। একই সঙ্গে ‘রংপুর বিভাগ বিদ্যুত বিতরণ লাইন ও উপকেন্দ্র সম্প্রসারণ এবং পুনর্বাসন’ প্রকল্পে ব্যয় হবে ১১২৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই (নেসকো) মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পে সরকারী অর্থায়ন হবে ১০৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা আর বাকি ৩৫ কোটি ২৫ লাখ সংস্থার অর্থায়নে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রংপুর উপকেন্দ্রের বিদ্যুত সঞ্চালন সক্ষমতা ২২০ মেগাওয়াট বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে রংপুরের আটটি জেলায় ১ লাখ ৮০ হাজার গ্রাহক নতুন করে বিদ্যুত সংযোগ পাবে।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই (নেসকো) মাধ্যমে ‘রাজশাহী বিভাগ বিদ্যুত বিতরণ লাইন ও উপকেন্দ্র সম্প্রসারণ এবং পুনর্বাসন’ আরও একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এখানে সরকারী অর্থায়ন হবে ১০৫৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা আর সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন হবে ৩৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে রাজশাহী উপকেন্দ্রের ৪৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সঞ্চালন সক্ষমতা বাড়বে। রাজশাহী বিভাগের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাটের আট জেলায় ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পাবে নতুন করে বিদ্যুতের সংযোগ। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প দুটিই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। বিদ্যুতের প্রকল্পগুলোর কথা উল্লেখ করে এম এ মান্নান বলেন, বিদ্যুতের যে বিশাল সম্প্রসারণ হয়েছে, এর রাজনৈতিক লাভ আমরা পাচ্ছি। নির্বাচনের সময় আমরা বিদ্যুতের বিষয়টি জনগণের সামনে বেশি উপস্থাপন করেছি। এজন্য গ্রামের মহিলারা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের ভোট দিয়েছেন। আমার এলাকা হাওড় অঞ্চলে, সেখানে কীভাবে যে বিশাল বিশাল খুঁটি পুঁতেছে, এজন্য আমি গর্বিত। মন্ত্রী বলেন, শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে সাড়ে ১৯ লাখ নতুন সংযোগ আমরা দিতে পারব। এক সংযোগে পাঁচজন করে মানুষ ধরলেও গড়ে প্রায় এক কোটি মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা পাবেন বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
এছাড়াও সভায়, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ‘৭০টি মিটার গেজ (এমজি) ডিজেল ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ সংগ্রহ (প্রথম সংশোধিত) (প্রস্তাবিত)’ প্রকল্পে ২ হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারী অর্থায়ন করবে ৬১৪ কোটি ৯৯ লাখ এবং প্রকল্প সাহায্য ২ হাজার ৪৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। মঙ্গলবারের একনেক সভায় এর মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, রেলের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যারা কাজ করেন তারা পার্টসগুলো যাতে মেরামত করতে পারেন, বানাতেও পারেন। আমাদের কিছু কিছু স্থাপনা ছিল, উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর ও চট্টগ্রামের পাহাড়পুরে, এটা আমরা জানি। ব্রিটিশ আমলে স্থাপন করা হয়েছিল। এগুলো বছরের পর বছর প্রশংসার সঙ্গে কাজ করেছে। এগুলোকে আরও আধুনিকায়ন করা, যাতে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আমাদের রেলের এসব পার্টস ও অন্যান্য জিনিস আর কিনব না, নিজেরাই ওয়ার্কশপে তৈরি করব।’ সেজন্য প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন বলে জানান মন্ত্রী। এছাড়াও সমন্বিত পরিবহন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রেল, নৌ ও সড়ক পথে সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়তে হবে। উন্নত দেশে এমন ব্যবস্থা চালু আছে। এক টিকেটে সব পরিবহনে যাতায়াত করা যায়। ব্যয় সাশ্রয়ী করার জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। এম এ মান্নান বলেন, ‘উদাহরণ দিয়ে বলি, এমন সময় আসবে চট্টগ্রামের টিকেট কিনবেন, সেই টিকেটে ট্রেনে ঢাকায় এসে একই টিকেটে স্ট্রিমারে করে বরিশালে যেতে পারবেন। এটা সম্ভব। বিদেশীরাও তাই করে। এ রুটগুলো সমন্বয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ কথা কেন বললাম, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক টিকেটে বাস, ট্রেন ও স্ট্রিমার-তিনটাতে ঘোরাফেরা করা যায়। আমাদের এখানে করা সম্ভব। অসম্ভব কিছু নয়। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের গতি বাড়িয়ে বিটিসিএলকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়াও সভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানকল্পে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড স্থাপন (সংশোধিত)’ প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৩২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘আরিচা (বরঙ্গাইল)-ঘিওর-দৌলতপুর-টাঙ্গাইল সড়কের ষষ্ঠ কিলোমিটারে ১০৩.৪৩ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘কক্সবাজারে লিংক রোড-লাবনী মোড় সড়ক (এম-১১০) চারলেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২৮৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। পুরোটাই সরকারী অর্থায়নে এই প্রকল্প ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ‘ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১৫৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, বিদ্যুত বিভাগের সৈয়দপুর ১৫০ মেগাওয়াট ১০ শতাংশ সিম্পল সাইকেল (এইচএসডি ভিত্তিক) বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পে ১ হাজার কোটি ৯৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ কোটি ৪৭ লাখ, সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ২১৫ কোটি ৪৭ লাখ এবং ৪৮৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। এটি ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।