কাজিরবাজার ডেস্ক :
দীর্ঘদিন পর জনসভার বক্তব্যে বিএনপি চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়া অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। সুযোগ পেলে দেশের মানুষ ধানের শীষে ভোট দেবে। সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন।’
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রবিবার বিকালে বিএনপি আয়াজিত জনসভায় খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে’ এ জনসভার আয়োজন করা হয়।
এক ঘণ্টার বক্তব্যে সরকারের নানা সমালোচনা, অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ, দুর্নীতি, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
গত বছরের ১ মে শ্রমিক সমাবেশে বক্তৃতার পর রবিবারই প্রথম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করলেন খালেদা জিয়া।
এই সমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে সরকার পরিকল্পিতভাবে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ করেন বিএনপি নেতারা।
সমাবেশে জনসমাগমে পথে পথে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলে এর নিন্দা জানান খালেদা।
বেলা ২টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে জনসভা শুরুর এক ঘণ্টা পর খালেদা জিয়া সমাবেশস্থলে পৌঁছান। এসময় চার দিক থেকে তার নামে স্লোগান ওঠে। তিনি হাত উঁচিয়ে নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন।
৭ নভেম্বর ‘বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি দিবস’ উপলক্ষে এই সমাবেশ ডাকা হলেও এতে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্ব পায়। ‘৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে জনসভা’ লেখা ছিল ব্যানারে।
জনসভার জন্য উদ্যানে ৬০ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট প্রশস্ত মঞ্চ নির্মাণ করে বিএনপি। মঞ্চের চারপাশে বসানো হয়ে সিসি টিভি ক্যামেরা। মঞ্চের সামনে ৩০ ফুট জায়গায় বেষ্টনি দেয়া হয়।
পুরো জনসভা সুশৃঙ্খল রাখতে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলের দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা হয়।
জনসভা ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকা সাজানো ছিল নানা রঙের ব্যানার-ফেস্টুনে। এসব ডিজিটাল ব্যানারে ছিল জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই জনসভার পুরো কার্যক্রম সমন্বয় করেন। তাকে সহযোগিতা করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল।
এই সমাবেশ করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ ২৩টি শর্ত দিয়েছিল বিএনপিকে।
সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেন।
‘ছোট মন নিয়ে রাজনীতি করা যায় না’ : জনসভার অনুমতি দেয়ার পর বাস গাড়ি বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সরকার এর মাধ্যমে ছোট মনের পরিচয় দিয়েছে। ছোট মন নিয়ে রাজনীতি করা যায় না।’
খালেদা বলেন, ‘এই সমাবেশের অনুমতি দিলেও এখানে যেন জনগণ না আসতে পারে তার সব ব্যবস্থা করছে। বাস বন্ধ করছে। এমনকি আমি যেন এখানে না আসতে পারি এর জন্য আমার বাসার সামনে (গুলশান) খালি বাস রেখে দিয়ে জ্যাম সৃষ্টি করেছে। চুরি করে যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা তো জনগণে ভয় পাবেই। এই সরকার সবচেয়ে বেশি ভয় পায় জনগণকে।’
সরকারের যত সমালোচনা : খালেদা জিয়ার তার বক্তব্যে বলেন, ‘সরকার অঘোষিত বাকশাল কায়েম করেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে তুলে নেয়া হয়, গুম করা হয়।’
জেলখানা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা অন্যায় না করলেও তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেয়া হয়। গুম করা হয়। এমনকি থানায় নিয়ে তাদের পায়ে গুলি করা হয়। অনেক নেতাকর্মীদের পঙ্গু করা হয়েছে।’
বিএনপি নেত্রী অভিযোগ করেন, সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে দশ টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর কথা বলেছিল কিন্তু এখন ৭০টাকায় চাল খেতে হচ্ছে। বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেবে কিন্তু এখন ঘরে ঘরে বেকার সৃষ্টি করেছে।
প্রতিনিয়ত গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলেও দাবি করে খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি শিক্ষকদের পর্যন্ত মারধর করছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।’
সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি : খালেদা জিয়া বলেন, ‘আগে কখনো শুনিনি আমাদের দেশের মানুষ সুইস ব্যাংকে টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু জানা গেল ২০১৫ সালে মাত্র এক বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সেখানে পাচার হয়েছে। গত ১০ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। আর এই ১০ বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। এটা আমাদের হিসাবে নয় আমেরিকার জিএফআই নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আজ প্রতি পদে পদে দুর্নীতি। সরকার উন্নয়নের কথা বলে উন্নয়নের নামে লুটপাট করছে দুর্নীতি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে করার নামে বিশাল দুর্নীতি হচ্ছে। কারসাজি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা পাচার হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এগুলোর বিচার হয় না। এগুলো তো জনগণের টাকা। দুদক এদের দেখে না । কিন্তু আমাদের সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও আমাদের পেছনে তারা লেগে আছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাছে এ দেশের মানুষ বাঁচলো কি মরলো তার কোনো চিন্তা নেই।’
