মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)র তদন্তে ৮ বছর পর চাঞ্চল্যকর জলাল হত্যার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। সংঘবদ্ধ গাছ চোরচক্রকে আড়াল করতেই এই হত্যার নাটক সাজিয়েছে।
নিহত জালালের আপন দু’ ভাই মকজ্জিল ও মকদ্দিছ প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য এই হত্যা মামলার পরিকল্পনা করে। তাদের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে স্থানীয় কয়েকজন কারাবাসও করতে হয়েছে।
চতুর্থবার তদন্ত প্রতিবেদনে মামলার বাদী নিহত জলালের আপন বড় ভাই মকজ্জিল আলী আদালতে না রাজির প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন পর পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে এই হত্যার মূল রহস্য।
রবিবার ৪ ফেব্র“য়ারি দুপুরে মৌলভীবাজার পিবিআই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন প্রেস ব্রিফিংয়ে লিখিতভাবে এতথ্য জানান।
তিনি জানান, কুলাউড়া উপজেলার কেওলাকান্দি বিলের পাড় এলাকার আরজু মিয়ার পুত্র মকজ্জিল আলী (৩৫) ২০১০ সালের ১১ মে কুলাউড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলায় উল্লেখ করেন, ১০ মে রাত থেকে তার ছোট ভাই ভিকটিম জলাল (২০) বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজ করার একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার আরেক ভাই ময়না মিয়া গরু চরাতে গিয়ে তাদের বাড়ির পশ্চিম পাশের টিলার ঢালুতে জালালের মরদেহ লাশ দেখতে পায়। ওই ঘটনায় নিহত জলালের বন্ধু জাবের (২২), পংখী (২৩), মীর (৩৫), শাহিদ (৫৫), রেমান (৬০), মসুদ (৪৫) সহ সন্দেহভাজনদের আসামী করে কুলাউড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, তার মামাতো বোন রোকেয়ার বাড়িতে ভিকটিমসহ আসামীদের যাতায়াত থাকায় পূর্বশত্র“তার জের ধরে ওই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে।
মামলার তদন্তকারী এসআই মো. শফিকুল ইসলাম মামলাটি ১৪ মাস তদন্ত করে কোন তথ্য উদঘাটন করতে না পেরে চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করেন।
বাদীর নারাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে একে একে কুলাউড়া থানার তৎকালিন ওসি আজিজুর রহমান, ওসি মো. সেলিম নেওয়াজ ও সিআইডির উপর ন্যস্ত হয়।
সর্বশেষ সিআইডির চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে বাদী আবারও নারাজী আবেদন করলে আদালত মামলাটির তদন্তের জন্য পিবিআই পুলিশকে নির্দেশ দেয়।
মৌলভীবাজার পিবিআই পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম মামলাটি তদন্তে জানতে পারেন বাদী মকজ্জিল আলীসহ একটি গাছ চোর চক্র এই ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে এই পরিকল্পনা করেন।
প্রাপ্ততথ্য ভিত্তিতে ৩১ জানুয়ারী ২০১৮ তারিখে ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কুলাউড়া থানার কেওলা কান্দি বিলের পাড়ের আরজু মিয়ার ছেলে আজাদ মিয়া, ইদ্রিস কোম্পানির ছেলে আহাদ মিয়া,মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে ছৈয়ব আলীকে গ্রেফতার করেন।
গ্রেফতারকৃতদের তথ্যের ভিত্তিতে এই মামলার বাদী মো. মকজ্জিল আলীকেও গ্রেফতার করা হয়।
হত্যার ঘটনাস্থলও চিহ্নিতকরনসহ ঘটনায় ব্যবহৃত ঠেলাগাড়ি ও গাছ কাটার করাতও উদ্ধার করা হয়। মামলার বাদী মো. মকজ্জিল আলীসহ গ্রেফতারকৃত আজাদ, আহাদ, ছৈয়ব আলী এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে।
পিবিআইর তদন্তে ২০১০ সালের ১০ মে রাত ১২টার দিকে রোশন ও আজাদের দুটি ঠেলাগাড়িসহ আজাদ, ছৈয়ব আলী, ভিকটিম জলাল, মকদ্দিছ, রোশন এবং মকজ্জিল চাতলাপুর বাগানের ১০ নম্বর সেকশনে যায়।
সেখানে যাওয়ার পর হরিধন ও মাখন চৌকিদার এর সহায়তায় তারা একটি কড়ই গাছ কাটে। গাছটিকে কয়েক টুকরো করে। গাছের টুকরো গুলো আজাদ ও রোশনের ঠেলাগাড়িতে উঠায়। আজাদের ঠেলাতে ছৈয়ব আলী, নিহত জলাল, আজাদ ও আহাদ ধরে। রোশনের ঠেলাতে মকদ্দিছ, রোশন ও বাদী মো. মকজ্জিল আলী ধরে।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঠেলা চালিয়ে চাতলাপুর রাবার বাগানের কাঁচা রাস্তায় মোকামের আম গাছের ঢালুতে আসলে আজাদের ঠেলার এক্সেল ভেঙ্গে কাটা গাছের অংশ জলালের উপর পড়ে যায়। তখন সকলেই জলালের উপর হতে গাছের অংশগুলো সরায়।
এতে জলাল ঘটনাস্থলেই তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আহত হয়। এই ঘটনার পর প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মো. মকজ্জিল আলী ও মকদ্দিছ জলালকে সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে আসার পরই জলাল মারা যায়।
এই ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মকজ্জিল আলী ও তার ভাই মকদ্দিছ ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে জলালের লাশ তাদের বাড়ির পিছনে টিলার ঢালুতে রাখে। এছাড়া জলাল গুরুতর আহত হওয়ার পরেও চোরাইকৃত গাছের লোভ সামলাতে না পেরে ভিকটিমকে চিকিৎসা না দিয়ে আসামী আজাদ, ছৈয়ব আলী, রোশন ও আহাদ মিলে রোশনের ঠেলাগাড়ি দিয়ে কাটা গাছের অংশ কছমলি পার এলাকায় খালিকের বাড়িতে এবং অন্যগুলো হাজীপুর স-মিলে নিয়ে আসে।
পরদিন লাশের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। পংখী, জাবের, মীর, জলিল, রেমান, শাহিদ, মসুদ মিয়াসহ জনৈক প্রবাসীর স্ত্রী রোকেয়ার বাড়িতে জলালের যাতায়াত নিয়ে অন্তকোন্দলের বিষয়টি উল্লেখ করে বাদী মো.মকজ্জিল আলী নিহত জলাল হত্যায় সন্দেহভাজনদের আসামী করে মামলা করলে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে।
তারা দীর্ঘদিন কারাভোগ করে বর্তমানে উচ্চ আদালত হতে জামিনে আছেন। এই সাজানো ঘটনার পর থেকে রোকেয়ার প্রবাসী স্বামী দেশে এসে রোকেয়ার সাথে কোন যোগাযোগ না করে অন্যত্র বিবাহ করে।
মামলাটির থানা পুলিশের নিকট তদন্তের পর্যায়ে রোকেয়ার বাড়ি সংলগ্ন আকমল আলীকে বাদী মকজ্জিল আলী মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে তাকে প্রত্যক্ষ সাক্ষী সাজিয়ে আদালতে একটি এফিডেভিট দায়ের করে।
একইভাবে আকমল আলীর স্ত্রী শাহানাকেও প্রত্যক্ষ সাক্ষী বানানোর চেষ্টা করলে শাহানা রাজী না হলে এই নিয়ে তাদের দাম্পত্য কলহের এক পর্যায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
প্রেসব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার জেলা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) এর পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কিবরিয়া, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মো. তরিকুল ইসলাম ও উপ-পরিদর্শক অনুপম দেবনাথ।