স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে নিবন্ধন ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে চলছে সহস্রাধিক অবৈধ সিএনজি চালিত অটোরিক্সা। এসব অটোরিক্সার পেছনে লেখা রয়েছে শুধু আবেদিত বা অনটেস্ট। মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রাজপথে এগুলো চলার বৈধতা দিয়েছেন কিছু শ্রমিক নেতা আর পুলিশের কিছু লোক। এছাড়া এসব অটোরিক্সার চালকদেরও নেই কোন লাইসেন্স। সমিতির সদস্য হলেই গাড়ি চালানো যায়, এতে তাদের কোন ভোগান্তি পোহাতে হয় না।
সিলেট নগরী থেকে শুরু করে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট, সালুটিকর, বিছনাকান্দি, গোলাপগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিয়ানীবাজার ও দক্ষিণ সুরমাসহ বেশ কিছু এলাকায় এভাবেই চলছে এসব অবৈধ সিএনজি চালিত অটোরিক্সা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সিলেট অফিস সূত্রে জানা যায়, সিলেটে বৈধ সিএনজি চালিত অটোরিক্সা রয়েছে ২১ হাজার ২৩২ টি। এর মধ্যে প্রায় ৫ বছর আগে দেড় হাজারের উপরে সিএনজি অটোরিক্সার নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদনের কোন সুরাহাও হয়নি। এছাড়া এর বাইরে, কোনও আবেদন না করেই আরও দুই সহস্্রাধিক সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চলছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিলেট জেলা সিএনজি অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের ছত্রছায়ায় নগরীতে চলাচল করছে এসব অবৈধ অটোরিক্সা। পুলিশ, সমিতির নেতা, বিআরটিএ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশে এসব সিএনজি অটোরিক্সা নগরীতে চলছে। অবৈধ অটোরিক্সাকে ‘বৈধতা’র বিনিময়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিএনজি অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত একটি সংগঠনের শাখা রয়েছে আম্বরখানা ও সালুটিকরে। এই শাখার অধীনে অবৈধ অটোরিক্সা রয়েছে হাজারখানেক। প্রতিটি গাড়ির নম্বর প্লেটে লেখা রয়েছে- ‘সিলেট-থ-১২-আবেদিত’। প্রতিটি অটোরিক্সা থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে আদায় করেন অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। ওই টোকেনে চলা যায় এক মাস। প্রতি মাসে টোকেন না নিলে সমস্যায় পড়তে হয় চালকদের। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, অবৈধ অটোরিক্সার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের স্বাক্ষরিত টোকেন দিয়েই বছরের পর চলে অবৈধ ‘সিলেট-থ-১২-আবেদিত’ অটোরিক্সাগুলো। নিবন্ধনহীন সহস্্রাধিক সিএনজি অটোরিক্সা বাবদ প্রতিমাসে উত্তোলন করা হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা।
চালকরা জানান, উত্তোলিত টাকার ভাগ পান সমিতির নেতা, এয়ারপোর্ট থানা, আম্বরখানা পুলিশ ফাঁড়ি, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ।
গত কয়েকদিন নগরীর আম্বরখানা, টিলাগড়, গোলাপগঞ্জ, ওসমানীনগর, টুকেরবাজার ও দক্ষিণ সুরমাসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিআরটিএ’র অনুমোদন ছাড়াই (ঈঘএ-১ অনটেস্ট) আবারো কোনটি আবেদিত লিখেই চলছে নগরী ও নগরীর আশপাশ উপজেলায়।
চালকরা জানান, মাসোহারা টোকেন দিয়েই রাস্তায় চলছে এসব গাড়ি। আর এই টোকেন পুলিশ টোকেন হিসাবে পরিচিত। প্রশাসনের যথাযথ তদারকির অভাব আর কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার অসাধুতার কারণে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না অনটেস্ট সিএনজি অটোরিক্সা বাণিজ্য।
