নীতির প্রশ্নে কখনও আমি আপোস করি না – প্রধানমন্ত্রী

76

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গুজব ছড়ানোসহ নানা ঘটনায় গ্রেফতারদের মুক্তি চেয়ে বিদেশ থেকে আসা নানা বিবৃতিদাতাদেরকে তার রাজনীতির বিষয়টি মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার গণভবনে ছাত্রলীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনায় প্রসঙ্গটি তোলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, তিনি নীতির প্রশ্নে কখনও আপস করেন না এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ছাত্র হত্যা ও ছাত্রী ধর্ষণের গুজব ছড়ানো হয় পরিকল্পিতভাবে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এই গুজব ছড়িয়ে যে পরিস্থিতি তৈরির পরিকল্পনা ছিল তা অবশ্য সফল হয়নি।
এই গুজব ছড়ানোর ঘটনায় পাঁচ নারী, শিক্ষার্থীসহ বহুজন আটক হয়েছে। আটকদের মধ্যে আছেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।
এই আলোকচিত্রীর মুক্তির দাবি জানিয়ে বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি, নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন বিবৃতি দিয়েছেন। তবে তাদের চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্নি, যুক্তরাজ্যের আইন প্রণেতা টিউলিপ সিদ্দিকীর বিবৃতি। তিনিও শহিদুলের মুক্তি দাবি করেছেন। বলেছেন, কারও বিচার করতে হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে শিশুদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ‘ছোট্ট শিশুদের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তায় নেমেছে। শিশুদের যে ক্ষোভ, শিশুদের যে বিক্ষোভ, তাদের যে বিক্ষুব্ধ মন, সেটাকে কাজে লাগিয়ে, ওই শিশুদের ঘাড়ে পারা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য একদল নেমে পড়ল।’
‘তাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু জ্ঞানীগুণি, অনেকেই আঁতেল, অনেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। কিন্তু খ্যাতিসম্পন্নরা কী করেছেন? ডিজিটাল বাংলাদেশ আমি করেছি কিন্তু তারই সুযোগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে, বিভিন্ন জায়গায় অপপ্রচার চালানো, মিথ্যা কথা বলে বলে মানুষকে উস্কানি দেয়া হয়।’
‘তাদের এই উস্কানির কারণে কত শিশুর জীবন যেতে পারত, কত শিশুর ক্ষতি হতে পারত, সেটা তারা একবারও চিন্তা করেনি, বরং শিশুদের বিক্ষুব্ধ মনকে ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা লুটতে চেয়েছিল। আর তাদের বিরুদ্ধে যখনই ব্যবস্থা নিলাম, তখনই চারদিকে যেন হাহাকার।’
‘আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও বিভিন্ন চাপ। একটা কথা দেশে বিদেশে সকলের মাথায় রাখা উচিত। আমি যখন রাজনীতি করি, আমার স্কুল জীবন থেকে রাজনীতি করি। ৃআইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিল। আমাদের বইয়ে একটা চ্যাপ্টার ছিল, পাকিস্তানর চ্যাপ্টার, ২০ নম্বর। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম ওই ২০ নম্বর বাদ দিয়ে। কারণ, আইয়ুব খানের প্রশংসা আমার হাত দিয়ে আমি লেখব না। আমি লিখতে পারি না।’
‘আমি সেই মানুষ। ওই ২০ নম্বরের জন্য ফেলও করতে পারতাম বা থার্ড ডিভিশনও করতে পারতাম, কিন্তু আমি পরোয়া করিনি’- বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশ্যে বলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নীতির প্রশ্নে আপস নয়, এটাই হচ্ছে আমার কথা।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় বছর পর দেশে ফিরে দেখা পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম কী অবস্থা দেখেছি দেশের? যেখানে খুনিরা পুরস্কৃত, যুদ্ধাপরাধী; যাদের আমার বাবা বিচার করে সাজা দিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা, তারা ক্ষমতায়, এমন একটি পরিবেশ।’
