কাজিরবাজার ডেস্ক :
অপেক্ষার পালা শেষ। রাত পোহালে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সারা জাতি এখন তাকিয়ে আছে ভোটের দিকে। শেষ সময়ে ভোটাররা হিসাব নিকাশ কষছেন ভোটের যোগ্য প্রার্থী কে। কাকে বিপদে আপদে পাশে পাওয়া যাবে। এদিকে নির্বাচন কমিশনও ভোটের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। রবিবার সকাল আটটায় শুরু হবে ভোটগ্রহণ, বিরতি ছাড়াই চলবে বিকেল চারটা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ শেষে গণনা এবং ফল প্রকাশ শুরু হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার পর্ব শেষে এখন শুধুই ভোটের অপেক্ষা। ১০ কোটির বেশি ভোটার এখন তাকিয়ে আছেন রবিবারের ভোটের দিকে। সেদিন সারাদেশের ভোটাররা যাদের পক্ষে রায় দেবেন তারাই দেশের সরকার গঠন করবে। পাঁচ বছরের জন্য তারাই ক্ষমতায় আসবে। আইন অনুযায়ী সরকার গঠন করতে হলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে ৩শ’ আসনের মধ্যে ১৫১ আসন পেতে হবে। নির্বাচন শেষে জানুয়ারির ২৮ তারিখ থেকে দেশে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হবে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য গত ৮ নবেম্বর তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। প্রথম দফা তফসিলে ২৩ ডিসেম্বর ভোটের দিন ধার্য করা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর আবেদনের কারণে ১২ নবেম্বর পুনতফসিলে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন ধার্য করা হয়। প্রতীক বরাদ্দের পর গত ১০ ডিসেম্বর সারাদেশে আনুষ্ঠানিক ভোটের প্রচার শুরু হয়। প্রার্থীর প্রচার থেমে গেছে শুক্রবার সকাল ৮টায়। গত বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনার যে আবেদন নিবেদন জানিয়েছেন প্রার্থীরা, তারই প্রতিদান দেয়ার পালা আগামীকাল। ভোটের জন্য জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রাজধানীর বাইরের ভোটাররা ভোট দিতে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছেন ইতোমধ্যে। শনিবার রাত থেকেই সব ধরনের যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের দিন ইসির স্টিকারযুক্ত গাড়িই কেবল চলাচল করতে পারবেন। এর বাইরে অন্য সব ধনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। তবে সংবাদপত্রবাহী পরিবহন চলাচলে কোন বাধা নিষেধ নেই বলে ইসির জনসংযোগ শাখা থেকে জানানো হয়েছে। জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক আশাদুল হক বলেন, যেসব গাড়ি পত্রিকা পরিবহনে নিয়োজিত থাকবে, সেসব গাড়ির সামনে সংবাদপত্রবাহী গাড়ি লেখা থাকলেই গাড়ি চলাচলে কোন বাধা নেই।
এবারে নির্বাচনে ইসির নিবন্ধিত ৩৯ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এর বাইরেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন অনেক প্রার্থী। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নির্বাচনে প্রতীকের পাশাপাশি ব্যক্তি ইমেজও ভোটারদের বিবেচনায় রয়েছে।
দেশের ৩শ’ আসনের ভোটগ্রহণের তফসিল থাকলেও ভোটের শেষ পর্যায়ে এসে গাইবান্ধা-৩ আসনের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে এই আসনে ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে। ফলে আগামীকাল ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। বাকি একটি আসনে ভোট নেয়া হবে ২৭ জানুয়ারি। ৩০ ডিসেম্বর রবিবার দেশের ২৯৯ আসনে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট চলবে। ভোটের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে রয়েছেন। ইসি সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধিত ৩৯ দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে এবার এক হাজার আট শ’র বেশি প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে আছেন। এর মধ্যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও জোটের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং হামলা-ভাংচুরের ঘটনায় ছড়িয়েছে উত্তাপ। ফলে এবারের নির্বাচনে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সিইসি জানিয়েছেন নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
দেশ স্বাধীনের ৪৭ বছরে এখন পর্যন্ত দেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১০ বার। আগামীকাল ১১ বারের মতো সরকার গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে ইসির নিবন্ধিত দল ও স্বতন্ত্র মিলে ১ হাজার ৮৪৮ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নিকট অতীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের চেয়ে এবার রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৭৪৯ জন। অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৯৯ জন ভোটের মাঠে রয়েছেন।