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ জোর করে : দেশে বিচার বিভাগ বলে কিছু নেই এমন দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে জোর করে অসুস্থ বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু উনি চেয়েছিলেন দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু সেখানেও এজেন্সির লোকজন পাঠিয়ে তাকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কারণ তিনি নিম্ন আদালত সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে এমন কথা বলেছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণ হলো যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের কী হয়।’
ইসি সরকারের কথায় চলছে
নির্বাচন কমিশন সরকারের কথায় চলছে বলে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কিছু সুপারিশ দিয়েছি। সেখানে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার না করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে সেনা মোতায়েন হবে না। তারা ইভিএম ব্যবহার করতে চাইছে। কেন তারা বলছে সেনা মোতায়েন হবে না। তাহলে আমরা বুঝবো তারা সরকারের কথায় চলছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার দায়িত্ব আপনাদের। আপনারা সরকারের কথা শুনবেন কিন্তু অন্যায় আবদার শুনবেন না। ইভিএম নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে না, সেনা মোতায়েন করতে হবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে। হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।’
দেশের স্বার্থে এক হতে হবে : দেশ রক্ষার জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে এক হতে হবে। আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। আসুন দেশের স্বার্থে এক হয়ে কাজ করি। এই কাজ করলেই দেশের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ সম্ভব।’
খালেদা বলেন, ‘জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।’ ঘরে ঘরে মানুষের কান্না আহাজারি এমন দাবি করে তিনি বলেন, ‘মানুষ আজকে অত্যাচারিত, নির্যাতিত নিপীড়িত। তারা মুক্তি চায়, পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তন আসতে হবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এজন্য মানুষকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আর এই ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন।’
খালেদা বলেন, ‘আজ জনগণের ঐক্য হলো বড় ঐক্য। যারা জনগণের ভালো চায় তাদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাই এই সরকারের অপকর্ম ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে হবে।’
ক্ষমতায় গেলে যা করবে বিএনপি : খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছি। সেখানে আমরা বেশ কিছু বিষয়ের কথা বলেছি। সামাজিক উন্নয়ন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়নসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ আছে। আমরা এক বছরের বেশি বেকার থাকলে তাদের জন্য বেকার ভাতা, সবার জন্য বিনামুল্যে চিকিৎসা, পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য বিমা চালু, কমমূল্যে কৃষি পণ্য দেয়ার পাশাপাশি বেশি মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনবো, দেশের গরিব ও বন্যা দুর্গত কৃষকদের কৃষি ঋণ বিতরণ করবো, বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হবে।’
তিনি সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকার বলছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আপনাদের অনেকের চাকরি থাকবে না। আমরা আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা কাউকে চাকরি থেকে সরাবো না। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশন দেয়া হবে।’
সরকারকে অভয় দিলেন খালেদা : বিএনপি সংঘর্ষের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবো। কার্যকর সংসদ দেখতে চাই। বর্তমানে যা আছে এটা সংসদ না। এই সরকার ও সংসদ অবৈধ। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কোনো নির্বাচন হয়নি।’
খালেদা জিয়া সরকারি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা আপনাদের মতো ধরবো, মারবো না। আমরা আপনাদের শুদ্ধ করবো। আপনারা যে এই হত্যা, গুম, নির্যাতন করছেন এটা ঠিক না। আমরা সত্যিকারের মানুষ বানাবো আপনাদের।’
সরকারের অন্যায়, অত্যাচারের জন্য ক্ষমা করে দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি আপনাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু মানুষ তো ভুলেনি। কারণ এতদিনে অনেক মানুষকে আপনারা গুম, খুম করেছেন।’
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে : রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোর কাছে বলবো আপনারা অবিলম্বে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। কারণ তারা বাংলাদেশের না মিয়ানমারের নাগরিক।’
এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে যাওয়া এবং আসার পথে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা গাড়িবহরে হামলা করেছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘যাওয়ার দিন ফেনীতে আমাদের নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের গাড়িতে হামলা হলো। আসার দিন বাসে বোমা মেরে আগুন দিল। বিএনপি নয়, বাসে আগুন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারা মামলা দিলো আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।’ তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ সব নেতাকর্মীর অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন।
সরকারি দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সত্যিকারের নেতা হলে জনগণের পালস বোঝার চেষ্টা করুন। জনগণ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় তার ব্যবস্থা করুন। দেশের মানুষ কী চায় তা যাছাই করার চেষ্টা করুন।’
ঐক্যবদ্ধ থাকুন, জয় হবেই : বক্তব্যের শেষ প্রান্তে এসে খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি সবাইকে বলবো সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকুন। জয় আমাদের হবেই। একদিন বাংলাদেশকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাবো।’