॥ আবু মালিহা ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শিশিরের বাবা মা আর আপত্তি না করে তাকে থাকতে দিলেন দিন কয়েকের জন্য তার খালার বাড়ীতে। মনিরার বাড়ীর আঙ্গিনার পাশেই বাহির ঘরের সামনে একটি ঝোপঝাড়ের মত বন। তার মধ্যে একটি কাঁঠাল চাপার গাছটি বেশ সুন্দর দেখতে ফুলের গন্ধে মন মাতায় দখিনা হিমেল ঝিরঝির বাতাসে। দেউড়িতে পাতা আছে একটি টেবিল আর দু’টি চেয়ার। মনিরার ঘরের লাগোয়া সেখানেই পড়াশুনা চলে। এবং মাঝে মধ্যে বাইরের উদাম হাওয়া এসে মন ছুঁয়ে যায় মিষ্টি বাতাসে। সে এক ভাল লাগা। বিষন্ন মনকে সহসাই তরতাজা করে দেয় প্রকৃতির এমন অনাবিল হিমেল বায়। ফুরফুরে মনটা তখন আনন্দে দোল খায় ভালবাসার কল্পনার সাগরে। আর সেই ক্ষণটির জন্যই অপেক্ষা করছে মনিরার জীবনে। আর সে কথা স্মরণ হতেই মনটা আহল্লাদে ভরপুর হয়ে উঠে। হঠাৎ করেই পিছনে শব্দ হলো… কীসের এতো ভাবনা পড়াশুনা বন্ধ করে। সম্বিৎ ফিরে এলো মনিরার। হতচকিতে জড়োসড়ো হয়ে বসে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো এই তো ভাইয়া পড়ছিতো। কই, না তো, কোন কিছু চিন্তা করছি না তো। পড়ার কথা ভাবছিলাম। কিশোর বয়সের দুরন্তপনা। সে আর শিশিরের বুঝতে বাকি নেই। যাক, সে বললো গতকালের অংকটা বুঝতে পেরেছো তো … না গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছো। দেখি আর একটি অংক কষ। দেখি মেধায় কতটুকু স্থান পেয়েছে তোমার সে নিয়মগুলো। সরল অংকের কসরত নিয়ে মনিরার অন্ত নেই। যদিও বলা হয় সরল অংক। তবে তার জন্য এর মতো গরল ও জটিল অংক আর নেই। তবে ভাইয়া মানে শিশিরের বুঝানোর দক্ষতাই আলাদা। সে ব্যাপারে মনিরার কোন দ্বিমত নেই। ১০/১৫ দিন এভাবে মনোযোগ দিলে অবশ্যই অংকের জন্য একটা হিল্লে হয়ে যাবে। সে ভরসা তারও আছে।
(৩)
ওদিকে স্কুলের সংবর্র্ধনার দিন ঠিক হয়ে গেলো। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহযোগিরা দারুণ কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সফল করার জন্য। শিশির সহ ১১ জন ছাত্রের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি থাকবেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জনাব নূরুল হক সাহেব। তার মতো গুণী ব্যক্তির আগমনে স্কুলের সুনাম বেড়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার হাতও প্রসারিত হবে। সেই হিসেবে সংবর্ধনা সভার প্রধান অতিথির সম্মান ও আতিথেয়তা প্রদানে কোন ত্র“টি হোক সেটা কেউই চায় না। যার ফলে সচেতন ভাবে সব আয়োজন করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে স্কুল কমিটির সভাপতি সকল শিক্ষকদেরকে নিয়ে সুন্দর ভাবে অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দক্ষ শিক্ষকদের সহযোগিতা করার জন্য পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন। বিশেষ করে অনুষ্ঠান পরিচালনায় বাংলার শিক্ষক রেজওয়ানুল করিম খুব ভাল পরিবেশন করতে পারেন এ ব্যাপারে সবাই জানেন। তাই তার উপর উপস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন প্রধান শিক্ষক সহ পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে। কেননা রেজওয়ানুল করিম মাঝে মধ্যে শহর ও বিভাগীয় বক্তৃতা ও কবিতা প্রতিযোগিতায় ১ম ও ২য় স্থান অর্জন করে স্কুলের সুনামও বয়ে নিয়ে আসেন। তাই এ কাজে তাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
