নদীমাতৃক বাংলাদেশ। মানবদেহে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে থাকা এর নদী, শাখা নদী, উপনদী, খাল-বিল, জলাশয় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি নির্ধারিত করেছে। দেশটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ সেই নদীগুলোর খুবই করুণ অবস্থা। বহু নদী মরে গেছে। অনেক নদী মরার পথে রয়েছে। প্রবাহ না থাকায় খাল-বিলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দখলে-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও যে ক্রমেই মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন অনেক ভূ-প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ। কিন্তু দু-একটি নদীতে সামান্য ড্রেজিং করা হলেও বড় নদীগুলোতে ড্রেজিং নেই বললেই চলে। তাহলে বাংলাদেশের মৃত্যুই কি অবধারিত?
নদীগুলোর এই করুণ অবস্থার শুরু ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকেই। ব্রিটিশ আমলে মোটামুটি নিয়মিতভাবে নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য নদী খনন করা হতো। তখন পলি জমে ভরাট হওয়ার প্রক্রিয়াও তুলনামূলক কম ছিল। পাকিস্তান আমলে নদী খননের কোনো প্রক্রিয়াই ছিল না। কোনো ড্রেজারও ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রথম চারটি ড্রেজার আনিয়ে নদী খনন, বিশেষ করে ফেরিঘাটগুলো সচল রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরপর আর কোনো ড্রেজার কেনা হয়নি। সেই চারটি ড্রেজারও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সর্বশেষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর দুই ডজনের মতো ড্রেজার কেনার উদ্যোগ নেয়। বেশ কয়েকটি ড্রেজার এসে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের নদীগুলোতে বছরে যে পরিমাণ পলি জমে, তাতে সেই পলি সরিয়ে নদীগুলোকে নাব্য করতে কম করে হলেও ১০০ ড্রেজার প্রয়োজন। সেগুলো দিয়ে সার্বক্ষণিক ড্রেজিংয়ের জন্য বিশাল বাজেটেরও প্রয়োজন। সেটি নিঃসন্দেহে খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যই তা করা একান্তভাবে প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ে যমুনা-পদ্মা নদীর তীর স্থিরকরণ এবং ভূমি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে প্রস্তাবিত প্রকল্পের রূপরেখা উপস্থাপনসংক্রান্ত অনুষ্ঠানে ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স উভয় ধরনের ডেজিং পরিচালনার কথা বলেছেন। এটি দ্রুততম সময়ে শুরু করা প্রয়োজন।
ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি নদীগুলোর দখল ও দূষণ ঠেকানো খুবই জরুরি। এ রকম অবস্থা সারা দেশেই, বিশেষ করে শহরসংলগ্ন ছোট ছোট নদীগুলোতে। নদী রক্ষায় উচ্চ আদালত থেকেও বারবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনাগুলোও যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, নদী মরে গেলে স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি বদলে যায়, কৃষিতে প্রভাব পড়ে, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, দেশ ক্রমে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যায়। দেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবনযাত্রা সচল রাখতে হলে, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে নদী রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার তা উপলব্ধি করছে এবং সে অনুযায়ী একের পর এক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে।