॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৫। স্বাধীনতা, চলাচল, বসবাস, রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব লাভের অধিকার : মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককের রাষ্ট্রের যে কোন স্থানে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের অধিকার প্রদান করে। একইভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিেিত রাষ্ট্রের বাইরে যাওয়া ও অন্য রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারও প্রতিটি ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছিল। তাঁর রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে একটি ‘বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। রাসূল (সা.) এর রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্ব আল্লাহর রাজ্যস্বরূপ- যা তিনি সকল মানুষের চলাচল ও বসবাসের জন্যে অবারিত করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সমগ্র দেশ আল্লাহর আর মানুষ আল্লাহর বান্দা, তুমি যেখানে মঙ্গলজনক মনে কর বসবাস কর। “প্রাগুক্ত”। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত মানুষের জন্য বিশ্বের যে কোন স্থানে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের সর্বজনীন স্বাধীনতা ছিল।
রাসূল (সা.) প্রবর্তিত ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তিকে ‘ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে নাÑ এ শর্তে রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্বের অধিকার দেয়া হয়েছে। মক্কা থেকে হিজরতকারী মুহাজির জনগণকে মদীনায় আশ্রয় ও নাগরিকত্ব প্রদানসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। মুহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে ইসলামী রাষ্ট্র আশ্রয়প্রার্থীদের মৌলিক চাহিদা পূরণার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ করে তাদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়। “প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭২”।
৬। নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের অধিকার : শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোন ব্যক্তিকে শারীরিক-মানসিক শাস্তিদান বা তাকে কষ্ট দেয়াকে রাসূল (সা.) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “প্রকৃত মুসলমান হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার কথা বা হাত থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকবে। “খতীব আত তাববীয়ী, ওয়ালিউদ্দীন মুহাম্মদ, আল-মিশকাতুল মাসাবীহ, কলিকাতা : এম. বশির হাসান এ্যা- সন্স, তা. বি. খ. ১, পৃ. ১২”।
এমনকি এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত দৃঢ়তায় তিনি বলেছেনÑ “মনে রেখো! যদি কোন মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার উপর সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোন বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব।” “রহমান, মো. আতাউর, ইসলামী শ্রমনীতির রূপরেখা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, সংখ্যা ৪৬, জুন. ১৯৯৩, পৃ. ৪৩”।
৭। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিতকরণ : ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার অধিকার দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন- “অমুসলিমদের জীবন আমাদের জীবনের এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতোই। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকার ইসলাম স্বীকার করে। মদীনা সনদ অমুসলিমদের মদীনায় বসবাসের অধিকার দিয়েছিল। এমনকি, তাদের একটি অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও বাকী অংশের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়নি। ইসলাম একজন অমুসলিম শ্রমিককে একজন মুসলিম শ্রমিকের মতই সুযোগ-সুবিদা দেয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছেন, “সতর্ক থাক, সে ব্যক্তি সম্পর্কে যে ব্যক্তি অমুসলিমদের উপর জুলুম করে অথবা তাদের হক নষ্ট করে অথবা তাদের সামর্থ্যরে চাইতে বেশী কাজের বোঝা চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়, আমি কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব। “রহমান, মুহাম্মদ মতিউর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮”।
অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাস্যদের নিন্দাবাদ ও গালমন্দকে কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেনÑ “আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য দেব-দেবীর উপসানা যারা করে তাদের উপাস্যদের তোমরা গালি দিয়ো না। “আল-কুরআন, ৬ : ১০৮”।
৮। গণতান্ত্রিক অধিকারের গোড়াপত্তন : মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার, ন্যায়সঙ্গতভাবে সরকারের সমালোচনা করার অধিকার ইসলামে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া যায়। উমর রা. এর খিলাফতকালে খলীফা জুম্মার খুতবা মিম্বরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে এক মুসল্লী জানতে চাইলেন খলীফার জামা এত লম্বা হলো কীভাবে? কারণ বায়তুলমাল থেকে সকলকে যে কাপড় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা দিয়ে এতো লম্বা জামা বানানো যায় না। প্রশ্নকর্তা যখন জানলেন, খলীফার ছেলের ভাগে যে কাপড় পাওয়া গেছে সেটা খলীফাকে দেয়ার ফলেই তাঁর পক্ষে লম্বা জামা বানানো সম্ভব হয়েছে তখন প্রশ্নকর্তা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, হ্যাঁ এখন খুতবা শুরু করুন। আমরা শুনবো। খলীফা বললেন, যদি সন্তোষজনক জবাব না পেতে তাহলে কী করতে? তখন প্রশ্নকর্তা বললেন : তখন আমার এই তলোয়ার এর সমাধান দিতে! একথা শুনে খুশী হয়ে খলীফা বললেনÑ হে আল্লাহ্ ! যতদিন পর্যন্ত এরূপ সাচ্চা ঈমানদার বান্দা জীবিত থাকবে ততদিন ইসলাম ও মুসলমানের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। “রহমান, মুহম্মদ মতিউর, পৃ. ৩৬”।
