ইসলামে মানব সম্পদ উন্নয়নের গুরুত্ব

64

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
জ্ঞান অর্জন ঃ মুমিন হওয়ার জন্য জ্ঞান অর্জনকে ইসলাম প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ তাআলা প্রথম মানুষ আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর সবার আগে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন এবং এ জ্ঞানের পরীক্ষাতেই আদম (আ.) এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। কুরআন মজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে প্রতিটি বিষয়ের নাম শেখালেন। এরপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমাদের এগুলোর নামসমূহ জানাও।’ ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শেখান, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী, মহা প্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ বললেন,‘হে আদম! তুমি তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দাও।’এরপর যখন আদম তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তাআলা বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য সম্পর্কে জানি? আর আমি খুব ভালভাবেই জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা গোপন রাখ। যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ছাড়া সকলেই সিজদা করল। ইবলীস অবাধ্য হল ও অহঙ্কার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন রিসালাত লাভ করলেন তখন তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হল তাও জ্ঞানার্জন বিষয়ক। হিরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহী লাভ করলেন, পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়–ন এবং আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না। জ্ঞানকে মর্যাদা ও কল্যাণের বাহন বর্ণনাকরে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেবেন।” অন্যত্র বলা হয়েছে, তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমাত দান করেন। আর যাকে হিকমাত দেয়া হয় তাকে বিপুল কল্যাণ দান করা হয়। আর জ্ঞানীরা ছাড়া কেউ তো উপদেশ গ্রহণ করে না। আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অতএব হে চক্ষুষ্মান মানুষেরা! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। জ্ঞানের প্রতি আল্লাহ তাআলার এমন গুরুত্বারোপের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা.) জ্ঞান অর্জনকে ফরয ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিজন মুসলিমের উপর ফরয। জ্ঞানীকে তিনি নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরী আখ্যায়িত করে বলেছেন, আলিমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে দীনার বা দিরহাম রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার রেখে গেছেন শুধু জ্ঞান। তাই যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করেছে সে অর্জন করেছে উত্তরাধিকারের পুরো অংশ। জ্ঞানার্জনের কাজকে তিনি আল্লাহর পথে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে বের হয়েছে, সে আল্লাহর পথে রয়েছে, যতক্ষণ না সে প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে ইসলাম জ্ঞানার্জন ও গবেষণার কাজকে বাধ্যতামূলক রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে এমন বিধান রাখা হয় যে, একজন মানুষ মুসলিম হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষিত হওয়া ছাড়া মুসলিম হওয়ার বিষয়টি বিধিগতভাবে অসম্ভব বলে গণ্য হয়।
জীবিকা অর্জন : আল্লাহ তাআলার ইবাদত যেমন ফরয, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরজ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি যিকর করবে, এতে তোমরা সফল হবে। আবার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রেও হালা-হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এমন প্রবলভাবে যে, ইবাদত কবুল হবে কি না, ব্যক্তি জান্নাতে যাবে কি না তা একান্তভাবে জীবিকা উপার্জনের পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল রাখা হয়েছে। ফলে ইসলামে একজন ব্যক্তি কেবল জীবিকাই উপার্জন করে না বরং হালাল উপায় অবলম্বন করে বৈধভাবে জীবিকা উপার্জন করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা ফরযের পরে ফরয। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তই তাঁর ইবাদাত করো। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ প্রেক্ষাপটেই বলেছেন, হারাম সম্পদে তৈরি গোশত ও রক্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং হারাম সম্পদে তৈরি প্রতি টুকরো গোশত ও প্রতি ফোটা রক্তের জন্যে নরকই যথোপযুক্ত আবাস।
স্বনির্ভরতা অর্জন : ইসলামে কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকাকে সমর্থন করা হয়নি। ব্যক্তি নিজে উপার্জন করবে, নিজের আয়ের উপর নির্ভর করবে। অন্য কারো আয়ে ভাগ বসাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, পবিত্রতম উপার্জন হলো মানুষের নিজের হাতের পরিশ্রম এবং প্রত্যেক বিশুদ্ধ ব্যবসায় (এর উপার্জন)। স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য কাজ করতে হলে কেউ যেন তাতে দ্বিধা না করে, লজ্জিতবোধ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য ইসলামের শ্রম ও শ্রমিককে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। নানাভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা শ্রম পছন্দ করেন। শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেছেন, যারা তোমাদের কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে, সে শ্রমিক তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যাদের কাছে এমন লোক আছে তাদেরকে যেন তা-ই খেতে দেয় যা তারা নিজেরা খায়, তাদেরকে যেন তা-ই পরতে দেয়, যা তারা নিজেরা পরে। তোমরা তাদেরকে তাদের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কাজ করতে বাধ্য করবে না। যদি তাদেরকে তোমরা কোনো কঠিন কাজ করতে দাও, তা হলে তোমরা তাদের সহযোগিতা করবে। শ্রমিককে যেন তার প্রাপ্য মজুরির জন্য নিয়োগকর্তার পেছনে ঘুরতে না হয় এবং শ্রমের ন্যায্য মূল্য নিয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাফি’ ইবনু খাদীজ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে একদা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন প্রকারের উপার্জন উত্তম ও পবিত্রতম? তিনি বলেছেন, ব্যক্তির নিজের শ্রমের উপার্জন ও সৎ ব্যবসায়লব্ধ মুনাফা। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল (সা.) নানাভাবে মানুষকে কাজ করায় উৎসাহ দিয়েছেন। ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি অনীহা তৈরির জন্য রাসূল (সা.) বলেছেন, নিচের হাতের চেয়ে উপরের হাত উত্তম। আল্লাহ তা’আলার হুকুম আর আল্লাহর রাসূলের এ নির্দেশনা মেনে ব্যক্তি যদি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে অনিবার্যরূপে তাঁর ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। এভাবে উন্নয়ন ঘটবে মানবের। অদক্ষ-অক্ষম বোঝার পরিবর্তে ব্যক্তি উন্নত সম্পদে পরিণত হবে। (অসমাপ্ত)