গণভবনে ইসলামী দল ও বাম জোটের সঙ্গে সংলাপ ॥ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা

37

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ইসলামী দলের নেতারা। সংবিধানের মধ্যে থেকেই ইসলামী দলগুলো সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে চায় বলেও জানিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলমান সংলাপের ধারাবাহিকতায় অংশ নেয় ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা। সংলাপে জোট নেতারা আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় আট রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তদারকি সরকার গঠনসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে ধরেন।
বিভিন্ন দলের নেতাদের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সবার মতামত নিয়েই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সকল রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগেরও নিশ্চয়তা দেন বিভিন্ন দলের নেতাদের।
হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরাতে ইসলামী দলগুলোর সহযোগিতার আশ্বাস ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরাতে ইসলামী দলগুলো সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটসহ ১২টি দলের সংলাপে দলগুলোর নেতারা এ আশ্বাস দেন বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছেন তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ইসলামী দলগুলোর নেতারা। আগামীতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসবেন এ ব্যাপারে তাদের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে এ কথা তারা অকপটে বলে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার আদর্শ সমুন্নত রাখার ব্যাপারে উভয়পক্ষই সংলাপে একমত হয়েছেন বলে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ইসলামী দলগুলো ‘সংবিধানসম্মতভাবে’ নির্বাচন সমর্থন করে এবং এ ব্যাপারে তারা ‘অংশী’ হিসেবে থাকবেন বলেও জানান কাদের। সংলাপে দ্বিমত বলেও কিছু ছিল না বলে মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোট (আইওজে), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জালালী পার্টি, আশিক্কীনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় ইসলামী জোট-বিএনআইএ, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্সসহ (আইডিএ) ১২টি দলের ৫২ নেতা।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আলতাফ হোসাইন, সহকারী মহাসচিব মাওলানা জসীমউদ্দিন, ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রশিদ মজুমদার, ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল হামিদ, মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মুফতি তৈয়্যব হোসাইন, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আবুল কাসেম, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফজলুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শেখ লোকমান হোসাইন, যুগ্ম মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন।
ইসলামী জোটগুলোর এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত : সংলাপ শেষে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেছেন, ইসলামী জোটগুলো এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে। নেজামী বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে বা সংসদ রেখেই নির্বাচন হওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আমাদের দেশেও ওই পদ্ধতিই অনুসরণ করা উচিত বলে আমার মনে হয়।
সংলাপ ভাল হয়েছে জানিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক হোক, নির্দলীয় বা সর্বদলীয় সরকার এটা নিয়েই তো দ্বন্দ্ব চলছে। সরকার বলছে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। অন্যরা বলছে সংবিধানের মধ্যেই এই দ্বন্দ্বের সমাধান সম্ভব। তাহলে তো একটা ঐক্য হয়েছেই। আমরাও সংবিধানের মধ্য থেকেই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে বলেছি।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়ত মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জি হুজুর বলেন, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছেন কি না জিজ্ঞেস করতে তিনি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন।
আন্মানে রহমানিয়া মইনীয়া মাইজভাণ্ডারীর চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারী বলেন, কোন্ জোটে যাব তা এখনই বলতে পারছি না। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি।
ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্সের কো-চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল বলেন, সবাই সরকারের নির্বাচনের পাশে থাকতে চায়। সমর্থন দিতে চায়। সংবিধান রক্ষা করে বিধিবিধান ঠিক রেখে যেন নির্বাচন হয়। এই সরকারের উন্নয়ন ও ইসলামের প্রচারে তাদের অবদানের জন্য পাশে আছি, থাকব।
মুসলিম লীগের স্থায়ী কমিটির সদস্য আতিকুল ইসলাম বলেন, এটা সংলাপ আর কী, সবাই প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছে। আমরা বলেছি, আপনারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এসেছিল। সংবিধান সংশোধন হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে এই ব্যবস্থার অধীনেই আপনারা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এর বাইরে আর কি কিছু বলতে হবে?
আলোচনা ফলপ্রসূÑ জাকের পার্টি : মঙ্গলবার দুপুরে জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমির ফয়সল মুজাদ্দেদীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে আয়োজিত সংলাপে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। জাকের পার্টির চেয়ারম্যান পীরজাদা মোস্তফা আমির ফয়সল মুজাদ্দেদী সংলাপ শেষে বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। আমরা বর্তমান চলমান ধারাকে শক্তিশালী করতে চাই। আমরা আশা করি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকার একটি সুন্দর, সাবলীল এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দান করবেন-এ বিষয়ে সরকারের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে।
তিনি বলেন, আমরা চাই গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করতে। একটি সুন্দর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামী দিনে সুন্দর সংসদ যাতে চলমান থাকতে পারে এবং দেশের চলমান উন্নয়ন গতিশীলতা পায়, সে লক্ষ্যে আমরা অঙ্গীকার করেছি। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আসুন আমরা শান্তির পথ অনুসরণ করি। আরেকটি রক্তাক্ত বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাই না। আমরা চাই, শান্তি সৌহার্দ্য।
মুজাদ্দেদী বলেন, সংলাপে সার্বিক রাজনীতির বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা আগাগোড়া মহাজোটের সঙ্গেই আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো কোন স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে আমরা দেখব কতটুকু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। যদি একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায় তবে সেটা হবে আমাদের জাতির জন্য এক মাইলক। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঐক্যফ্রন্ট হোক বা অন্য দলগুলো হোক তাদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্য : সবার মতামত নিয়েই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুরে গণভবনে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়নে সরকারের টানা দুই মেয়াদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন দিয়েই সংলাপ শুরু করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের ২৩ সদস্য : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ২৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে যোগ দেন। এর মধ্যে ১৪ দলের শরিক নেতারাও রয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্লাহ এবং ড. আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল মতিন খসরু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ডাঃ দীপুমনি, আব্দুর রহমান, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং আইন সম্পাদক শম রেজাউল করিমও উপস্থিত ছিলেন। ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ একাংশের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাসদ আরেক অংশের কার্যকরী সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল সংলাপে অংশ নেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোট : সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যেই গণভবনে বাম জোটের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়। প্রথমে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাদের স্বাগত জানান। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা পর্ব শেষে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর জোট নেতারা নিজেদের দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন। বাম গণতান্ত্রিক জোটের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। সংলাপে এই বাম জোটের পক্ষ থেকে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রতিনিধি দলে ছিলেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাম গণতান্ত্রিক জোট সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, পলিটব্যুরো সদস্য আকবর খান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আলমগীর হোসেন দুলাল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, সম্পাদকম-লীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোমিনুর রহমান বিশাল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রণজিৎ কুমার।