॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
আমাদের দেশে তিন ভাষায় সন বা বর্ষ গণনা করা হয়। আরবী, বাংলা ও ইংরেজী। দেশ হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং স্বাধীন ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার নিজস্ব স্বকীয়তা ও মর্যাদা থাকলেও সন গণনার ক্ষেত্রে বাংলার অবস্থান দ্বিতীয়। মুসলিম জাতি হিসেবে আরবী ভাষার একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকলেও আমাদের কাছে তা নেই। ফলে আরবী সন গণনার স্তর গিয়ে দাঁড়িয়েছে তৃতীয়তে। কেবল প্রাধান্য পাচ্ছে ইংরেজী গণনা। প্রায় দু’শ’ বছরের ইংরেজ শাসন আমাদের মন-মগজকে যেভাবে ধুলাই করেছে বংশ পরিক্রমায় তা আমরা লালন করছি ঐশী বিধানের মতো। আমাদের যা নিজস্ব সম্পদ তার গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই বললেই চলে। যেমন বাংলা ভাষার জন্য ৮ই ফাল্গুন রক্ত ঝরেছে। শহীদ হয়েছে অনেকে। অথচ আমরা মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি ২১শ ফেবরুয়ারী। ৮ই ফাল্গুন ইংরেজদের ধুলাই আগুনে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। একইভাবে আরবী চলে গেছে আরব দেশে। সে যাই হোক, বাংলা ও ইংরেজি সন আমরা গণনা করি বটে। আজ পর্যন্ত কেউ এ সনদ্বয়কে চর্ম চক্ষে দেখছে বলে শুনিনি। ৩০/৩১ দিন শেষ হলেই তোতা পাখির ন্যায় বলি জানুয়ারি, ফেবরুয়ারি, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি। আসলে এসবের কোন দৃশ্যমান অস্তিত্ব যেমন নেই তেমনি মানবজীবনে এর গুরুত্বও নেই। পক্ষান্তরে আরবী মাসসমূহ যেমন মানুষের চোখের সামনে দৃশ্যমান অনুরূপ এর গুরুত্বও অপরিসীম। এ বিশাল ও বৈচিত্রময় পৃথিবী যার ইঙ্গিতে সৃষ্টি হয়েছে সে মহামহিম আল্লাহ নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তোমরা যাতে করে বছরের সংখ্যা, সময় গণনা করতে পার তার জন্য আমি চন্দ্র ও সূর্য্যকে আলোকবর্তিকাময় ও উহার কক্ষপথ সুনিয়ন্ত্রিত করেছি।‘‘ (আল-কোরআন)। আরবী মাসসমূহ মূলত এ জন্যই দৃশ্যমান। যেহেতু আরবী মাসসমূহ সময় এবং কাল গণনার্তে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই দৃশ্যমান এ মাসগুলোর গুরুত্ব লক্ষণীয়। সময়ের আবর্তে নতুন চন্দ্র উদয়ের মধ্যদিয়ে চক্রাকারে এক একটি মাস নানান গুরুত্বে ও তাৎপর্য্যের বার্তা নিয়ে মানবমন্ডলীর সমীপে উপস্থিত হয়। এসব মাসের মধ্যে এমন কতক মাস রয়েছে যা অধিক মর্যাদার দাবীদার ও বরকতময়। এ বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ মাসসমূহের মধ্যে একটি হলো আরবী সনের প্রথম মাস ‘‘মাহে মহররম’’ বা হারাম মাস অথবা পবিত্র মাস। মহররমকে হারাম মাস বলা হয় এ কারণেই যে, এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি করা হারাম বা শরীয়া দৃষ্টিতে অবৈধ। পবিত্র মাস বলা হয় এ কারণেই যে, সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিবাদ-বিশৃংখলা, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা দরকার বলেই এ মাসকে পবিত্র মাস হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়। যেহেতু সন গণনার সূচনা মাস সেহেতু এ মাসে কোন ধরনের খারাপ কাজ করা উচিত নয়। অন্যান্য মাসেও তা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা সূচনা মাসেই দেয়া হয়। পৃথিবীর সূচনা হতে এ পর্যন্ত যত বড় বড় বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অকল্পনীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সিংহ ভাগই এ মাসের ১০ তারিখ সংঘটিত হয়েছে। এ দিনে সংঘটিত কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিম্নরূপ : ১। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এ দিনে। অর্থাৎ পৃথিবীর জন্ম দিন হলো ১০ মহররম। ২। আদি পিতা হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করা হয় এ দিন। ৩। এ দিনেই হযরত আদম (আ.) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। ৪। বিচ্যুতির কারণে হযরত আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তাঁর তাওবা কবুল করা হয়। ৫। জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্ম দিন। ৬। নমরুদের বিশাল অগ্নিকুন্ড হতে জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) মুক্তিলাভ করেন। ৭। তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে হযরত মুসা (আ.)-এর কথোপকথন ও আসমানী কিতাব ‘‘তাওরাত’’ লাভ। ৮। জালেম ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি। ৯। হযরত ইদ্রীছ (আ.) এর পুনঃ জান্নাতে ফেরা। ১০। বিবি মরিয়ম (আ.)-এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আ.) এর পৃথিবীতে আগমন। ১১। হযরত নুহ (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মহাপ্লাবন হতে ম্ক্তু লাভ। ১২। হযরত ঈসা (আ.)-এর আকাশ গমন। ১৩। হযরত সোলাইমান (আ.)-এর পুনঃরাজত্ব লাভ। ১৪। হযরত আইয়োব (আ.)-এর রোগ মুক্তি ও পুনঃধন সম্পদ লাভ। ১৫। হযরত দাউদ (আ.)-এর হাতে জালিম বাদশা জালুত নিহত হয়। ১৬। হযরত দাউদ (আ.)-এর গুনাহ্ মাফ হয়। ১৭। হযরত্ ইয়াকুব (আ.) তার প্রিয় পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) কে ফিরে পান। ১৮। মাছের পেট হতে হযরত ইউনুস (আ.) মুক্তি লাভ। ১৯। আসমান হতে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা হয় এ দিনে। ২০। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত বরণ। ২১। এ দিনের কোন এক জুম্মাবারে ইস্রাফিলের সিংগার ফুঁৎকারে কেয়ামত সংগঠিত হবে। উপরোক্ত বহুল আলোচিত ঘটনাসমূহের মতো আরো অহরহ ঘটনা ঘটেছে মহররমের দশ তারিখ। এসব কারণেই এ মাস অতীব গুরুত্বের দাবী রাখে। সকল সংঘঠিত ঘটনাসমূহের মাঝে সব চেয়ে ব্যথাদায়ক ও বহুল আলোচিত ঘটনা হলো হযরত মুহাম্মদে আরবী (স.) এর প্রিয় দৌহিত্র শহীদ জননী ফাতেমাতুজ জোহরা (রা.) এর হৃদয়ের স্পন্দন, শেরে খোদা হযরত আলী মর্তুজা (রা.) এর নয়নের মনি বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতের বিপ্লবী ও সংগ্রামী চেতনার প্রতীক সাইয়াদুস শুহাদা হযরত ইমাম হোছাইন (রা.) এর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ। দজলা ও ফোরাতের তীরে কারবালা প্রান্তরে হিজরী ৬১ সনে কাতেবে ওহি হযরত আমীরে মোয়াবিয়ার অযোগ্য সন্তান জালিম এজিদের পাষন্ড সৈন্য-সামন্তরা খোদায়ী খিলাফতকে পদ তলে দিয়ে আহলে বাইয়্যাতের যোগ্য খিলাফতকে অস্বীকার করে রাজতন্ত্রের দম্ভ প্রদর্শন করে সাইয়্যাদিনা ইমাম হোছাইন সহ ৭২জনকে শাহাদাত বরণ করিয়ে দুনিয়ার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। কিন্তু কেন এবং কিভাবে এ ঘটনা সংগঠিত হয় তার কম বেশি দুনিয়াবাসীর অজানা নয়। আমরা সি দিকে যাব না। শুধু এটুকু বলার প্রয়াস পাব যা জরুরী মনে হয়। কুফায় গভর্নর হযরত আমীরে মোয়াবিয়ার ইন্তেকালের পর তার পুত্র এজিদ পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে নিজকে খলিফা বলে ঘোষণা দেয়। আহলে বাইয়্যাতদের কে সে তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়। অথচ শরীয়াহ মোতাবেক এজিদ কোন প্রকার ইসলামী খিলাফতের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই আহলে বাইয়্যাতগণ তার আনুগত্য স্বীকার করার মতো কোন ধরনের যৌক্তিকতা নেই বিধায় তাঁরা এজিদের নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করে। শুধু এ কারণেই হিজরী ৬১ সনের ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরের ব্যথাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হয়, আহলে বাইয়্যাতের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয় কারবালা প্রান্তর। এজিদি শক্তি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, সুকৌশলে ৭২ জন আহলে বাইয়্যাতের রক্ত ঝরায় নির্মমভাবে। দুনিয়ার বুকে সৃষ্টি করে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। হযরত ইমাম হোছাইন (রা.) এর শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনা অতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। আলোচনা পর্যালোচনা চলছেই। তা চলতে থাকবে প্রলয় দিবস অবধি। ঘটনার চুলচেড়া বিশ্লেষণ হচ্ছে। কিন্তু ঘটনার মূল কারণ কি সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষ খুব বেশি ওয়াকিফহাল নয়। ফলে মুসলিম বিশ্ব এ ঘটনার তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে যে শিক্ষা পাওয়ার কথা এবং শিক্ষার বিষয়কে মূল্যায়ন করার কথা তা করা হচ্ছেনা। অথচ এ দিনকে কেন্দ্র করে আমরা অনেক কিছু করে থাকি। যা করি তা শরীয়াহ্ সম্মত কিনা তার বাছ বিচার করা হয় না। বাস্তব সম্মত বিষয় হলো ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত ঐতিহাসিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার সামাজিক, রাজনৈতিক ও শরীয়াহ ভিত্তিক গুরুত্ব আছে। দেখার বিষয় হলো আমরা এর গুরুত্ব কতটুকু মূল্যায়ন করি এবং কি ভাবে মূল্যায়ন করি? আমরা যা করি তার মধ্য হতে অধিক আর করার কিছু আছে কিনা এবং যা করি তার মধ্য হতে বর্জনীয় কিছু আছে কিনা? তা জানা ও বুঝা সকলের জন্য অতিব জরুরী। এটা জানার পূর্বে আমরা দেখব যে, বিশ্বনবী (স.) এর আগমনের পূর্বে ও পরে মহররম পালন হতো কিনা? হলে কিভাবে হতো? বিশ্বনবী (স.) এর আগমন পূর্ব মহররম পালন: বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.)-এর আগমন পূর্ব যত নবী পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে আগমন করেছেন তারা এবং তাদের উম্মতগণ মহররম পালন করেছেন। তাঁরা ১০ মহররম (অসমাপ্ত)