॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইজ্জত-আবরু নিয়ে জীবন-যাপনের অধিকার ঃ ইসলাম বিধবা নারীকে ইজ্জত-আবরু নিয়ে বাঁচার অধিকার দিয়েছে। কোন নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্বাভাবিকভাবে সে অসহায় বোধ করে ও নিরাপত্তাহীন দিন কাটায়। এ সুযোগে অনেকেই তাদেরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে, তাদেরকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় ও অশোভনীয় আচরণ করে থাকে। ইসলাম এহেন আচরণ করতে নিষেধ করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘‘আর যদি তোমরা আকারে-ইঙ্গিতে সে নারীর বিয়ের পয়গাম দাও, কিংবা নিজেদের মনে কোন আকাক্সক্ষা লুকিয়ে রাখ, তবে তাতে ও কোন পাপ নেই, আল্লাহ জানেন যে, তোমরা অবশ্যই সে নারীর কথা উল্লেখ করবে। কিন্তু তাদের সাথে বিয়ে করার গোপন প্রতিশ্র“তি দিয়ে রেখো না। অবশ্য শরীয়তের নির্ধারিত প্রথা অনুযায়ী কোন কথা সাব্যস্ত করে নেবে। আর নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্তি পর্যায়ে না যাওয়া অবধি বিয়ে করার কোন ইচ্ছে কর না। আর এ কথা জেনে রেখো যে, তোমাদের মনে যে কথা রয়েছে, আল্লাহর তা জানা আছে। কাজেই তাকে ভয় করতে থাক। আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ ক্ষমাকারী ও ধৈর্যশীল। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস রা. বলেন: যদি কোন ব্যক্তি ইদ্দত পালনকারী কোন মহিলাকে বলে যে, আমার বিবাহ করার ইচ্ছা আছে। আমি কোন সতী মহিলাকে পেতে ইচ্ছা পোষণ করি। কাসিম (র.) বলেন, এই আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেন কোন ব্যক্তি বলল, তুমি আমার কাছে খুবই সম্মানিত এবং আমি তোমাকে পছন্দ করি। আল্লাহ তোমার জন্য কল্যাণ বর্ষণ করুন। অথবা এই ধরনের উক্তি। আতা (র.) বলেন, বিবাহের ইচ্ছা ইশারায় ব্যক্ত করা উচিত, খোলাখুলি এই ধরনের কোন কথা বলা ঠিক নয়। কেউ এ ধরনের কথা বলতে পারে যে, আমার এ সকল গুণের প্রয়েজন আছে। আর আপনার জন্য সুখবর, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য আপনি পুনঃবিবাহর উপযুক্ত। সে মহিলা ও বলতে পারে, আপনি যা বলেছেন, তা আমি শুনেছি কিন্তু এর বেশি ওয়াদা করা ঠিক নয়। তার অভিভাবকদের ও অজ্ঞাতে কোন প্রকার ওয়াদা দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু যদি কেউ ইদ্দতের মাঝে কাউকে বিবাহের কোন প্রকার ওয়াদা করে এবং ইদ্দত শেষে সে ব্যক্তি যদি তাকে বিবাহ করে তবে সেই বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে না। ইসলাম বিধবাদের সম্ভ্রমের নিরাপত্তা প্রদান করেছে। জাহিলী যুগের ন্যায় পিতার মৃত্যুর পর তার পুত্র কর্তৃক বিধবা স্ত্রীদের বিবাহ নিষেধ করেছে। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত. তিনি বলেন, আমার মামা আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। (রাবী হুশাইম তার বর্ণিত রিওয়ায়েতে বারা ইবনু আযিব (রা.) এর মামার নাম হারিছ ইবনু আমর উল্লেখ করেছেন।) রাসূলুল্লাহ (স.) তার জন্য একটি ঝাগুা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন রাসূলুল্লাহ (স.) আমাকে এক ব্যক্তির কাছে পাঠিয়েছেন, যে তার পিতার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে বিবাহ করেছে। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি যেন তাকে হত্যা করি।
অর্থনৈতিক অধিকার ঃ ইসলামী আইন বিধবা নারীদের যে সকল অধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে অর্থনৈতিক অধিকার অন্যতম। ইসলাম প্রত্যেক বিবাহিতা নারীর মোহরের অধিকার দিয়েছে। “ম্হোর আরবী শব্দ, অর্থ-স্বেচ্ছাকৃত দান। মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহের চুক্তিকালে বর কর্তৃক কন্যাকে যে অর্থ দেয়া হয় তাউ মোহর এবং তা স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তিরূপে গণ্য হয়। ইসলাম পূর্বকলে মোহর ওয়ালীর হাতে অর্থাৎ পিতা, ভাই বা যে আত্মীয়ের অভিভাবকত্বে কন্যা থাকত তার হাতে প্রদান করা হত। মোহরের পরিমাণ স্বামীর আর্থিক স্বচ্ছলতার ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে। ইসলামে মোহর দু ভাবে নির্ধারণ করা হয়। ইসলামী আইনে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বিবাহের সময়ই সন্তষ্টচিত্তে মোহর পরিশোধের নির্দেশনা প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আর তেমরা স্ত্রীদের কে তাদের মোহর খুশিমনে দিয়ে দাও।
এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারি (রহ.) উল্লেখ করেন, ‘‘আর অধিক মোহর এবং সর্বনিম্ন মোহর কত?- এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, “এবং তোমাদের যদি তাদের একজনকে অগাধ অর্থ দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছু গ্রহন করো না ” এবং আল্লাহ তাআলা আরো বলেন “অথবা তোমরা তাদের মোহরের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দাও”। সাহল (রা.) বলেছেন নবী সা এক ব্যক্তিকে বললেন, যদি একটি লোহার আংটিও হয় তবে মোহর হিসাবে যোগাড় করে দাও। “বুখারী, আস-সহীহ,অধ্যায়: আন-নিকাহ, পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী:- আর যদি বিবাহে মোহর নির্ধারণ না হয়ে থাকে এবং স্বামী মৃত্যুবরণ করে, তাহলে ঐ বিধবাকে মহরের মিছল “মোহরে মিছিল হচ্ছে যে বিয়েতে মোহরের পরিমাণ যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয় না; বরং স্ত্রী আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক মর্যাদা, স্ত্রী বোন অথবা পিতার পরিবারের অন্যান্য কন্যা যথা: ফুফুর মোহরের অনুপাত এবং গুণাগুণ অনুসারে যে মোহর প্রদান করা হয়। যে সব ক্ষেত্রে বিয়েতে লেনদেন নির্দিষ্ট করা হয় না, সে সব ক্ষেত্রে এই মোহর মিছলই নির্ধারণ হবে। মোহর পরিশোধ সম্পর্কে হাফিয ইবনে কাসীর (রা.) উল্লেখ করেছেন, “স্ত্রীর সম্মতি সাপেক্ষে স্বামীগণ মোহর বিবাহের পরও পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু মোহর পরিশোধের পূর্বেই যদি স্বামী মৃত্যুবরণ করে, তবে স্ত্রীর নিকট স্বামী মোহর বাবদ ঋণী হয়ে থাকবে। তাই স্ত্রী তার ঋণ আদায়ের জন্য স্বামীর সম্পত্তি আটক করার অধিকার রাখে। এ প্রসঙ্গে মুসলিম আইন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, “কোন মৃত মুসলমানের উত্তরাধিকারীরা দেনমোহরের ঋণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়। মৃতের কাছে প্রাপ্য অন্যান্য ঋণের মত দেন মোহর ঋণেও উত্তরাধিকারীর মৃতের সম্পত্তিতে প্রাপ্য অংশের আনুপাতিক হারে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী দায়ী হবে। কোন মহিলার স্বামীর সম্পত্তি তার দখলে থাকলে স্বামীর অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা তাদের নিজ নিজ অংশের দখল উদ্ধার করতে পারবে। একজন মুসলমান এক বিধবা এক পুুুত্র ও দু কন্যা রেখে মারা যায়। বিধবা ৩২০০ টাকার দেনমোহর ঋণ পাবার অধিকারী। পুত্রের প্রাপ্য অংশ হল ৭/১৬ এবং সে ৭/১৬ এর ৩২০০ = ১৪০০ টাকা দিতে বাধ্য, এবং বিধবার দখলে স্বামীর সম্পত্তি থাকলে পুত্র ১৪০০ টাকা পরিশোধ করে বিধবার থেকে নিজ অংশ নিবে। প্রত্যেক কন্যার প্রাপ্য অংশ হল ৭/৩২ এবং সে বিধবাকে ৭/৩২ এর ৩২০০= ৭০০ টাকা প্রদান করার পর নিজ অংশ পাবে।
ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়কে মিরাস প্রাপ্তির অধিকার দিয়েছে এবং তাদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধরিত অংশ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অংশ রয়েছে , ভাইয়ের সম্পত্তিতে বোনের অংশ রয়েছে, সন্তানের সম্পত্তিতে মায়ের অংশ রয়েছে, তদ্রƒপ মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে ও স্ত্রীর নির্ধারিত অংশ রয়েছে। