কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার আনা হচ্ছে। প্রার্থীর মনোনয়ন দাখিল ও যাচাই-বাছাই, ভোট গণনা, ফল প্রকাশ ও ভোটগ্রহণ এবং এসব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবল ও নির্বাচনের কাজে ব্যবহৃত তথ্যপ্রযুক্তিসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজে এসব সংস্কার আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় এত দিন ধরে চলে আসা গতানুগতিক রীতিনীতি থাকবে না। নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল হবে।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নির্বাচনে ‘অবাধ প্রযুক্তি’র প্রয়োগ হবে। বদলে যাবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ। এমনকি নির্বাচনকে ঘিরে যেসব অভিযোগ ওঠে সেগুলোও শূন্যের কোঠায় নামবে। এ পরিবর্তনের ফলে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরপেক্ষতাও রক্ষা হবে। দূরে বসেও সংসদীয় ৩০০ আসনের তাৎক্ষণিক ভোটগ্রহণের চিত্র প্রত্যক্ষ করা যাবে। সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে নির্বাচনের কার্যক্রমে গতিশীলতা ফিরবে। একইভাবে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে যে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠে, এই ব্যবস্থা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। এসব সংস্কারের মধ্যে রয়েছে পোলিং পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট, ক্যান্ডিডেট নমিনেশন প্রসেস অ্যান্ড ক্যান্ডিডেট সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট, অবজারভার ম্যানেজমেন্ট, পোল মনিটরিং রিস্ক অ্যানালাইসিস, সেন্টার ওয়াইজ রেজাল্ট কালেকশান অ্যান্ড রেজাল্ট ম্যানেজমেন্ট ও জিআইএস (জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম) অ্যাপলিকেশন ফর পোলিং সেন্টার লোকেশন ও নির্বাচনের ফল।
একইভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক অফিস ব্যবস্থাপনার চার ধাপেও পরিবর্তন আসছে। ধাপগুলো হলো হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজমেন্ট, অ্যানোয়াল কনফিডেন্সসিয়াল রিপোর্ট (এসিআর) ম্যানেজমেন্ট, লিগ্যাল বা কেস ম্যানেজমেন্ট ও ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্ট।
ইসি সূত্র মতে, নতুন এ নির্বাচন পরিচালনা পদ্ধতি চালু করতে ইসিকে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ছয় ও অফিস ব্যবস্থাপনায় চার ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এর সঙ্গে সংযুক্ত হবে অত্যাধুনিক হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার। এ দুটিতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে অর্ধকোটি টাকা। পাশাপাশি পদ্ধতিগত এই সংস্কারের কাজটি যথাযথ প্রয়োগ করতে সময় লাগবে ৪৬ সপ্তাহ; যা কয়েকটি ধাপে পাবে চূড়ান্ত রূপ। এর পেছনে কমিশনের ব্যয় হবে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ৪৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং অফিস ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ফেরাতে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ সংক্রান্ত কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক ও নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্বাচন কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও স্বচ্ছ করতে আমরা এ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। এ বিষয়ে আমার নেতৃত্বে যে কমিটি রয়েছে সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই পদ্ধতিটি নির্বাচনে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা কমিশন সভায় উপস্থাপন করা হবে এবং তাদের অনুমোদনসাপেক্ষে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কাজ শুরু করব।
এই নির্বাচন কমিশনার আরো বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার করতে চাচ্ছি নির্বাচনে স্বচ্ছতা ফেরার জন্য। তবে নির্বাচনে যে ধরনের প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেটা নিয়েই আমরা কাজ করছি। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনী ফল এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সরাসরি ইসি সচিবালয় এবং রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাতে পারবেন। পাশাপাশি ম্যানুয়ালি পদ্ধতিতেও তথ্য পাঠাতে পারবেন। দুটির তথ্য সমন্বয় করে ফল প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ৩০০ সংসদীয় আসনের তথ্যও তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ করা যাবে বলে জানান সাবেক সেনা কর্মকর্তা এই নির্বাচন কমিশনার।
সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যপত্রের তথ্য মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ পদ্ধতি সহজ এবং ফল দ্রুততার সঙ্গে একত্রিত করার লক্ষ্যে ইসির মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য একটি ‘ট্যাব’ সরবরাহ করবে কমিশন। এটি এসএমএসের মাধ্যমে ভোট কেন্দ্রের তথ্য প্রেরণ, ভোট কেন্দ্রের ফল প্রেরণ, ভোটগ্রহণ চলাকালীন সরাসরি ভিডিও, ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় তথ্য সংগ্রহ, মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন সার্ভিস ও মৃত ভোটার ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ে ভূমিকা রাখবে। যান্ত্রিক এই যন্ত্রটির সহায়তায় ভোটের ফলের তথ্যটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে আপলোডসাপেক্ষে কমিশন তাৎক্ষণিক কেন্দ্রওয়ারি ফলটি দেখতে পাবেন। পরে ম্যানুয়াল এবং ডিজিটাল নির্বাচনের ফল মিলিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হবে।
জানা গেছে, পোর্টালের মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠান থেকে সম্ভাব্য ভোট কর্মকর্তাদের আগাম তথ্য সংগ্রহ করা হবে। পরে সংরক্ষিত ডাটাবেজ থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করে দলবাজদের বাদ দিয়ে নিয়োগ করা হবে নিরপেক্ষ ভোট কর্মকর্তা। কারণ নির্বাচনে ভোট কর্মকর্তা নিয়োগ এবং ভোট কেন্দ্র চিহ্নিতকরণকে সংবেদনশীল কাজ বলে মনে করছে ইসি। তাদের নিয়োগে যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং স্বচ্ছ হয় তার জন্য প্রযুক্তির এই ব্যবহার হবে; এটাকে সাংবিধানিক সংস্থার ভাষায় ভোট কর্মকর্তা নিয়োগ এবং ভোট কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা।
এছাড়া প্রযুক্তির সহায়তায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের তথ্য অনলাইনে সংগ্রহ করা অর্থাৎ প্রার্থীরা একটি নির্দিষ্ট পোর্টালে তার মনোনয়নপত্র জমা দেবে। এতে করে মনোনয়নপত্র বাছাইসহ অন্যান্য কাজ নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা যাবে। কমিশনের ভাষায় এই প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে অনলাইন মনোনয়নপত্র জমা এবং প্রার্থী ব্যবস্থাপনা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং রিপোর্টিংয়ের সহায়তায় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে তাদের আবেদন গ্রহণ, তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং তথ্য সরবরাহ করা। এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্র প্রদান ও তাদের প্রতিবেদন সংগ্রহ সহজ হবে।
বর্তমানে নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কয়েক জন কর্মকর্তার সমন্বয়ের একটি টিম কাজ করে। তারা নির্দিষ্ট এলাকার অন্তর্ভুক্ত সব প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এমনকি তারা ভোট শুরুর পর প্রতি ঘণ্টায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোনে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, যা সময়সাপেক্ষ। এছাড়া এই প্রক্রিয়ায় নেয়া তথ্য নিয়ে পরবর্তীতে বিভ্রান্ত তৈরি হয়। তাছাড়া এসব তথ্যের কোনো ডাটাবেজ তৈরি হয় না। ফলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংগৃহীত প্রতিবেদন নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করতে পারে না কমিশন।
এছাড়া আগামী নির্বাচনে প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে প্রিসাইডিং অফিসাররা ইসির নির্ধারিত শর্ট কোডে খুদে বার্তার মাধ্যমে কেন্দ্রের অবস্থান জানাতে পারবেন। ইসির সার্ভারে কর্মকর্তাদের পাঠানো খুদে বার্তা সংরক্ষণ থাকবে এবং প্রোগ্রামের মাধ্যমে কোডগুলোকে ডি-কোড করে প্রদর্শন করা যাবে, এই পদ্ধতিকে পোল মনিটরিং এবং রিস্ক অ্যানালাইসিস বলছে কমিশন। আর কেন্দ্রওয়ারি নির্বাচনের ফল সংগ্রহ এবং ফল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দৃশ্যমান করতে বিদ্যমান সফটওয়্যারকে উন্নীত (আপডেট) করা এবং ফল সংগ্রহের জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে ট্যাব সরবরাহ করা। এর সহায়তায় তাৎক্ষণিক ফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার মাধ্যমে দূরে বসে নির্বাচনের ফল প্রত্যক্ষ করতে পারবে সাংবিধানিক সংস্থার শীর্ষব্যক্তিরা।
একইভাবে সংসদীয় ৩০০ আসনের ভোটগ্রহণ পদ্ধতিকে ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করতে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমে (এআরসিজিআইএস) পদ্ধতির সফটওয়্যার উন্নীত করা হচ্ছে। এআরসিজিআইএসের ওয়েব ভার্সনের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনী এলাকাকে দেখানো সম্ভব। এমনকি ভোট কেন্দ্রের ফল, ভোট চলাকালীন কেন্দ্রের অবস্থা ম্যাপে প্রদর্শনের জন্য কেন্দ্রের লংজিটিউট এবং ল্যাটিটিউট সংগ্রহ করে জিইও-স্পাটাইল ডাটাবেজে সংযোজন করা।
আর অফিস ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ফেরাতে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্য ও ছবি নিয়ে ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা। তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য কার্যক্রম তদারিক কমিশন সচিবালয়ে বসে অবলোকন করতে হিউম্যান রির্সোস এবং প্যারোল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা।
সূত্র আরো জানায়, নির্বাচনী কার্যক্রম বা প্রক্রিয়ায় কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি লিগ্যাল ইস্যু ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালুর মাধ্যমে যেকোনো অংশীজন আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। এছাড়া ইসি সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের দফতরগুলোর স্থায়ী এবং অস্থায়ী সম্পদগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাতে স্বচ্ছতা ফেরাতে ইনভেনটরি অ্যান্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সহায়ক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।