আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…..

96

জেড.এম. শামসুল :
বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় রূপান্তরিত করতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ অব্যাহত আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন অতিবাহিত হওয়ার প্রাক্কালে বাংলাভাষা বিরোধী চক্র নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। বাঙালি ছাত্রজনতা বসে থাকেনি। শহর থেকে শহরাঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বাঙালি জাতি। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় সকল বাঙালি
ঐক্যবদ্ধ। বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠায় চতুর পাকিস্তানীরা নানা ছলচাতুরী শুরু করে। ১৯৪৯ সালের এই দিনে (৭ ফেব্র“য়ারী) পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাকিস্তানী শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের এক বৈঠকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পরই বাঙালি জাতি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা প্রবর্তনের আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২৪ ফেব্র“য়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা মস্তফা নূরউল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলার পরিবর্তে আরবী বর্ণমালা প্রবর্তনের প্রতিবাদ সহ শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা প্রত্যাহার করার আহবান জানান। এদিনই নজরুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, ইলা দাসগুপ্ত, নূরুল ইসলাম, মমতাজ বেগম, রিজিয়া সিদ্দিকী, খলিলুর রহমান সহ অনেককে নিয়ে একটি বর্ণমালা সাব কমিটি গঠিত হয়। এ বছরের ৫ মার্চ ফজলুল হক হলের ছাত্র মিলনায়তনে তমদ্দুন মজলিসের এক সভা প্রিন্সিপাল আব্দুর রহমান খানের সভাপতিত্বে সভায় শিক্ষা উপদেষ্টার ঘোষণা আরবী হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে বাংলা ভাষার হরফ নির্ধারণের ভার বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে দেয়ার দাবী উত্থাপন করেন। এ সভায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক শাহেদ আলী সহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এ বছরের ১২ মার্চ ঢাকার রাজপথে ছাত্রছাত্রীদের এক বিশাল মিছিল পরিষদ ভবনের নীচে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং আরবী হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তনের বিরোধী শ্লোগান দেয়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবী করে। এ সময় পুলিশ বাঁধা দিলে পুুলিশী বাঁধা অতিক্রম করে মিছিল করতে থাকলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আফজাল হোসেন, মৃণাল কান্তি, বাহা উদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনছারী খান, আব্দুস সালাম, একেএম মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। এ গ্রেফতারের পরই ছাত্র জনতার মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। আন্দোলন তীব্রতর করার লক্ষ্যে এ বছরের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি বাস্তবায়নের চুক্তি বাস্তবায়ন ও আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রতিবাদ জানান। উল্লেখ্য ভাষা বিরোধী চক্রের সাথে বাংলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্পাদিত ৮ দফা চুক্তিপত্রের মধ্যে ছিল (১) ২৯ ফেব্র“য়ারী ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদেরকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হবে। (২) পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করবেন। (৩) ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারী আলোচনার জন্য যেদিন নির্ধারিত হয়েছে, সেদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং তাতে পাকিস্তান গণপরিষদ ও কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দ্দু সমপর্যায় দানের একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। (৪) এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এ মর্মে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে যে, এদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজী উঠে যাওয়ার পরই বাংলা তার স্থানে সরকারী ভাষা রূপে স্বীকৃত হবে। এছাড়া শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, তবে সাধারণভাবে স্কুল কলেজগুলোতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হবে। (৫) আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। (৬) সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। (৭) ২৯ ফেব্র“য়ারী থেকে পূর্ব বাংলায় যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্যে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে, সেখান থেকে তা প্রত্যাহার করতে হবে। (৮) সংগ্রাম পরিষদ’র সাথে আলোচনার পর আমি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি যে এ আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি। এ চুক্তিপত্রের একদিকে সরকারের পক্ষে পূর্ব পাাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং অপর পক্ষে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’র নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেন। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের পর একটি ঘোষণার দায়িত্ব পালন করেন ভাষা আন্দোলনের মূল হোতা অধ্যাপক আব্দুল কাসেম, তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিকটবর্তী শহীদ মিনারের পিছনের মাঠে ছাত্রজনতার এক বিশাল সমাবেশে চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর সংগ্রাম পরিষদ’র নেতৃবৃন্দ জেলখানায় গিয়ে চুক্তি বিষয়ক আলোচনা করেন সংগ্রাম পরিষদ নেতা শামছুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। জেল গেটে সেদিন মুজিবুর রহমান বলেছিলেন এসব চুক্তি আমরা অনুমোদন করেছি।