আল-হেলাল সুনামগঞ্জ থেকে :
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের পেরুয়া গ্রামে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বহুল আলোচিত পেরুয়া-শ্যামারচর গণহত্যার এলাকা ৩ দফা তদন্ত শেষে এবার পরিদর্শন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মাসুম ও রিজিয়া সুলতানা। ২২ এপ্রিল রবিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা নুর হোসেনসহ সংস্থার ৯ সদস্যের একটি তদন্ত দল ১৯৭১ সালে দিরাইয়ের শ্যামারচর গণহত্যাস্থল পরির্দশন করেন। এ সময় উপজেলার পেরুয়া-শ্যামারচর এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলেন তারা। পরে সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তারা। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মাসুম বলেন,খুব শীঘ্রই সুনামগঞ্জের পেরুয়া-শ্যামারচর গণগত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা এখন এসেছি কোন নিরপরাধ লোক যেন হয়রানির শিকার না হয় সে জন্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার পেরুয়া-শ্যামারচর গণহত্যার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। তৃতীয় বার তদন্তকারী দল দিরাইয়ের শ্যামারচর এলাকা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এই মামলার তদন্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে সঠিক অপরাধীদের চিহ্নিত করতে আমরা দৌলতপুর, পেরুয়া, দাউদপুর, শ্যামারচর ও উজানীগাঁও এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে কথা বলেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ,স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলেও সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। যারা দেশের মুক্তিকামী মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রকৃত হত্যাকান্ড উদঘাটন করে জড়িতদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর সময় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় পাকহায়নারা ও তাদের সহযোগী বাঙ্গালী দালালরা যেসব বর্বরোচিত কয়েকটি হত্যাকান্ড সংগঠিত করেছিল এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পেরুয়া-শ্যামারচর গণহত্যা। এখানে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর শতাধিক নারীকে ধর্ষন ও ৬০-৭০ জন নিরীহ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়। কয়েক শত বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হয়। দিরাই থানা ও হাসপাতাল সংলগ্ন স্থানটি ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর রাজাকারদের ক্যাম্প। এখানেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এলাকার রাজাকারদের সহযোগীতায় নিরীহ মানুষদেরকে এনে অত্যাচার করতো। শ্যামারচরের পাশে এলংজুড়ির টর্চারসেল হিসাবে পরিচিত জলদারপুতায় ও শাল্লা উপজেলা সদরের যেখানে ১৯৭১ সালে আর্মিক্যাম্প ছিল (হিন্দু সম্প্রদায়ের আখড়া) এবং রাজাকার ক্যাম্প ছিল (বর্তমান শাল্লা থানা) তদন্তের স্বার্থে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তদন্তস্থল। তদন্তকালে প্রত্যেক্ষদর্শী ও এই এলাকার বীরাঙ্গনাদের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারা। আরো জানা যায়,রাজাকারদের তালিকা তৈরী ও গ্রাম ভিত্তিক রাজাকারদের তালিকা তৈরী করার জন্য ইউনিয়ন কমান্ডারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর শ্যামারচর-পেরুয়া হত্যাকান্ডের ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আতাউর রহমান ও রজনী কান্ত রাজাকাদের বিরুদ্ধে ৭২ সালে দালাল আইনে মামলা করেন। মামলা দেওয়ার পর অপরাধীদের বিরুদ্ধে গত বছরের প্রথম বার ২০১৬ইং সনের ১ ও ২জুন, দ্বিতীয় দফায় ২০- ২২ অক্টোবর ও তৃতীয় দফায় গত বছরের ১৪ নভেম্বর তদন্ত করেছেন ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাগণ। তারা তখনকার সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলেন। এ সময় কয়েকজন বীরাঙ্গনার কথাও উঠে আসে। স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, অনেকেই নিজেদের লজ্জায় সামনে আসেননি। সেই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ হলেও এখনো সেই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা বেঁেচ থাকায় ও প্রভাবশালী হওয়ায় এবং কেউ কেউ স্বাধীনতার পর বর্তমানে শক্ত অবস্থানে থাকার কারনে মুখ খোলতে সাহস পায় না অনেকেই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্যামারচর-পেরুয়া হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বর্তমানে যারা জীবিত রাজাকাররা রয়েছে তারা যেন কোনভাবেই ছাড় না পায় তাদের কঠিন শাস্তির দাবী জানাই। দৌলতপুর,পেরুয়া,শ্যামারচর ও উজানীগাঁও এলাকাবাসীর সাথে কথা বললে তারা জানান, দিরাই উপজেলার পেরুয়া-শ্যামারচর গণহত্যা একটি জঘন্যতম ঘটনা। এই গণহত্যার কথা শুনলে গাঁ শিউড়ে উঠে। এই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্যাতনের শিকার নারী-পুরুষ ও এই এলাকার অনেক বীরাঙ্গনা এখনো জীবিত রয়েছে। আমরা এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত বর্তমানে যারা জীবিত রয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানাই।