হত্যাচেষ্টার এক বছর ॥ এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফেরেনি খাদিজা, আর কারাগারে মালির কাজ করছে বদরুল

79

স্টাফ রিপোর্টার :
বহুল আলোচিত হত্যার চেষ্টার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি খাদিজা K-Bবেগম নার্গিস। ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর বিকেলে এমসি কলেজে ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় পুকুরপারে হামলার শিকার হন খাদিজা। এ সময় চাপাতির এলোপাতাড়ি আঘাতে খাদিজার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বছরের ৮ মার্চ সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা মামলার একমাত্র আসামী বদরুল আলমকে অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেন আদালত।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো- বিচারিক প্রক্রিয়ার ১৩২ দিনের মাথায় তথা ১১ কার্যদিবসে আলোচিত এ রায়টি ঘোষণা করেছিলেন বিচারক। এমনকি ৩০ পৃষ্ঠায় পুরো রায়টি আদালতের বিচারক মামলায় লিখে ঘোষণা করেন।
কারাগার সূত্রে জানা যায়- যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত হওয়াতে বদরুল আলম কারাগারে সেই সাজা ভোগ করে যাচ্ছেন। সাজা অনুযায়ী বদরুল কারাগারে বাগানে মালির কাজের পাশাপাশি উৎপাদন শাখায় কাজ করছেন নিয়মিত। এছাড়াও কারাগারের রাইটারের কাজও করছেন বদরুল।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল জানান- যাবজ্জীবন আসাসি হয়ে কারাগারে যেভাবে বদরুলের থাকার কথা সেভাবেই বদরুল রয়েছেন।
বদরুলের সিলেটের আইনজীবী সাজ্জাদুর রহমান বলেন- হতে পারে মামলাটি উচ্চ আদালতে আপিলে রয়েছে। তবে এ সম্পর্কে কোন তথ্য আমার জানা নেই।
সিলেট আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন- শুনেছি আলোচিত এ মামলাটির রায়ের ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে। উচ্চ আদালতেও যেন বদরুলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল থাকে এই প্রত্যাশা রাখি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে খাদিজা হত্যা চেষ্টা মামলায় রায় ঘোষণা একটি দৃষ্টান্ত। এমনকি সেই আলোচিত মামলার রায়ও বিচারক মামলায় লিখে ঘোষণা করে আরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর খাদিজাকে যখন চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছিলেন বদরুল তখন সকলের মনোযোগ ছিল খাদিজার দিকে, কখন প্রাণ জাগবে অচেতন নার্গিসের। সিলেট থেকে ঢাকায় স্কয়ার থেকে সাভারে সিআরপির প্রতিটি দিনের আপডেট সকলে জানতো। আর এই জানার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীকে দোষারোপের যে প্রবণতা তা এক সময় কমবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
হত্যা চেষ্টা মামলার বাদী খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস বলেন- সিলেটে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। বদরুলের পরিবার। উচ্চ আদালতেও যেন বদরুলের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডের রায়টি যেন বহাল থাকে। এই প্রত্যাশাটুকু আমাদের পরিবারের চাওয়া। তিনি জানান- খাদিজা শারীরিক ও মানসিকভাবে এখনও সুস্থ নন। তার চিকিৎসা অব্যাহতভাবে চলছে। খাদিজার পড়াশুনা এখন শুরু হয়নি। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান- চিকিৎসকরা জানিয়েছেন খাদিজা পুরোপুরি সুস্থ হতে ৮-১০ মাস সময় লাগবে। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
আদালত রায় ঘোষণার সময় বলেছিলেন- নারীরা এখন আর বেগম রোকেয়া কথিত অন্দরমহলের অবরোধবাসিনী নন উল্লেখ করে আদালত বলেন- তবে এখন নারীরা অরক্ষিত। নারীরা পদে পদে নিগৃহীত, হত্যা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এজন্য আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতা দায়ী। আদালত উল্লেখ করেন, প্রেম চিরন্তন। প্রেমে মিলন, বিরহ থাকবেই। কিন্তু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এমন পৈশাচিক, নৃশংস আচরণ কাম্য নয়।
৩০ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত উল্লেখ করেন- খাদিজা ‘অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তী নারী’। চাপাতির নৃশংসতায় ক্ষতবিক্ষত খাদিজা দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মৃত্যুও কাছে হার না মানা বিশ্ব নারীসমাজের প্রতিভূ। আর কোন বখাটে ভবিষ্যতে এধরনের কাজ করবে না উল্লেখ করতে গিয়ে আদালত বলেন, বদরুলের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি আরোপের মাধ্যমে ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হাজার হাজার উত্যক্তকারী’ ভবিষ্যতে এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবে।
জানা যায়- ২০১৬ সালে বছরের ৫ অক্টোবর সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় বদরুল। ওই বছরের ৮ নভেম্বর খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরাণ থানার এসআই (সাবেক) হারুনুর রশীদ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ১৫ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট গৃহীত হয়। ২৯ নভেম্বর আদালত বদরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে বদরুলকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন।
৫ অক্টোবর বদরুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদরুলকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। মামলায় ৩৭ সাক্ষীর মধ্যে ৩৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।
সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে বদরুল আলমের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন দন্ড দেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর খাদিজার অবস্থার উন্নতি হলে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর তাঁকে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) ভর্তি করা হয়। ঢাকায় দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে এ বছরের সুস্থ হয়ে গত ২৪ ফেব্র“য়ারি সিলেটে নিজ বাড়িতে ফেরেন খাদিজা বেগম।