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অংশ- সন্তানের সম্পত্তিতে মাতার অংশ- স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অংশ-ভাইয়ের সম্পত্তিতে বোনের অংশ- এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, স্ত্রীদের জন্য এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্য হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ। আলোচ্য আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স.) এর সাথে বেরিয়ে আল-আসওয়াফ নামক স্থানে এক আনসারী মহিলার নিকট উপস্থিত হই। তখন ঐ মহিলা তার দুটি মেয়েকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (স.) এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা সাবিত ইবনু কায়িস রা.-এ কন্যা। এদের বাবা আপনার সাথে ওহুদের যৃদ্ধে গিয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। এদের চাচা এদের সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করে নিয়ে গেছে। এদের জন্য কোন কিছু রাখেনি। সম্পদ ছাড়া তো এদের বিয়ে দেওয়া যাবে না। (অর্থাৎ সহায়- সম্পত্তিহীন এ মেয়েদেরকে কেউ বিয়ে করবে না।) রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন: আল্লাহ এ ব্যাপারে ফয়সালা করবেন। তখন মিরাসের আয়াত নাযিল হয়। মিরাসের আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ (স.) মেয়েদের চাচার কাছে লোক পাঠিয়ে বলেন : সাবিতের মেয়েদের তার সম্পদের তিন ভাগের দু‘ভাগ দিয়ে দাও এবং তাদের মাকে আট ভাগের এক ভাগ দাও। আর বাকী অংশ তোমার। ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) বলেন, বর্ণনাকারী বিশর ভুল করেছেন। আসলে মেয়ে দু’টি সা’দ ইবনু রবী (রা.) এর কন্যা। কারণ সাবিত ইবনু কায়িস (রা.) শহীদ হন ইয়ামামার যুদ্ধে।
মতামত প্রকাশের অধিকার ঃ ইসলাম একটি সহজাত ধর্ম। কোন নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্বভাবতই সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজের মতামত প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগে অনেকেই তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তাই ইসলাম বিধবাদের অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য তাদের মতামতের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারী ইদ্দত পালনের মাধ্যমে তার গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে থাকে। কিন্তু বিধবা নারীর ঐ সময়ের মনসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে ইসলাম ইদ্দত পালনের স্থান নির্বাচনে তার মতামতের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, অতঃপর যদি সে স্ত্রী নিজ থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে সে নারী নিজের ব্যাপারে কোন উত্তম ব্যবস্থা করে, তবে তাতে তোমাদের উপর কোন পাপ নেই।
বিধবা নারীর পুনরায় বিবাহের প্রস্তাব আসলে তার মতামত ব্যতীত বিবাহ শুদ্ধ হবে না। ইসলামী আইনে বিবাহের প্রস্তাবে নারী যদি চুপ থাকে, তাহলে তার সম্মতি রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বিধবা নারীর পুনরায় বিবাহের প্রস্তাব আসলে তার মৌখিক সম্মতি প্রয়োজন। কেননা অনেক ক্ষেত্রে তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ও তার সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ দেওয়া হয়ে থাকে। তাই বিধবা নারীর অধিকার রয়েছে মৌখিকভাবে তার মতামত প্রকাশ করার। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা রয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন : পূর্ব বিবাহিতা তার (নিজের বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে) নিজের ব্যাপারে অভিভাবকের তুলনায় অধিক হক্বদার। কুমারীকে তার থেকে তার সম্মতি নিতে হবে, তার নিরবতাই তা সম্মতি। বিধবা নারীকে জোর জবরদস্তি করে বিবাহ দিলে, সে বিবাহ ভঙ্গ করার অধিকার তার রয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, খানসা বিনতে খিযাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তার পিতা তাকে বিবাহ দিলেন তিনি ছিলেন সায়্যিব (বিবাহিত নারী), তিনি তা অপছন্দ করলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (স.) এ নিকট গেলেন তিনি এ বিবাহ ভেঙ্গে দিলেন। (অসমাপ্ত)