সংবর্ধনার দিনটি রাখা হয়েছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে। কাজেই জাতীয় পর্যায়ে এ দিনটির গুরুত্ব সাপেক্ষে স্কুলের অনুষ্ঠানের আয়োজনটাও সংগতিপূর্ণ। পাশাপাশি ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন। একই সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দু’য়ে মিলে অপরূপ অনুষ্ঠান। এলাকায় সরব মেতে উঠলো স্কুলের অনুষ্ঠান নিয়ে। স্কুল আঙ্গিনাকে সুন্দর করে সাজানো হলো। লোক সমাগমের জায়গাকে পরিপাটি করে চেয়ার দিয়ে সাজিয়ে রাখা হলো। এমন সুন্দর অনুষ্ঠান এলাকার শিক্ষানুরাগী ও সুধী মহলে বেশ সাড়া পড়লো যাতে স্কুলের সুনাম ভবিষ্যতে আরো বয়ে আনতে পারে।
ওদিকে মনিরা তার বাড়ীতে বসে, শুয়ে ও চঞ্চলতা করে দিন কাটাচ্ছে ২৬ মার্চের দিনের জন্য। কারণ তার শিশির ভাইয়ার স্কুলে এতো বিরাট অনুষ্ঠানে সে কি না এসে থাকতে পারে। বাবাকে বলে রেখেছে ঐদিন সে সকালেই তার মাকে নিয়ে চলে আসবে শিশিরদের বাড়ী। তারপর সকাল দশটার আগেই স্কুলে পৌছে যাবে শিশিরের ছোট বোন নাতাশাকে সাথে নিয়ে। নাতাশাও ঐ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ভাইয়ার মতো এতো মেধা না থাকলেও মোটামুটি পড়াশুনায় ভাল। মনিরার দু’বছরের ছোট, মনিরার সাথে তারও খুব ভাব। দু’জনে অনেক গল্প ও খেলাধূলা করে এক সাথে। কোথায় যেতে হলে মনিরা তাকেই সাথে নেয়। তাই ২৬ মার্চও তাকে সাথে নিলো মনিরা। বেশ সুন্দর ও পরিপাটি করে সেজে গুঁজে স্কুলের দিকে রওনা দিলো যথা দিনটিতে। শিশিরদের বাড়ী থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের পথ। জমিনের আইল ঘেঁষে বনের ঝোপঝাড় মাড়িয়ে আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে স্কুলে যেতে ভালই লাগে। মাঝে মধ্যে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত ভাবে উড়াউড়ি করছে। দূর আকাশে চিল উড়ছে তার বিস্তৃত ডানা মেলে। মনে হচ্ছে, দিগন্তে স্বাধীনতার ডানা মেলে আপন মনে উড়ে বেড়াচ্ছে নীল চাঁদোয়ার তলে পরম সুখে। কোন অজানার চির সাথীকে খুঁজতে। আপন মনে কখন যে কল্পনার স্বপ্নীল ভাবনা তার মনে এসে বাসা বুনেছে চলতে চলতে সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ করে ভাবনায় ছেদ পড়লো নাতাশার ডাকে। বললো দেখ মনিরা আপা দূরে কতো সুন্দর চিল আকাশে উড়ছে। ওরা কতো স্বাধীন তাইনা! মনিরা বললো হ্যাঁরে বোন! ওরা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। কোন বাঁধা নেই। মনে মনে যেথা খুশি সেথা যেতে পারে। ওরা যেন প্রকৃত স্বাধীনতার খোঁজ পেয়েছে, এমনই ভাবনাতে ওরা প্রায় স্কুলের কাছে চলে এলো। এসেই দেখলো বিশাল আয়োজন, বিশাল প্যান্ডেল। চারদিকে হরেক কালারের নিশান বানিয়ে দড়ি দিয়ে অনুষ্ঠান স্থল ঘিরে রেখেছে অতিথিদের বসার জায়গা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আলাদা ভাবে বসার জায়গা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা ভাবে বসার জায়গা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল প্রাঙ্গণের সামনে শামিয়ানা টাঙ্গানো মাঠে বসার জায়গা করা হয়েছে। আনন্দ কোলাহলে সবাই মেতে রয়েছে। স্কুলের গৌরবময় ঐতিহ্য আর ভাল রেজাল্টের সুখবর সবার কাছে পৌছে দিতেই অনুষ্ঠানের এ বিশাল মহড়া। দু’তিন গ্রাম থেকে ইতোমধ্যে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ১০টায়। প্রধান মেহমান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আসবেন ঠিক ১১টায়। তাই যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে প্রায় সব ঠিকঠাক। আমোদ প্রিয় ছেলেমেয়েরা এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করছে। সাজানো স্কুলকে দেখছে এবং নতুন নতুন মানুষদের সমাগমের পরিবেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করছে। (অসমাপ্ত)