জকিগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আইনটি ২ মে ২০১৩ সংশোধিত হয়েছে। তামাক সরবরাহকারী, বিক্রেতা ও গ্রহিতা সকলেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি লঙ্ঘন করছে সিলেটের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জে। উপজেলা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাট-বাজার, অফিস-পাড়া, আদালত প্রাঙ্গণ, পাবলিক পরিবহন ও জন সমাবেশ স্থল সর্বত্রই প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে এই আইন। ফলে বাড়ছে সকল প্রকার তামাক সেবনকারীর সংখ্যা। সেই সাথে বাড়ছে সামাজিক অপরাধ ও তামাকজনিত রোগ-ব্যাধি। এ ব্যাপারে সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছেন উদাসীন ও নির্বিকার। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে সারা বাংলাদেশে যে পরিমাণ তামাক সেবনকারী রয়েছে শুধু সিলেটেই সেই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি সেবনকারী রয়েছে এর মধ্যে শুধু জকিগঞ্জেই প্রতিদিন বিক্রি হয় প্রায় সাত লাখ শলাকা বিড়ি সিগারেট। ডিসেম্বর-ফেব্র“য়ারি মাসে অর্থাৎ শীতে এর পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। পানের সাথে জর্দা এবং সাদাপাতার ব্যবহারও এ মৌসুমে বাড়ে।
জকিগঞ্জে দীর্ঘদিন যাবৎ ব্রিটিশ আমেরিকা টোবাকো, আবুল খায়ের টোবাকো, ঢাকা টোবাকো, নাসির টোবাকো, ন্যাশনাল টোবাকো, বাচ্চু টোবাকো সহ বিভিন্ন কোম্পানী সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও সাদা পাতা বাজারজাত করে আসছে। এ ছাড়া ব্যান্ডবিহীন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও এক টাকা দামের সিগারেট এখানে বস্তার ভিতরে করে দোকানে দোকানে বিক্রি করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টোবাকো কোম্পানীতে কর্মরত জকিগঞ্জের এক টেরিটোরি অফিসার জানান জকিগঞ্জে সর্বাধিক তামাক সেবনকারী রয়েছে। এখানে বিভিন্ন কোম্পানী প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ছয় থেকে সাত লক্ষ শলাকা বিক্রি করছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে জকিগঞ্জে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানী প্রতিদিন বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রায় তিন লাখ ৪১ হাজার সিগারেট বিক্রি করছে। আবুল খায়ের টোবাকো প্রতিদিন শুধু মেরিজ সিগারেট ও আবুল বিড়িই বিক্রি করে দুই লাখ ৩৫ হাজার শলাকা। ঢাকা টোবাকো জকিগঞ্জে লক্ষাধিক শলাকা বিড়ি সিগারেট বিক্রি করে থাকে। অন্যান্য কোম্পনীর প্রতিদিন ৩৫ হাজার শলাকা বিড়ি সিগারেট বিক্রি হয়। এখানে শীতকালে সিগারেট, বিড়ি বিক্রি হয় অনেক বেশি। রমজান মাস ও বর্ষাকালে তুলনামূলকভাবে সিগারেট কম বিক্রি হয়। এ জন্যই জানুয়ারী-ফেব্র“য়ারী মাসের বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা বছরের অন্যান্য সময়ের জন্য প্রযোজ্য থাকে। বিভিন্ন টোবাকো কোম্পানীর প্রতিনিধির সাথে কথা বলে জানা গেছে জকিগঞ্জে ডারবি, মেরিজ, শেখ, স্টার, ক্যাপস্টেন, গোল্ড লিফ, বেনসন, নাছির গোল্ড, সেনর গোল্ড,পাইলট, নেভী সিগোরেট আকিজ বিড়ি, আবুল বিড়ি, হাকিমপুরী, মমো, পানশাহী, বাবা, গুরুদেব, লাকী, স্বর্ণপুরী, রাজপুরী, গোপাল, মতি জর্দ্দা ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে।
সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে এখনো প্রকাশ্যে বিভিন্ন সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে দোকানের অংশ বিশেষ বা পুরো দোকান সাজানো রয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে সিগারেট-বিড়ি বিক্রির উপর পুরস্কারের লিফলেট। অথচ এ ধরণের বিজ্ঞাপনের জন্য তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় অপরাধ। জকিগঞ্জের পান সিগারেট বিক্রেতা জামাল হোসেনকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন আইন টাইন জানি না। কোম্পানির মানুষ আইয়া দোকানে সিগারেটের প্যাকেট লাগাইয়া দেইন। ইতা লাগাইলে দোকান সুন্দর লাগের। অপর দোকানদার শিবলী মিয়া জানান, দোকানে সিগারেটের প্যাকেট সাজিয়ে রাখার জন্য প্রতি মাসে সাতশ করে টাকা পান সিগারেট কোম্পানির কাছ থেকে। এন্টি ট্যোবাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) সিলেটের সমন্বয়কারী মুরাদ বক্স জানান-সিলেটের মধ্যে সর্বাধিক ধূমপায়ী রয়েছেন জকিগঞ্জে। এখানে প্রায় প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন জাতের প্রায় ছয় লক্ষ সলাকা বিড়ি সিগারেট বিক্রি হয়। তিনি বলেন আইনটি সংশোধনের পরই আমরা প্রশাসনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছি কিন্তু প্রচারণা আগের মতোই চলছে নানা কৌশলে। প্রশাসনকে আরো আন্তরিক হতে হবে। আইনের প্রয়োগটা জরুরী। তামাক বিরোধী জোটের সদস্য সিলেট ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুল হামিদ বলেন-তামাকসেবনকারীরা মনে করেন ধূমপান করলে বা জর্দাসহ পান সুপারি খেলে শীতে কিছুটা গরম অনুভব করা যায়। এ কারণে শীতে তামাকের ব্যবহার বাড়ে। তামাক মহামারির হাত থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। অজ্ঞাত কারণে এ ব্যাপারে প্রশাসন নিরব। তিনি বলেন পরিবহনে ধূমপান কমলেও ‘পয়েন্ট অব সেলে’ প্রচারণা থেমে নেই। আগে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট হতো বিড়ি সিগারেটের বিরুদ্ধে। এখন তাও হচ্ছে না। ফলে এখানে কোম্পানিগুলি বেপরোয়া। সিলেটের সীমান্ত উপজেলার বিভিন্ন হাটে হাটবারে ভারতীয় বিড়িও বিক্রি হয়। তামাকজাত দ্রব্যের প্রচারণার পাশপাশি জকিগঞ্জে ভারতীয় বিড়িও চলছে আড়ালে আবডালে। জকিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাহিদুল করিম বলেন-বিষয়টি এখনো আমার নজরে আসেনি। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর কোনো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় হয়নি। আইনটি প্রয়োগে আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নেব।
জকিগঞ্জে ধূমপায়ী বেশি হবার কারণ প্রসঙ্গে স্থানীয় আইনজীবী কাওসার রশিদ বাহার বলেন, শিক্ষার অভাবে সচেতনতার অভাব। আর অসচেতনতার কারণে বিড়ি সিগারেট কোম্পানীগুলি জকিগঞ্জ টার্গেট করেছে।