৯। ন্যায়বিচার লাভের অধিকার : মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক-সামাজিক-পেশাগত মর্যাদা নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করে। মূলত ন্যায়বিচার ধারণার উপর ইসলামে এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, কুরআনে প্রায় ষাটটি আয়াতে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন একটি আয়াতে বলা হয়েছে “তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক এবং আল্লাহর জন্য ন্যায় সঙ্গত সাক্ষ্য দাও, তাতে যদি তোমাদের পিতা-মাতা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের ক্ষতি হয় তবুও। “আল-কুরআন, ৪ : ১৩৫”। রাসূল (সা.) প্রতিষ্ঠিত শাসনামলে ইসলামের বিচারব্যবস্থা যা শাসক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ মুক্ত, স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, তা ছিল মূলত রাসূল (সা.) এর মানবতাবোধ ও মানবাধিকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত। মনীষী বার্ক এ সম্পর্কে চমৎকারভাবে রাসূল (সা.) এর কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তাঁর ভাষায়Ñ ঞযব গঁযধসসবফধহ খধি রং নরহফরহম ঁঢ়ড়হ ধষষ, ভৎড়স ঃযব পৎড়হিবফ যবধফ ঃড় ঃযব সবধহবংঃ ংঁনলবপঃ. ওঃ রং ধ খধি রহঃবৎড়িাবহ রিঃয ধ ংুংঃবস ড়ভ ঃযব রিংবংঃ, ঃযব সড়ংঃ ষবধৎহবফ ধহফ সড়ংঃ বহষরমযঃবহবফ লঁৎরংঢ়ৎঁফবহপব ঃযধঃ যধং বাবৎ বীরংঃবফ রহ ঃযব ড়িৎষফ. সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ (সা.) : উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলোর পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজ ও মানবিকতার ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ সা. যে অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন তা মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এমন কতগুলো ক্ষেত্র এখানে আলোচনার দাবী রাখে।
১। শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.) এর বাস্তবমুখী পদক্ষেপ : কুরআনে আল্লাহ্ স্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, “আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্যে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি”। “আল-কুরআন, ২১ : ১০৭”। কুরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসূল (সা.)। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্য উদাহরণ রেখে গেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজো অদ্বিতীয় ও অনুকরণীয়। কেননা তিনি কেবল মুসলমানদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানব জাতির আদর্শ। আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেনÑ “বলুন, হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল। “আল-কুরআন, ৭ : ১৫৮”।
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব যিনি অতি শৈশবে বিস্ময়করভাবে সমবণ্টন নীতিতে তার দুধ মা হালিমার ঘরে দুধ মাতার একটি মাত্র স্তন পান করতেন আর একটি রেখে দিতেন হালিমার নিজের সন্তানের জন্যে। “কায়্যূম, অধ্যাপক হাসান আব্দুল, শান্তির দূত হযরত (সা.) সীরাত স্মরণিকা, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪১৫, পৃ. ৩৮”।
সমগ্র মক্কাবাসী যখন তাদের দ্বারা নির্যাতিত, বিতাড়িত, চরম প্রতিহিংসার শিকার মুহাম্মদ (সা.) এর হাতে চরম দন্ড পাওয়ার আশংকায় প্রহর গুণছিল, সেদিন শান্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) নিঃশর্ত ক্ষমা করে দয়া ও ক্ষমার অপার মহিমান্বিত ইতিহাস রচনা করেন। ঐতিহাসিক গিবনের ভাষায় বলা যায়Ñ ওহ ঃযব ষড়হম যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ ঃযবৎব রং হড় রহংঃধহপব ড়ভ সধহমহধসরঃু ধহফ ভড়ৎমরাবহবংং যিরপয পধহ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয ঃযড়ংব ড়ভ গঁযধসসধফ (ং) যিবহ ধষষ যরং বহবসরবং ষধু ধঃ যরং ভববঃ ধহফ যব ভড়ৎমধাব ঃযবস ড়হব ধহফ ধষষ. “প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০”।
২। দয়া, ক্ষমা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.) এর অনন্য পদক্ষেপ : মহানবী (সা.) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কোমল। দয়া, ক্ষমা, শান্তি ও সাম্যের প্রতিরূপ এই মহামানব স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, “যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ্ তাকে দয়া করেন না। “রহমান, শেখ ফজলুর, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) সীরাতুন্নবী (সা.) স্মরণীয়, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪০৭, পৃ, ১৮”। এখানে কেবল মুসলমানদের কথাই নয় বরং সমগ্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদীসে মহানবী (সা.) বলেন : “পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর। ঊর্ধ্বলোকে যারা আছেন তারাা তোমার প্রতি সদয় হবেন”। “রহমান, শেখ ফজলুর, প্রাগুক্ত পৃ. ১৯”। অন্যদিকে শ্রমিক, অধীনস্থ কর্মচারী ও চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বার বার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী (সা.) শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমন সব শ্রমনীতির প্রবর্তন করে গেছেন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রসংস্থা (আই.এল.ও) বিগত ১১৮ বছর ধরে মে দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। “হোসেন, মুহাম্মদ ফরহাদ, মে দিবস, শ্রমিক শ্রেণী এবং ইসলাম, দৈনিক যুগান্তর, ৩০ এপ্রিল, ২০০৪, পৃ. ১২”। (অসমাপ্ত)