জোটগত ভোট হলে পাল্টে যাবে হিসাব ॥ হবিগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচনের আমেজ তুঙ্গে

108

হবিগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসন নিয়ে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলীয় প্রার্থী ঘিরে চলছে নানা হিসাব। মনোনয়ন পেতে প্রার্থীরা তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি কেন্দ্রের সঙ্গে লবিং-তদবিরে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রার্থিতা জানান দিতে নানা কৌশলে নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন কোনো কোনো প্রার্থী। গতবার এ হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে জোটগত নির্বাচন হয়। আগামী নির্বাচন একক নাকি জোটগতভাবেই হবে তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। জোটগত নির্বাচন হলে সব হিসাব পাল্টে যেতে পারে এমনটাই মনে করছেন তৃণমূলের দলীয় কমান্ডরা। স্থানীয়ভাবে এটি একটি বিশাল কারণ হয়ে উঠবে। গতবার আওয়ামীলীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। আগামী নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এখন থেকেই তিনি তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এ আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকের নামই শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রয়াত সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর ছেলে দেওয়ান শাহনেওয়াজ গাজী মিলাদ, বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, কানাডা প্রবাসী মেজর (অব.) সুরঞ্জন দাশ ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আব্দুল মুকিত চৌধুরীর নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়ার নামও আলোচনায় রয়েছে। তবে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ১/১১ সরকারের সময় তার ভূমিকা নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তার বাবা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হবিগঞ্জ সদর থেকে নির্বাচন করলেও তাদের বাড়ি নবীগঞ্জে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েকটি বলয় গড়ে উঠেছে। একটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি  ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী। শাহনেওয়াজ গাজী মিলাদ গাজী’র নেতৃত্বে সক্রিয় রয়েছে একটি গ্র“প। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী এবং নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট আলমগীর চৌধুরীর নেতৃত্বে আলাদা বলয় কাজ করছে এলাকায়। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন শাহনেওয়াজ গাজী মিলাদ। গতবার তিনিই দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়ায় তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তিনি প্রতিবেদকে বলেন, ‘আমার বাবা এ এলাকা থেকে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুখে-দুঃখে সব সময় এলাকার মানুষের পাশে আছি এবং থাকব। বাবার মৃত্যুর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। পরে নেত্রীর নির্দেশে আমি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেই। আমি আশাবাদী এবার নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেবেন। এলাকাবাসীর প্রতি আমার বিশ্বাস রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেত্রী যদি আমাকে দলীয় মনোনয়ন নাও দেন তারপরও আমি দলের জন্য কাজ করে যাব। কেয়া চৌধুরী প্রতিবেদকে বলেন, ‘আমি হবিগঞ্জের জনগণের সেবায় ছিলাম, আছি এবং থাকব। জনগণের জন্য কাজ করছি বলেই এলাকার মানুষ আমাকে আগামী নির্বাচনে চাচ্ছেন। সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচিত হওয়ার দু’দিন পরই আমি এলাকায় ছুটে আসি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আমি এলাকা ছেড়ে কোথাও যাই না। নানা কর্মসূচি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভা সমাবেশে এলাকার মানুষের সঙ্গেই আছি। ভোটারদের সুখে-দুঃখে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি জনগণের সঙ্গেই থাকতে চাই।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিএনপির সভাপতি শাহ মোজাম্মেল নান্টুর নাম শোনা যাচ্ছে। সুজাত মিয়া প্রতিবেদকে বলেন আমি এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন নিয়ে এর আগে নির্বাচণ করেছি আগামীতে ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে আশাবাদী সব সময় জনগণের পাশে ছিলাম আছি থাকবো। এদিকে নবীগঞ্জে উপজেলা বিএনপির মধ্যে বিভক্তি বছর খানেক ধরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভক্তি দেখা দেয়। বলাবলি হচ্ছে, এ কারণেই গত ইউপি নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২০ ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই দখলে রাখে ১২টি। বাকিগুলোর মধ্যে বিএনপি ৩টি, জাতীয় পার্টি ১টি, স্বতন্ত্র ৪ চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া এ আসনের দুই উপজেলায়ই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। ফলে কোন্দলের বিষয়টি তৃণমূল বিএনপির কপালে চিন্তার ভাজ ফেলেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নবীগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এডভোকেট আলমগীর চৌধুরী ও বাহুবল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই নির্বাচিত হন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে নবীগঞ্জে জামায়াতে ইসলাম এর আমীর মাওলানা আশরাফ আলী ও বাহুবলে ইসলামী ঐক্যজোট নেতা শিহাব উদ্দিন শাকিব বিজয়ী হন। তবে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুটি উপজেলাতেই বিএনপি সমর্থিতরা বিজয়ী হন। এদিকে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে ও দুইজনের নামই জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তিনি হচ্ছেন বর্তমান এমপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু ও  জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হামিদ চৌধুরী। জোটবদ্ধ নির্বাচন হলেও মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মুনিম চৌধুরী বাবু’র মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি উজ্জ্বল বলে জানা গেছে। তবে  জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক লন্ডন প্রবাসী আবদুল হামিদ চৌধুরী’র সমর্থকরাও মাঠে সক্রিয়। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন দিবসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সমর্থকরা আলাদা আলাদাভাবে তাদের প্রিয় নেতার নাম ও ছবি সংবলিত ব্যানার নিয়ে হাজির হতে দেখা যায়। ব্যানারে লেখা থাকে ‘হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে এমপি হিসেবে অমুককে চাই’। প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বর্তমান এমপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ মুনিম চৌধুরী বাবুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দলে আমি একাই প্রার্থী। এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। গত ৪৩ বছরেও এমন উন্নয়ন হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয় আমার নিশ্চিত। সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।’ হবিগঞ্জ-১ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবদুল আজিজ চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান চৌধুরী ছানু মিয়া, ১৯৭৯ সালে জাসদের মাহবুবুর রব সাদী, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের ইসমত আহমদ চৌধুরী, ১৯৮৮ সালে জাসদের অ্যাডভোকেট আবদুল মোছাব্বির চৌধুরী, ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির প্রয়াত খলিলুর রহমান চৌধুরী রফি এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে এমপি হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী। ২০০১ সালে তিনি ফের এমপি হন। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ফরিদ গাজী এমপি হন। এর দু’বছর পর ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর দেওয়ান ফরিদ গাজী মৃত্যু বরণ করেন। পরে ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুর্গে প্রথম হানা দেয় বিএনপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় বিএনপির অন্যতম সদস্য হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি শেখ সুজাত মিয়া। তিনি আসনটি বিএনপিকে উপহার দেন। উপনির্বাচনে বিএনপির এ বিজয় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ওই উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী মাত্র ১২শ’ ভোটে পরাজিত হন। পরে ২০১৪ সালে মহাজোট গঠন হলে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন মুনিম চৌধুরী বাবু।