শফিকুল ইসলাম খোকন
এ কটি জাতির যখন নৈতিক অধ:পতন ঘটে, তখন সেই জাতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়, সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় এবং একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্রের তখন শত শক্তি থাকলেও কোনো কিছু করার থাকে না। আর যখন মাকে নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন আসে তখন কী করার আছে। আসুন আমরা এরকমের মায়ের হাতে যেন কোনো মর্মান্তিক মৃত্যু না ঘটে সেজন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। সচেতন করি, ব্যক্তিকে, পরিবারকে। ভবিষ্যৎ কণর্ধারদের পাশে দাঁড়াই, পাশে দাঁড়াই অসহায় মায়েদের। বাঁচিয়ে রাখি সুন্দর দেশটিকে।
মা; এই পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দ। পৃথিবীর সবর্বহুল উচ্চারিত, সবোর্ত্তম শ্র“তিমধুর একটি অক্ষরের একটি শব্দ, যে শব্দের সঙ্গে অন্য কোনো শব্দের তুলনা হয় না। তিনি সহজাত মমত্ব দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন সবসময়। তাই সবাই বলে, মায়ের মতো আপন কেউ হতে পারে না। একজন শিশু কেন? সকল সন্তান মায়ের কাছেই সবচেয়ে নিরাপদ। এক কথায় মায়ের এর চেয়ে ভালোবাসা, আন্তরিকতা, বিশালতা লিখিতভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো অবকাশ নেই। সেই মমতাময়ী মায়ের সঙ্গে মনুষ্যত্বের একটি বিশাল মিল। যা একে অপরের পরিপূরক। যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো পরিবেশে কে আপনাকে নিঃস্বাথর্ভাবে ভালোবাসতে পারবে? উত্তরটা অনেক সোজা, মা ছাড়া আর কেউ আপনার সময়, অবস্থা, পরিবেশ বিবেচনা না করে ভালোবাসবে না।
মাকে নিয়ে ভালো কিছু লিখতে সব সময়ই ভালো লাগে। ভালো লাগবেনা কেন? মা যে মমতাময়ী; মায়ের মাধ্যমে যে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখেছি। মাকে নিয়ে (খারাপ বলব না) ভালো না লাগার বিষয় লিখতে কষ্ট হয়। মাকে খারাপ ভাবাতো দূরের কথা খারাপ কিছু লেখাও কষ্টকর। কিন্তু স¤প্রতি গণমাধ্যমে মাকে নিয়ে কিছু সংবাদ দেখায় সেই মাকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তা ভাবতেও অনেক কষ্ট হচ্ছে। যেই মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয়, বাস্তবিক অথের্ মা-ই নিরাপদ, সেই মায়ের দ্বারা শিশুসন্তানকে হত্যা… এটি ভাবার বিষয়। এর নেপথ্যে আসলে রহস্য কীÑ এটিও উদ্ঘাটন করা দরকার। আর মা- ই বা কেন নারীছেঁড়া ধনকে হত্যা করবে? হতে পারে পারিবারিক বিরোধ, সংসারে অভাব, মানসিকতা বিকৃত ইত্যাদির কারণেও। কখনো কখনো দেখা গেছে, পরকীয়ার টানে মা অথবা বাবার হাতেও সন্তানকে হত্যার ঘটনা।
একটি জাতির যখন নৈতিক অধ:পতন ঘটে, তখন সেই জাতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। যার সেটি যদি হয় সবচেয়ে নিরাপদ আসন ‘মা’। মা যদি অনিরাপদ হয় তাহলে সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় এবং একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্র তখন শত শক্তি প্রয়োগ করে, আইন তৈরি করে, শাস্তি দিয়েও সমাজের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে না। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দেশের বতর্মান প্রেক্ষাপট। আগে মা ছাড়া মানুষের মনুষ্যত্ব, মানবাধিকার নিয়ে লেখালেখি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি হতো। মুনষ্যত্ব এমন পযাের্য় গিয়ে ঠেকেছে যে, ‘মা’ শব্দটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আগে দেখা যেত, সন্তানের হাতে মা হত্যা, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মায়ের হাতে সন্তান হত্যা। এখন স¦ভাবতই প্রশ্ন আসেÑ আসলে আমাদের মনুষ্যত্ব, মানবিকতা কোথায় ঠেকেছে? আসলে কি আমাদের মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানবিকতা, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা লোপ পাচ্ছে? দিন যতই সামনে এগোচ্ছে, মনে হচ্ছে মানুষ একে অপরের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাবাপন্ন হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। যা এখন দেখা যাচ্ছে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তান এবং সন্তানের প্রতি মা-বাবার হিংস্রতা। সেটি কখনো আশা করেনি কেউ এবং সেটি কখনোই সম্ভব হবার নয়;