স্থানীয় কয়েকজন চালকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চলাচলকারী সিএনজি অটোরিক্সার চালকদের নেই কোন লাইসেন্স। কারো কারো লাইসেন্স রয়েছে। সেটি জাল বলেও জানান অনেক চালক।
নগরীর মজুমদারী এলাকার হাসান মিয়া নামের এক চালক জানান, তার গাড়ির কোন রেজিস্টেশন নেই। তার যে লাইসেন্স সেটিও জাল। জাল লাইসেন্স কেন এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান জানান, ওই রোডে চলাচল করতে কোন লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়না। এছাড়া বিআরটিএ অফিসে গেলে তাদের ঘিরে ধরে দালালরা। লেখাপড়া কম জানার কারণে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় বেশী টাকা। একটি লাইসেন্স করতে দালালরা ১০ হাজার টাকা নেয়।
সিলেট সালুটিকর রোডে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিক্সার মালিক সোনাউর মিয়া জানান, তার দুটি সিএনজি অটোরিক্সা রয়েছে। যেগুলোর কোন রেজিস্ট্রেশন নেই। সিলেট বিআরটিএ অফিসে আবেদন করেছেন বছর চারেক আগে। এখনো তার আবেদনের কোন সুরাহা হয়নি। প্রতিমাসে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই তার গাড়ি চলছে। অনেক সময় পুলিশ গাড়ি আটক করলেও টোকেন দেখা মাত্রই ছেড়ে দেয়। তিনি আরও জানান, ওই রোডে চলাচলকারী অনটেস্ট সিএনজি অটোরিক্সার মালিকরা পুলিশ টোকেন দিয়ে রাস্তায় এসব গাড়ি চালাচ্ছে। আবার অনেক সিএনজি অটোরিক্সার মালিক এ ধরণের ঝুঁকি না নিয়ে অপেক্ষার পর কম দামে গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। তার দুটি গাড়ির মধ্যে এধরনের একটি গাড়ি অনেক কমদামে কেনেন বলে জানান।
অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন আম্বরখানা সালুটিকর শাখার অফিস সূত্রে জানা যায়, এই শাখার অধীনে হাজার খানেক আবেদিত অটোরিক্সা রয়েছে। এই শাখার আওতায় রয়েছে আম্বরখানা স্ট্যান্ড, এয়ারপোর্ট স্ট্যান্ড, কোম্পানীগঞ্জ স্ট্যান্ড, গোয়াইনঘাট স্ট্যান্ড, সালুটিকর স্ট্যান্ড, ভোলাগঞ্জ স্ট্যান্ড, পারুয়া স্ট্যান্ড, দয়ারবাজার রাধানগর স্ট্যান্ড। এ সকল এলাকার সকল পুলিশ ফাঁড়ি ও থানার সঙ্গে মৌখিক চুক্তি রয়েছে শ্রমিক ইউনিয়নের। প্রতিটি চেকপোস্টে টোকেন দেখালেই অবৈধ অটোরিক্সা ছেড়ে দেয় পুলিশ। কয়েক বছর ধরে এভাবেই ‘আবেদিত’ লেখা গাড়িগুলো চলছে।
সিলেট-থ-১২-আবেদিত নম্বর প্লেটধারী গাড়ির চালক রইছ আলী বলেন, তার গাড়ির কোনও কাগজপত্র নেই। প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা দিয়ে পুলিশ টোকেনের মাধ্যমে গাড়ি চালাচ্ছি।
এ ব্যাপারে আম্বরখানা সালুটিকর শাখার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক তেরা মিয়া বলেন, তিন মাসের জন্য অন্তবর্তীকালীন দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন। এর আগেও তিনি ওই সমিতির দায়িত্ব পালন করেন। তার স্বাক্ষরিত একটি টোকেন দেওয়া হয়। তিনি বলেন, প্রতিদিন ১৫ টি গাড়ি পুলিশ সদস্যদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। যাতে তাদের অন্য রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বা রেজিস্ট্রেশনভুক্ত গাড়িগুলো হয়রানির শিকার না হয়।
এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) নিকোলিন চাকমা বলেন, সালুটিকর এলাকায় কোন সিএনজি পাম্প না থাকায় চৌকিদেখী এলাকায় কিছু সিএনজি অটো রিক্সা চলাচল করে। যেগুলোর কোন রেজিস্টেশন নেই। আমরা প্রায়ই রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি অটোরিক্সা ধরতে অভিযান চালাই। তবে টোকেন দিয়ে অবৈধ অটোরিক্সা চালানোর বিষয়টি তার জানা নেই।