জকিগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ ॥ ৪৫ বছরেও প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি নেই

54

জকিগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
আজ ২১ নভেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ শত্র“ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে ১২ ঘন্টা শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধের মাধ্যেমে দিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় অসংখ্য আহত নিহতদের মধ্যে দিয়ে জকিগঞ্জ থানা সদর সহ আশপাশ এলাকা হানাদার মুক্ত করা হয়। এ দিন যথাযথভাবে পালন করতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও লাল সবুজ ছাত্র ফোরাম দিন ব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে পুষ্পস্তর্বক অর্পণ, দোয়া মাহফিল, র‌্যালি ও আলোচনা সভা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের ভয়াল ২১ নভেম্বরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাক বাহিনীর দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস, খনতি বাহীনি যখন সারাদেশে তান্ডব অব্যাহত রেখেছিল তখন একাত্তরো বীরাঙ্গনের নেতৃবৃন্দ সিন্ধান্ত নেন ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই জকিগঞ্জকে মুক্ত করতে হবে। সে মতে একাত্তরের ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলোয় এক গোপনীয় বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের খতমের সিদ্ধান্ত হয়। ২৮ মার্চ  বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ  আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আবদুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আবদুল মোতালেব প্রমুখ প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাক সেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।
সাবেক এমপি মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএলএ আবদুল লতিফ, এমএলএ আব্দুর রহিম, সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত, মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্ণেল বাগচি সহ ভারতের মাছিমপুর ক্যান্টনম্যান্টে জকিগঞ্জকে স্বাধীন করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ঐ পরিকল্পনা ছিল কিভাবে কুশিয়ারার ওপারে ভারতের করিমগঞ্জের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে জকিগঞ্জ দখল করা যায় এবং এ পরিকল্পনা মতই জকিগঞ্জ মুক্ত হয়। আক্রমণের পূর্বে অন্য কেউ এমনকি অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও এ ব্যাপারে জানতেন না। এর নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী, তৎকালীন এমপি আব্দুল লতিফ, ইসমত চৌধুরী ও আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী প্রমুখ।
সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জকে মুক্ত করার পরিকল্পনা অনুসারে ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দল লোহার মহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলসীদের দিকে অগ্রসর হয়। মূল দল জকিগঞ্জের কাষ্টমঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাষ্টম ঘাটে অবস্থান নেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। পাক বাহিনী খবর পেয়ে  দিকবিধিক ছুটাছুটি শুরু করে বর্বর পাক বাহিনী। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দল ভারত থেকে জকিগঞ্জে পৌছে যায়। মূল দল কুশিয়ারা নদীতে সেতু তৈরী করে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তখন জকিগঞ্জ কাস্টমঘাটের নদীরচরে পাক সেনাদের বুলেটে শহীদ হন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী। এ সময় কয়েকজন পাক সেনাকে আটক করা হয়। এভাবেই মুক্ত হয় জকিগঞ্জ। ২০ নভেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর এক সাঁড়াশি অভিযানের ফলে মৃত্যুর মিছিলগুনে ২১ নভেম্বর ভোরে হানাদারমুক্ত হয় জকিগঞ্জ। একুশে নভেম্বর ভোরে জকিগঞ্জের মাটিতেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটকৃত বন্দিদের জকিগঞ্জ থানা থেকে মুক্ত করা হয়। পরদিন জেডফোর্সের অধিনায়ক সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান জকিগঞ্জে প্রবেশ করেন। ঐদিন জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দাউদ হায়দারকে জকিগঞ্জের বেসামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এবং শত্র“মুক্ত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনাম চৌধুরী কে প্রধান করে মুক্তিযোদ্ধা স্পেশাল কামান্ডার মাসুক উদ্দিন আহমদ ও এনামুল মজিদ চৌধুরী কে উপপ্রধান করে ও বর্তমান জকিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিনকে সহকারি কামান্ডার নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্মকান্ড শুরু হয়। কিন্তু আজও জকিগঞ্জ বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। মনে ক্ষোভ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ২১ শে নভেম্বর পালন করছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া।
মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ ছিল ৪নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি ছিলেন এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ৩ এপ্রিল ভারতের করিমগঞ্জে গিযে সেখানকার ডিসি, এসপিসহ আসাম সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশী শরনার্থীদের থাকা খাওয়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।