কোন দলের কতজন প্রার্থী : এবারের নির্বাচনে ইসির নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে এলডিপি ৮ প্রার্থী, এর মধ্যে ধানের শীষ প্রতীকে ৪, মহাজোটের শরিক জেপি ১১, এর মধ্যে মহাজোটের সঙ্গে ২ জন, সাম্যবাদী দল ২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৯ জন, (ধানের শীষে ৪), সিপিবি ৭৪, আওয়ামী লীগ ২৬১ (নৌকা ২৭৪), বিএনপি ২৭২ (ধানের শীষ ২৯৭), গণতন্ত্রী পার্টি ৬, ন্যাপ ৯, জাতীয় পার্টি ১৭৬ (মহাজোট ২৫), বিকল্পধারা ২৫ (নৌকা ৩), ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ (নৌকা ৫), জাসদ ১২ (নৌকা ৩), জেএসডি ১৯ (ধানের শীষ ৪), জাকের পার্টি ৯০, বাসদ ৪৫, বিজেপি ৩ (ধানের শীষ ১), তরিকত ফেডারেশন ১৭ (নৌকায় ১), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২৩, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ ৪৮, এনপিপি ৭৯, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম ৮ (ধানের শীষ ৩), গণফোরাম ২৭ (ধানের শীষ ৭), গণফ্রন্ট ১৩, পিডিপি ১৪, বাংলাদেশ ন্যাপ ৩, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১১, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১৮, কল্যাণ পার্টি ২ (ধানের শীষ ১), ইসলামী ঐক্যজোট ২৪, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ৫, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২৯৮, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২৫, জাগপা ৪, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ২৮, খেলাফত মজলিস ১২ (ধানের শীষ ২), বিএমএল ১, মুক্তিজোট ২, বিএনএফ ৫৭ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এদিকে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৬১০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন ৬ লাখ ৮ হাজার ও বাকি ৬৮ হাজার ৬১০ জন কেন্দ্রের বাইরে স্ট্রাইকিং ফোর্স, মোবাইল টিমসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন।
শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি তুলে ধরে এ তথ্য জানান।
নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোট হচ্ছে। এই ভোটের জন্য স্ব স্ব জেলা ও উপজেলায় নির্বাচনি সামগ্রী পৌঁছে গেছে। শুক্রবার রাতেই কেন্দ্রভিত্তিক ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনি সামগ্রী পৃথক করবেন। শনিবার (২৯ ডিসেম্বর) সকাল ১০ প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছে এগুলো হস্তান্তর করা হবে। প্রিজাইডিং অফিসারা পুলিশ, আনসার ও গ্রাম পুলিশকে নিয়ে কেন্দ্রে যাবেন। সন্ধ্যার আগে তারা কেন্দ্রে পৌঁছে রাতে সেখানেই অবস্থান করবেন। ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হবে।’
ইসি সচিব বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রায় সাত লাখের কাছাকাছি নিরাপত্তা বাহিনী ও সাত লাখের মতো সিভিলিয়ান অফিসার নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকসহ আরও এক লাখ মানুষ থাকবে। এই ১৫ লাখ লোক নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত থাকবেন। সবার কাজ হবে সুষ্ঠু, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমরা আশা করবো, শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হবে।’
পোলিং এজেন্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে প্রার্থী যাকে পোলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করবেন, তিনি ভোটের দিন প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে তার নিয়োগপত্রটি পৌঁছে দিলেই চলবে।’
ইসি সচিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য। এর মধ্যে পুলিশ এক লাখ ২১ হাজার, আনসার চার লাখ ৪৬ হাজার, গ্রাম পুলিশ ৪১ হাজার।
নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনী ৩৮৯টি উপজেলায় ৪১৪ প্লাটুনে বিভক্ত করে ১২ হাজার ৪২০ জন, নৌবাহিনী ১৮ উপজেলায় ৪৮ প্লাটুন (১৪৪০ জন), কোস্ট গার্ড ১৮ উপজেলায় ৪৮ প্লাটুন (১২৬০জন), বিজিবি ৯৮৩ প্লাটুন (২৯৪৯০ জন), র্যাব ৬০০ প্লাটুন (১৮ হাজার) এবং মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স দুই হাজার প্লাটুন (প্রায় ৬৫ হাজার)।
এছাড়া, নির্বাচনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬৪০ জন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এক হাজার ৩২৮ জন (এর মধ্যে ৬৫২ জন আচরণ বিধি প্রতিপালনের জন্য) দায়িত্ব পালন করছেন।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন, মহিলা ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ৪০ হাজার ১৮৩টি, ভোট কক্ষ ২০ লাখ ৭৩১২টি। অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ৩৯টি (নিবন্ধিত সবগুলো)। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এক হাজার ৮৬১ জন। রাজনৈতিক দলের প্রার্থী এক হাজার ৭৩৩ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ১২৮ জন।
দেশি পর্যবেক্ষক ৮১ সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন, বিদেশি পর্যবেক্ষক ৩৮ জন, কূটনীতিক ও বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন এবং বিদেশি মিশনে কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন। এছাড়া, শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক নির্বাচন কাভার করবেন।
ফলাফল ঘোষণা : নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান জানান, ফলাফল কেন্দ্রেই গণনা করা হবে। প্রিসাইডিং অফিসার ফলাফল গণনার পর উপস্থিত পোলিং এজেন্টদের কাছে হস্তান্তর করবেন। এরপর তিনি ফলাফল ও মালামাল সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কার্যালয়ে এসে লিখিতভাবে জমা দেবেন। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার সেই ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। পরে রিটার্নিং অফিসাররা আরএমএস -এর মাধ্যমে (ইসির ইন্টারন্যাল সাইট) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠাবেন।
তিনি জানান, সচিবালয়ে ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে ৮টি বিভাগের জন্য ৮টি মনিটর থাকবে। সেগুলো আমরা মনিটরে দেখাবো। এই ৮টি বিভাগকে একত্র করে একটি মনিটরে দেখানো হবে। আরও একটি মনিটর থাকবে রাজনৈতিক দলভিত্তিক। এই ১০টি মনিটরের মাধ্যমে ফলাফল দেখানো হবে। ওখানে একটি মঞ্চ থাকবে, সেখান থেকে ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাও করা হবে।