গত কয়েকদিনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটাই দেখা গেছে। আগে দেখা যেত বাবা-মায়ের অবাধে সন্তান চলত, জমিজমা বিরোধ নিয়ে সন্তানের হাতে বাবা-মা খুন, নেশার টাকা দিতে না পারায় বাবাকে হত্যা ইত্যাদি। কিন্তু আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে হয়তো এর আগে কখনো শুনিনি বা দেখিওনি অবুঝ শিশুসন্তানকে মা অথবা বাবা হত্যা করেছে, কখনো কখনো মা-বাবা সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছে। এমন ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি। চলতি মাসের ১৯ তারিখে নিজের গভর্জাত তিন দিনের ছেলেকে পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করে মা সীমা আক্তার (২৫)। নিজ হাতে হাসপাতালের পাঁচ তলার ছাদ থেকে ছেলেকে ফেলে হত্যার পর নিজেও গড়িয়ে পড়ে জীবন দেন সীমা। ২২ অক্টোবর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় প্রতিবন্ধী মেয়ে তমালিকাকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর মা শান্তি রাণী ম-লও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। চলতি বছরের ১ সেপ্টে¤¦র পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী হবিগঞ্জের মাধবপুরে দুই সন্তানকে জবাই করে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছে। শিশু দুটির লাশ গলা কাটা অবস্থায় ঘরের খাট ও মেঝেতে পড়েছিল। আর মায়ের লাশটি পাশেই ফাঁস দেয়া অবস্থায় ঝুলছিল। স¤প্রতি গাজীপুরের রেল লাইনে বাবা-মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনাও দেখতে হয়েছে। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা তালতলা এলাকায় পারিবারিক দ্বন্দ্বে প্রতিবন্ধী ৫ বছরের শিশুপুত্র রিয়াদকে জবাই করে হত্যার পর পিতা হাবিবুর রহমান গলায় ছুরি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এত গেলে দেশের কয়েকটি ঘটনা। এমন ঘটনা যে শুধু দেশে হয়েছে তা নয়? বিদেশেও অহরহ ঘটছে। স¤প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনির্য়ার বাবা-মার হাতে নিযার্তনের শিকার হয়েছে ১৩ ভাইবোন। দেশটির পুলিশ ওই ১৩ ভাইবোনকে উদ্ধার করেছে। দুই থেকে ঊনত্রিশ বছরের ছেলেমেযেদের তাদের বিছানার সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল তাদেরই বাবা ও মা। ২০১৫ সালের মে মাসে গভর্ধারিণী মা তার ১৩ মাসের শিশুসন্তানকে ধারালো কাঁচি দিয়ে জবাই করে হত্যা করেছে। কি এমন দোষ ছিল সীমার তিন দিনের পুত্রসন্তানের? যে অবুঝ সন্তান পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার আগেই মায়ের প্রতিহিংসার বলি হতে হলো? ওরা কাকে দোষ দেবে ওদেরই বা কি দোষ ছিল? বাবা-মায়ের পারিবারিক কলহ, অভাব-অনটন আর পরকীয়ার বলি এসব সন্তানের এ রকমের পরিণতির বিচারই কি হবে?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে বা আসাটাই স¦াভাবিক। একটি সন্তান মায়ের গভের্ আশা থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে মা সন্তানকে বিপদে-আপদে আগলে রাখেন সে মা কিভাবে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন। এ প্রশ্ন আমারও; তবে আমার ক্ষুদ্র মেধায় যেটি বুঝতে পারছি সেটি হলো মানুষের স¦াভাবিক মানসিকতা বা মস্তিষ্ক যখন বিকৃত তখনই এ রকমের ঘটনা ঘটানো সম্ভব। মনুষ্যত্বের অধঃপতনের আরও নৃশংস চিত্র দেখা যায় বাবা কর্তৃক মেয়ে ধষর্ণের চিত্রে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলে ও নাটোরে, ২০১৬ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে ও সিলেটে বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া এমন ঘটনা আরও ঘটছে, যা হয়তো পত্রিকার পাতায় উঠে আসছে না।