‘প্রতিনিয়ত আঘাত, কখনও গ্রেনেড হামলা, কখনও গুলি, কখনও ট্রেনের ওপর আঘাত, কখনও নানা ধরনের, বিরাট বোমা পুঁতে রাখা, অনেক বাঁধা বিঘ্ন, আমি তো সেগুলো কখনও পরোয়া করিনি। কারণ, আমার আত্মবিশ্বাস যে, আমি যে পথে যাচ্ছি, ন্যয় ও সত্যের পথে যাচ্ছি। আমার রাজনীতি বাংলার জনগণের জন্য।’
‘যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য আমার বাবা তার জীবন দিয়ে গেছেন, আমার মা জীবন দিয়ে গেছেন, আমার ভাইরা জীবন দিয়ে গেছেন, সে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। সেটাই আমার একমাত্র রাজনীতি।’
প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁতের শাড়ি পাল্টাইনি
তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি আগেও যেমন ছিলেন, এখনও তেমনই আছেন। নিজেকে পরিবর্তন করতে চাননি।
‘প্রধানমন্ত্রী হলেই যে ওই ব্র্যান্ডের জিনিস পরতে হবে, আমার তাঁতের শাড়ি ফেলে ওই ফ্রেঞ্চ শিফন পরতে হবে, বা ওমুক মেকআপ লাগাতে হবে বা মাথায় পরচুলা বাড়াতে হবে, এগুলো নিয়ে তো চিন্তা করি না।’
‘আমার চিন্তা একটাই, মানুষের জন্য কতটা করতে পারলাম। কতটা দিতে পারলাম, মানুষের ভাগ্যটা কতটা পরিবর্তন করতে পারলাম।’
‘ওই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চেয়েছিলেন আমার বাবা, মহান ত্যাগ করেছিলেন আমার মা। সেই মানুষগুলোকে কী দিতে পারলাম?’
দেশে ফিরে গায়ে কাপড় ছাড়া বা ছেড়া কাপড় পরা, স্যান্ডেল ছাড়া, কঙ্কালসার দেহের মানুষের কথা তুলে ধরেন প্রধানরমন্ত্রী। বলেন, ‘সারি সারি কঙ্কালের মতো এসে দাঁড়িয়েছে। গেলেই বলেছে, মা পেটে ক্ষুধা।’
‘আমার প্রতিজ্ঞা ছিল যখনই এ দেশে ক্ষমতায় আসব, প্রথমেই এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। গৃহহারা মানুষকে ঘর দেব, চিকিৎসার ব্যবস্থা করব, শিক্ষার ব্যবস্থা করব। তাদের উন্নত জীবন দেব।’
‘আজকে যখন একেকটা ধাপ করে আমরা উঠি, যখন দেখি দারিদ্যের হার আমরা কমাতে পেরেছি, এখন একটা মানুষের গ্রামের দিকেও গেলে দেখি পায়ে রাবারের চপ্পল আছে, এখন অন্তত আমার মা বোনদের গায়ে কাপড় আছে। বিদেশ থেকে পুরনো কাপড় এনে এ দেশের মানুষকে পরাতে হতো। এখন আর সেটা পরাতে হয় না।’
‘গৃহহারা মানুষকে ঘরবাড়ি করে দিচ্ছি, তারপরও হিসাব নিচ্ছি একটা মানুষও গৃহহারা আছে কি না।’
‘শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি, উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমরা এখন বৃত্তি দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী শিক্ষা, ডিজিটাল বাংলাদেশ আজকে বাস্তব, সমগ্র বাংলাদেশে আজকে ইন্টারনেট সার্ভিস। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ আজকে ডিজিটাল সার্ভিস থেকে মানুষ পাচ্ছে।’
‘আমরা স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছি, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট করছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশকে আমরা সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদি ত্যাগের মনোভাব না থাকত, যদি কেবল নিজের কথা চিন্তা করতাম, নিজেকে কীভাবে সাজাব, তাই নিয়ে চিন্তা করতাম, তাহলে দেশের মানুষের ভালো করতে পারতাম না। দেশের মানুষকে কীভাবে সুন্দরভাবে বাঁচতে দেব, এটাই আমার একমাত্র চিন্তা।’