হাকালুকি ও বাইক্কা বিলে দিন দিন পর্যটকের উপস্থিতি বাড়ছে

96
প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি বাইক্কা বিলে পাখিদের অবাধ বিচরণ।

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারের বাইক্কাবিল ও হাকালুকি হাওর জুড়ে অস্থায়ী হাঁস, গরু মহিষের বাতান। বিলের মাছ খেতে জট বেঁধেছে দেশী ও বিদেশী অতিথি পাখি। আর সেই পাখি দেখার জন্য দেশি ও বিদেশী পর্যটকের উপস্থিতিও বাড়ছে।
বর্ষার সেই চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। শুষ্ক মৌসুম তাই বদলে গেছে হাওরের দৃশ্যপট। হাওরের মধ্যখানে ও পাদদেশে থাকা বিশাল সবুজ অরণ্যে আপন নিবাস এ সকল পাখিদের। সবুজ ঘাস, গরু, মহিষ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও মাছের এমন মনমুগ্ধকর দৃশ্য মনে আনন্দ জাগে। যদিও জাতীয় নির্বাচনের পর এখন পর্যটকের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। হাইল হাওর ও বাইক্কা বিলের দুটি স্থানেই প্রকৃতির হাতছানি। জলজ আর উভয়চর প্রাণীর আবাসস্থলের জন্য যেমন হাকালুকি, তেমনি দেশীয় নানা জাতের মাছ ও পাখির অভয়ারণ্যের বাইক্কা বিল। শীত আর গ্রীষ্ম দু’মৌসুমে এই দুটি স্থানের প্রকৃতির দু’ধরনের রূপ সৌন্দর্য। সারা বছরই পর্যটকদের মুগ্ধ করতে প্রস্তুত হাওর হাকালুকি আর বাইক্কা বিল। বর্ষায় দু’চোখ জুড়ে থৈই থৈই পানি। বিশাল জলরাশির মধ্যখানে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জেগে ওঠা হিজল, করচ, কলুম আর নয়ন কাড়া সবুজ জলজ বনের রাজ্য। আর শীত মৌসুমে দু’ চোখ জুড়ে শুধু সবুজ ঘাসের মাঠ। তখন পুরো হাওর জুড়ে গরু মহিষের বাতান। আর হাওরের বিলে খাদ্যের সন্ধানে অবাধ বিচরণ নানা জাতের দেশী ও বিদেশী অতিথি পাখি। তাই ওই সময়ে সকাল ও সন্ধ্যা পাখি দেখতে স্থান দু’টিতে সমাগম ঘটে পাখি প্রেমী পর্যটকের। তাই প্রকৃতির টানে এসব স্থানগুলোতে ছুটে আসেন সৌর্ন্দয পিপাসুরা। সরেজমিন হাওর হাকালুকি আর বাইক্কা বিলে গেলে এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে।
হাকালুকি হাওরের আয়তন প্রায় ২০ হাজার চারশত হেক্টর। কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও ফেঞ্চুগঞ্জ এবং গোলাপগঞ্জ এই ৫টি উপজেলা জুড়ে ২৩৮টি বিল নিয়ে এই হাওর। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে থাকা হাকালুকি এখন কোনরকম তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
একটু উষ্ণতা আর খাবারের সন্ধানে পুরো শীত মৌসুম এরা দাপিয়ে বেড়ায় হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন বিলে। গোধুলি লগ্নে পাখিদের ওড়াওড়ি, ডুব সাতার, জলখেলি, খুনসুটি, রোদে পালক পোহানু আর খাবার নিয়ে ঝগড়া কিংবা খাবার সংগ্রহের মনোহর দৃশ্য এখন হাকালুকি হাওরে।
হাকালুকি হাওর পাড়ের বাসিন্দারা জানালেন হাওরের পিংলা, চাতলা, চৌকিয়া, হাওর খাল, মালাম, গৌড়কুড়ী, নাগুয়া, তুরল, কালাপানি, ফোয়ালা, বালিজুড়ী, কাংলি ও ফুটবিলে এখন অতিথি পাখির হাকডাক।
বাইক্কা বিল : অতিথি আর দেশীয় পাখির কলকাকলিতে মুখরিত বাইক্কা বিল। ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিল। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ,মাছ ও পাখি। বিলের পাড়ে সবুজ ঘন বন। ওখানেই স্থায়ী নিবাস পাখি আর পোকা মাকড়ের ডাক নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ভিন্ন আমেজ। এমন দৃশ্য খোলা চোখে দেখতে কাদামাটির ভাঙ্গাচোরা রাস্তা মাড়িয়ে ওখানে ছুটে আসেন পর্যটকরা।