প্রতিটি শিশুই আল্লাহর দান। ফুলের মতো নির্মল, নিষ্পাপ। নির্মোহ ও নিরপরাধ। ফুল ও শিশুকে যারা ভালোবাসে না তারা অমানুষ অথবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নিজের শিশুসন্তান তো বটেই, অন্যের এমনকি জীবনের দুশমন হলেও তার শিশুসন্তানের প্রতি কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে না, যার সামান্যতম মানবতাবোধ থাকে। মানুষ তো বটে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশুপাখিও নিজের সন্তানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। মায়া, মমতা, সহানুভূতি এসব গুণ মহান আল্লাহ্ই দিয়েছেন তার বান্দাদের। তবে নানা কারণে প্রকৃতিতে যেমন বিপর্যয় দেখা দেয়, তেমনই মানুষের চিন্তা- চেতনাতেও বৈকল্য ঘটে। বিপযর্য় দেখা দেয়। বিশেষত মানসিকভাবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জীবন সম্পর্কে হতাশা, উপার্জনহীনতা, আপনজনের সঙ্গে বিরোধ, সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকলে অনেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেকে সামলাতে পারে না। তখন অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপনজন, স্ত্রী-পরিজন, এমনকি প্রিয় সন্তানকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে নাÑ এমনই নিষ্ঠুর ও নির্মম কমর্কান্ড আমাদের সমাজে ঘটছে প্রায়শ। কিন্তু…, মায়ের হাতে সন্তান? এটাও কি সম্ভব? এমন নিষ্ঠুরতাও এখন সমাজে ঘটছে। কিন্তু কেন? এর উত্তর কি কারো কাছে আছে? এখনই সময় এসেছে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। এরকমের অপরাধের সংখ্যা এখন কম। এ বিষয়গুলোও সরকারসহ এনজিওদের মাথায় রাখতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আত্মহত্যা, সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনই ভাবার সময়। এ জন্য সচেতনতামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে এসব ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব।
মা তার সন্তান গর্ভে থাকাকালীন নিজের রক্ত এবং পৃথিবীতে আসার পর বুকের দুধ নিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষা করে। তারপর সন্তান যখন বড় হতে থাকে তখন সারাক্ষণ তাকে সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখে মা। আর যেকোনো বিপদ মোকাবিলা করার মোটিভেশন আমরা মায়ের কাছ থেকেই পাই। মা এমন একজন মানুষ যিনি সন্তানের ভালোর জন্য পৃথিবীর সকল বাধা ভাঙতে রাজি থাকেন সবসময়। নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানকে ভালোবাসেন। মায়েরা ক্লান্ত হয়, ব্যথা পায়, কিন্তু সন্তানের জন্য সবকিছু ভুলে থাকে।
আগেই বলেছি একটি জাতির যখন নৈতিক অধ:পতন ঘটে, তখন সেই জাতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়, সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় এবং একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্রের তখন শত শক্তি থাকলেও কোনো কিছু করার থাকে না। আর যখন মাকে নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন আসে তখন কী করার আছে। আসুন আমরা এরকমের মায়ের হাতে যেন কোনো মর্মািন্তক মৃত্যু না ঘটে সেজন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। সচেতন করি, ব্যক্তিকে, পরিবারকে। ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের পাশে দাঁড়াই, পাশে দাঁড়াই অসহায় মায়েদের। বাঁচিয়ে রাখি সুন্দর দেশটিকে।