কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাহে রমজানের আজ ১৯তম দিবস। আগামীকাল থেকে মুমিন মুসলমানরা সাধনার আরেক ধাপে অবতীর্ণ হবেন, শুরু হবে পবিত্র ইতেকাফের অনুশীলন। কোরান নাজিলের দশকে মনোযোগী হবেন অধিক পরিমাণে তিলাওয়াত ও তাফসির অধ্যয়নে। আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরার দারস নিয়ে আমাদের সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ। মানবজাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুক্তির জন্য ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর আগে যখন ইসলাম ধর্ম দুনিয়ার মজলুম মানুষের সামনে জীবন ও সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয় তখন পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের (আঃ) আগমনী ক্রমধারার আলোকে হোক কিংবা সভ্যতাসমূহের বিবর্তনের আলোকে হোক- যেভাবে আপনি ইতিহাস পর্যালোচনা করুন, দেখবেন মানুষ তখন চরমভাবে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। এমতাবস্থায় ইসলাম ধর্ম মানুষকে নতুনভাবে জীবন উপলব্ধিতে হাতছানি দেয়। জগতবাসীর সামনে তুলে ধরা হয় এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের অপর প্রান্তের এক অনন্ত অসীম জীবনের পরিচয়। তা হলো আখিরাত।
কোরানের ১১৪টি সূরার মধ্যে সূরাতুল আসর ক্ষুদ্রতম ১টি সূরা। এখানে মেহেরবান আল্লাহ তাবৎ দুনিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে চার প্রকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষকে সফলকাম বা নাজাতপ্রাপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন। সূরা আসর মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিল ইসলাম ধর্মের সূচনা পর্বে। একবার হযরত আবু বকর (রাদিঃ) তাঁর পুরনো বন্ধু কাতাদাহর সঙ্গে বসে আহার করছিলেন। কথা প্রসঙ্গে কাতাদাহ বললেন, আপনি দক্ষতা সহকারে ব্যবসা করে লাভবান হয়েছেন। বর্তমান পৌত্রিক ধর্ম ছেড়ে মহাক্ষতিগ্রস্ত হলেন। উত্তরে হযরত আবু বকর (রাদিঃ) বললেন, প্রকৃত লাভ-ক্ষতি ওখানে নয়, বরং ঈমান এবং সৎপথ অবলম্বনের মধ্যে। তখন পূর্ণাঙ্গ ধারণা ও ব্যাখ্যা স্বরূপ আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল ফেরেস্তার (আঃ) মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ওপর সূরা আসর নাজিল করেন।
সূরা আসরের অনুবাদ : এক. সময়ের কসম। দুই. নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তিন. কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাগিদ করে সত্যের এবং তাগিদ করে সবরের।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হিসন (রাদিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহর সাহাবীদের মধ্যে দু’জন একজন অন্যজনকে সূরা আসর পাঠ করে না শুনানো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হতেন না (তিবরানী,মাআরিফ)।
সূরা আসর কোরান শরিফের এমন একটি অর্থপূর্ণ সূরা যে, ইমাম শাফেয়ী’র ভাষায় মানুষ এ সূরাটিকে চিন্তাভাবনা করে পাঠ করলে তাদের ইহকাল ও পরকালের সংশোধনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা যুগের শপথ করে বলেছেন যে, মানবজাতি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এবং এই ক্ষতির কবল থেকে কেবল তারাই মুক্ত, যারা চারটি বিষয় নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে- ইমান, সৎকর্ম, অপরকে সত্যের উপদেশ এবং সবরের উপদেশ দান। দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং মহা উপকার লাভ করার চার বিষয় সম্বলিত এ ব্যবস্থাপত্রের প্রথম দু’টি বিষয় আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় দু’টি বিষয় মুসলমানদের হেদায়াত ও সংশোধন সম্পর্কিত।
এখন প্রশ্ন হলো ঈমান কি? ইমান হলো কোন একটি ব্যাপারে অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে প্রতিফলন ঘটানো। আল্লাহ লা-শরিকের ওপর পূর্ণ ভক্তি ও শ্রদ্ধা, হুজুর (সঃ) ও অন্যান্য নবী-রাসূলগণ, আল্লাহর কিতাবসমূহ, ফেরেস্তাকূল, পরকাল, তকদির, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা এবং ভক্তি পোষণ করা।
এবার প্রশ্ন ‘সৎকর্ম’ বলতে কি বুঝায়? সৎকর্ম বলতে এগুলোকেই বুঝায় যা ইসলাম-সিদ্ধ, নিজের জন্য যা কল্যাণ বয়ে আনে এবং অপরের জন্যও। নিজের জন্য কল্যাণকর কিন্তু অন্যের জন্য অকল্যাণকর এমন কাজ সৎকর্ম নয়, সবচেয়ে বড় সৎকর্মের তালিকায় রয়েছে- নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত, জনসেবা।
সর্বশেষে সত্য এবং ধৈর্যের উপদেশ। এখন এ দু’টি শব্দের কয়েক রকম অর্থ হতে পারে। এক. সত্যের অর্থ বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও সৎকর্মের সমষ্টি। আর সবরের অর্থ যাবতীয় গুনাহের কাছ থেকে দূরে থাকা। অতএব প্রথম শব্দের সারমর্ম হলো- আমর বিল মারুফ তথা সৎ কাজের আদেশ করা এবং দ্বিতীয় কাজের সারমর্ম হলো ‘নাহি আনিল মুনকার’ অর্থাৎ সব মন্দ কাজে নিষেধ করা। এখন সমষ্টির সারমর্ম দাঁড়ালো যে, নিজে যে ঈমান ও সৎকর্ম অবলম্বন করেছেন অপরকেও তার উপদেশ দেয়া। দুই. সত্যের অর্থ বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং সবরের অর্থ সৎকাজ করা, মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। কেননা সবরের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাধা দেয়া ও অনুবর্তী করা। এ অনুবর্তী করার মধ্যে সৎকর্ম সম্পাদন ও গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা উভয়ই শামিল। সাহাবী ইবনে মাসউদ (রাদিঃ) মহানবী (সঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সত্যনিষ্ঠা সততার পথ দেখায়। আর সততা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ সত্যের অনুসরণ করতে করতে অবশেষে আল্লাহর নিকট ‘সিদ্দীক’ (সত্যনিষ্ঠ) নামে অভিহিত হয় (বুখারী, মুসলিম)। সূরা আল ইমরানে সবর সম্পর্কে বলা হয়েছে, হে ইমানদারগণ! তোমরা সবর কর এবং সবরের প্রতিযোগিতা কর, মোটকথা: এ সূরায় মুসলমানদের প্রতি একটি বড় নির্দেশ এই যে, নিজেকে কোরান ও সুন্নাহর অনুসারী করে নেয়া যতটুক গুরুত্বপূর্ণ, জরুরী ততটুকু জরুরী অন্য মুসলমানকেও ইমান ও সৎকর্মের প্রতি আহ্বান করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।