জানা গেছে, বাইক্কা বিলে ৮০ প্রজাতির মাছ ও শতাধিক প্রজাতির পাখির অভয়াশ্রম। বাইক্কা বিল শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের প্রায় ১শ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমি।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় এই বিল মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত বিপুল অতিথি পাখি আর দেশীয় নানা জাতের ছোট বড় মাছ ও পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এটি। বিলের পার ও কূল ঘেষে হিজল, করচ, নল খাগরা, ঢোল কলমী আর ফুল ও লতাগুল্ম। বিলে কুচুরি পানা, শাপলা ও পদ্ম, সিংড়া, মাখনা।
বাইক্কা বিলে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ নানা জাতের পাখি। এদের মধ্যে-পানকৌড়ি, কানিবক, ডাহুক, জল মোরগ, ধলাবক, ধুপনি বক, রাঙ্গা বক, মাছরাঙা, গোবক, শঙ্খচিল, ভুবন চিল, পালাসী কুড়া ঈগল, গুটি ঈগল অন্যতম। কালো লেজ জৌরালি ও দাগিলেজ জৌরালি, লম্বা পায়ের পাখি দলপিপি, নেউপিপি, কুট, পান মুরগি ও বেগুনি কালেম, কালামাথা কাস্তেচরা, গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা টিটি, কালাপাখ ঠেঙ্গী, এ বিলের নিয়মিত অতিথি পাখি পান ভোলানি। বিপন্ন তালিকায় থাকা পালাশী কুড়া ঈগল, অন্যান্য পাখির মধ্যে, দাগি রাজ হাঁস, খয়রা চখাচখি, ল্যাঞ্জা হাঁস, পাকড়া কোকিল, নীললেজ সুইচোর, পাতি আবাবিল, দাগি ঘাসপাখি, সরালি, মরচেরং ভুঁতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতিচ্যাগা উল্লেখযোগ্য। আর মাছের মধ্যে আইড়, মেনি, কাখলে, কই, ফলি, মলা, টেংরা, পুটি, দাড়কিনা, কাশখয়রা, পাবদা, মাগুর, শিং, টাকি, চিতল, কাতলা, বোয়াল, রুই ও গজার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
পাখি ও মাছের নিরাপদ আবাস্থলের কারণে এখন পর্যটকদের কাছে প্রধান আর্কষণ বাইক্কা বিল এমনটাই জানালেন ওয়াচ টাওয়ারের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত আহসান হাবিব ও রাজু আহমদ।
তারা জানান, সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার এই দুদিন পর্যটক বেশি আসেন। তারা আরও জানান,জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে গত দুই মাস কোন পর্যটক দেখা মিলেনি।’
বাইক্কা বিলে দেখা মিলে প্রকৃতি প্রেমীদের। ঢাকা উত্তরা থেকে বেড়াতে আসা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র স্পেশাল এডুকেটর সাবরিনা মোস্তারি ও তার স্কুল পড়–য়া সৃজিতা,সরণা খাতুন। হবিগঞ্জ ব্যাংক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম তার স্ত্রী সায়েলা সুলতানা। তারা সকলেই পাখি দেখে উৎফুল্ল। তারা জানালেন, এক সাথে এতো পাখি আর সবুজ প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ।
বাইক্কা বিলের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকা সমাজ ভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন বড়গাঙ্গিনার সম্পাদক মিন্নত আলী বলেন, হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে আমাদেও প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে। হাওরে মাছ বৃদ্ধির জন্য বেশি করে গভীর অভয়াশ্রম ও পাখির নিরাপদ নিবাসের জন্য বনায়নের গুরুত্বারোপ করেন তিনি।