আল্লাহ্ অস্তিত্বের ধারণা : আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন সূক্ষ্মতত্ত্ব

428

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মূলত হযরত মুসা (আ.) এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নবীগণ যে একত্ববাদের প্রচার করেন তা ছিল পুরা ইসলাম। হযরত মুসা (আ.) ইসলামের যে মর্মবাণী এক ও লা-শরীক আল্লাহ্তে বিশ্বাস, সেদিকে তাঁর কওমকে আহ্বান করেন। বলা বাহুল্য, শুধু মুসা (আ.) কেন আল্লাহ্ প্রেরিত সব নবী রসূলই আল্লাহ্র একত্মবাদের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। আর এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদেরকে মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর আনীত আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে অন্যান্য নবী-রসূল ও তাঁদের উপর অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনের নিুোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য :
“বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ্র উপরে এবং ঐ শিক্ষার উপরে যা আমাদের উপরে নাযিল করা হয়েছে এবং ঐ শিক্ষার উপরে এবং যা কিছু দেয়া হয়েছিল মুসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীগণের উপর তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে, তার ওপরও ঈমান এনেছি। …” “ সূরা ২, আয়াত-১৩৬-১৩৭”। বর্তমান তাওরাত হযরত মুসা (আ.)-এর আনিত দীন ইসলামের নয়। বরঞ্চ ঐ দীন ইসলামেরই বিকৃত রূপ-ইয়াহুদীবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। “সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, সীরাতে আলম (দ্বিতীয় খন্ড), পৃ. ১৩৫”।
“ড. মরিস বুকইলী বর্তমান তাওরাতের উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে উক্ত গ্রন্থ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, “তাওরাতের বিভিন্ন পুস্তক সন্দেহাতীতভাবে বিভিন্ন ঐতিহ্য ভিত্তিক কাহিনীর সমাহার। অবশ্য একথা মানতে হবে যে, লেখকরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ সব ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়ে গেছেন এবং এসব কাহিনীকে তাঁরা পাশাপাশি সাজিয়ে কখনো-সখনো তাঁদের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্যে নানা গল্প-কথা টেনে এনেছেন।” ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ৩১”।
সুতরাং এখন পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, বর্তমানে ইয়াহুদী ধর্মে যে একত্মবাদের পরিবর্তে বহু দেবদেবী এবং পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসূলদের তাঁরা উপাস্য হিসেবে মেনে নিয়েছে- এটা মূলত তাদের মনগড়া চিন্তারই ফলশ্র“তি। আদতে মুসা (আ.)-এর আনীত প্রকৃত তাওরাতের সাথে বর্তমান তাওরাতের মিল খুব কমই পাওয়া যায়। বর্তমান তাওরাতের অনুসারীদের মধ্যে যারা ইয়াহুদী পন্ডিত নামে খ্যাত স্বয়ং তাদের সম্পর্কেই কুরআনে বলা হচ্ছে, “অধিকাংশ ইয়াহুদী আলেম, পীর, দরবেশ লোকদের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ করতো এবং তাদেরকে আল্লাহ্র পথ থেকে সরিয়ে রাখতো।” “সূরা ৯, আয়াত ৩৪”। ইয়াহুদীদের  বাড়াবাড়ি ও পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে কুরআনে অন্যত্র বলা হচ্ছে, ইহুদীরা বলে যে, “হযরত ওযাইর আল্লাহ্র পুত্র।” তারা হযরত মুসা (আ.)-এর একত্ববাদের শিক্ষা ভুলে যেয়ে পয়গম্বরগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা এবং হত্যাকান্ড করতেও কুন্ঠিত না হওয়া, অথবা তাঁদেরকে স্বয়ং আল্লাহ্ কিংবা আল্লাহ্র পুত্র বলে পরিচয় দেয়া ইহুদীদের স্বভাবে পরিণত হয়। “মুফতী মুহামম্দ শাফী, তাফসীর মা’আরেফুল কুরআন, অনুবাদ-মুহিউদ্দীন খান (মদীনা : খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প, ১৪১৩ হি.), পৃ. ৩৪৮”।
উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, “তোমার প্রভু তোমার জন্যে তোমারই মধ্যে থেকে অর্থাৎ তোমারই ভাইদের মধ্যে থেকে আমার মত একজন নবীর আবির্ভাব ঘটাবেন।” এখানে তোমার প্রভু বলতে এক লা-শারীক আল্লাহ্কে বোঝানো হচ্ছে এবং একজন নবী বলতে সেই নবীকে বোঝানো হচ্ছে স্বয়ং কুরআনে যে নবী সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যে, “মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।” সূরা ৩৩, আয়াত-৪০”।
অতএব, এখন একথা বলা যেতে পারে যে, মূল তাওরাতের শিক্ষা ছিল একত্ববাদের দিকে, যদিও পরবর্তীতে উক্ত গ্রন্থে সেই শিক্ষাকে বিকৃত করে বহু দেববাদ ও শিরকবাদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে।
বিশ্বের সমগ্র মানব সমষ্টির একটা বড় অংশ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। বহু দেববাদে বিশ্বাসী হলেও গবেষণায় জানা গেছে যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বৈদিক যুগে মূর্তিপূজা তথা বহু দেব-দেবীর পূজা ছিল না। “সুশান্ত ভট্টাচার্য, বেদ-পূরাণে আল্লাহ্ ও হযরত মুহাম্মদ (সা.), নও-মুসলিম কল্যাণ সংস্থা, ঢাকা : পঞ্চম সংস্কার ১৯৯৭), পৃ.৫৮”। এমনকি পবিত্র বেদে যে ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি রয়েছে সেই শব্দটিকে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রহ্ম’ অর্থাৎ ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। “নূর নবী, আল্লাহ্তত্ত্ব পৃ.৮”  কিন্তু দুঃখের বিষয় উক্ত বেদই আবার ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা করতে দিয়ে দ্বিত্ববাদ, ত্রিত্ত্ববাদ, প্রকৃতিবাদ, বহুদেববাদ, সর্বেশ্বরবাদ প্রভৃতি মতবাদের জন্ম দিয়েছে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে প্রশ্ন জাগে আমরা যে এক, লাÑশরীক আল্লাহকে বুঝি যিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, যিনি যাবতীয় গুণাবলীর আধার পবিত্র বেদে কি সেই ধরণের গুণ প্রকাশক কোন শব্দ নেই? যে শব্দের দ্বারা এক ও লাÑশরীক আল্লাহকে বোঝাবে?
১৩৩৩ সালে কলিকাতার “বসুমতি সাহিত্য মন্দির” থেকে শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক মুদ্রিত এবং উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় “ শ্বেতাশ্বতরোনিষৎ” ঠড়ষ. ১১ নামে যে মূল্যবান গ্রন্থখানা প্রকাশিক হয়েছে সেখানে অন্যান্য বেদের সাথে “অথর্ববেদ” নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে। এই “অথর্ব” বেদে চারখানা উপনিষৎ রয়েছে। যার মধ্যে ‘অল্লোপনিষৎ’ অন্যতম। এই ‘অল্লোপনিষৎ’Ñ ১৯-৩০ পৃ. যে মন্ত্রগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি অন্যতম মন্ত্র হলো,
“হ্রং হোতার মিন্দ্রো হোতা ইন্দ্রো রামা হাসু রিন্দ্রাঃ।
অল্লো জ্যেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমং পূর্ণং ব্রহ্মণ অল্লাম।”
এ মন্ত্রে জ্যেষ্ঠ, পরম এবং পূর্ণ সত্তা বলতে যে অসীম অনন্ত বিশ্ব প্রভুকে বুঝানো হয়েছে, তাঁর আসল নাম “অল্ল” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। “বেদ-পুরাণো আল্লাহ ও হযরত মুহাম্মদ” নামক বই-এ দেখানো হয়েছে যে, সংস্কৃত ভাষায় ‘অল্ল’. বাইবেলে ‘এল’ বা ‘এলী’ এবং কুরআনে ‘আল্লাহ্’Ñ এর নামগুলো একই ধাতু মূল থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে এবং একই তাৎপর্য বহন করছে এবং সেই তাৎপর্য হলো, ‘অল্ল’ ‘এল’ বা ‘এলী’ এবং ‘আল্লাহ্’ হলেন তিনি যিনি অসীম, অনন্ত বিশ্বপ্রভু এবং এই নামটি কোন সময়ে কোন মানুষ, দেব-দেবী, বস্তু বা সত্তার উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়নি। “সুশান্ত ভট্টাচার্য বেদ-পূরাণে আল্লাহ্ ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃ. ৯৫”।
পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলে একই সত্যের আভাস মেলে। আর সেই সত্যটি হলো, বহুদেববাদে বিশ্বাসী আরব মুশরিকরাও ‘সৃষ্টি’র ব্যাপারে এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন দেব-দেবীকে স্থান দিত না।” “সূরা ২৯, আয়াত ৬১, ৬৩ ; সূরা ৪৩, আয়াত ৮৭ ; সূরা ২৩, আয়াত ৮৪-৮৯”।
কিন্তু কালক্রমে হিন্দুরা প্রকৃত শিক্ষাকে ভুলে তারা বহু দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করতে শুরু করে।
প্রাচীন ভারতে ইতিহাস অন্তিমযুগ অন্ধকার এবং অত্যাচারের যুগ হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। সেই অস্তিমযুগ পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দ হতে শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে যে, বৈদিক যুগে মূর্তি পূজা ছিল না পরবর্তীতে সেই মূর্তি পূজা শুরু হয়। যার ফলশ্র“তিতে এক আল্লাহকে কেউ কেউ মাতৃরূপী জননী ভেবে জগদ্ধাত্রী, কালী, দুর্গা, ভৈরবী প্রভৃতি নামকরণ করে। এবং কল্পনায় মাটির মূর্তি তৈরি করে তাদের পূজা অর্চনা করতে থাকে। অনুরূপভাবে কেউ কেউ আল্লাহ্কে পিতৃরূপ কল্পনা করে তাঁর নাম দিয়েছে শিব, মহাদেব, নারায়ণ ইত্যাদি। আদতে আল্লাহ্র পরিবর্তে এই নামগুলোর সবই তাদের মনগড়া বৈ আর কিছুই নয়। “সুশান্ত ভট্টাচার্য, বেদ-পূরাণে আল্লাহ্ ও হযরত মুহাম্মদ (সা), পৃ. ৭৯”।
সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, পবিত্র বেদের মূল আহ্বানই ছিল একত্ববাদের দিকে।
পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম অন্যতম। এই ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে গৌতম বুদ্ধের নাম করা হয়। এই ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ হচ্ছে ত্রিপিটক। সাধারণভাবে বলা হয় এই ধর্ম নিরীশ্বরবাদী।“ নূর নবী, আল্লাহতত্ত্ব, পৃ. ৯”। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়, আর তা হলো, ধর্মে অবশ্যই অতীন্দ্রিয় ও অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস থাকতে হবে। কিন্তু কোন ধর্মে যদি অতীন্দ্রিয় ও অদৃশ্য বিশ্বাসের কথা না থাকে অর্থাৎ সেই ধর্ম যদি নিরীশ্ববাদী হয় তাহলে সেটি কি কোন ধর্ম পদবাচ্য? “সাইয়েদ আবুল হাই, দর্শন ও মনোবিদ্যা পরিভাষা কোষ (দ্বিতীয় খ-), (বাংলা একাডেমী ঃ ঢাকা, ১৯৮৬), পৃ. ৮৬০”।
প্রকৃতভাবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে যে নিরীশ্বরবাদের কথা বলা হয়ে থাকে মনে হয় তা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা বৌদ্ধধর্ম সুপ্রাচীন ধর্মের মধ্যে অন্যতম একটি ধর্ম। এই ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে যার নাম করা হয় অর্থাৎ বুদ্ধ ছিলেন মূলত দুনিয়ার প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন। তাঁর সম্পর্কে এ অনুমান করা হয় যে, সম্ভবত তিনিও নবী ছিলেন। “সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, সীরাতে সরওয়ারে আলম (দ্বিতীয় খ-), পৃ. ২১৪”।
তবে অনেকের মতে, তাঁর আনীত ধর্মকে নিরীশ্বরবাদী বলার কারণ এই হতে পারে যে, তিনি ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদকে অস্বীকার করতেন এবং সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নির্বাক থাকতেন। অবশ্য মানুষে মানুষে যে শ্রেণী বিভেদ করা হত বুদ্ধ তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বুদ্ধ মনে করতেন যে, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও দেবতাদের পূজা অর্চনার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়, মুক্তি নিহিত তার নৈতিকতার উন্নতি সাধনের মধ্যেই। “সাইয়েদ আব্দুল হাই, দর্শন ও মনোবিদ্যা পরিভাষা কোষ (দ্বিতীয় খ-), পৃ. ১০-১০৯”।
যারাথুস্ত্রা কর্তৃক প্রচারিত যারাথুস্ত্রাবাদ একটি সুপ্রাচীন ধর্ম। এ মূল গ্রন্থ আবেস্তা মূল ভাষায় এখন আর বিদ্যমান নেই। “প্রাগুক্ত”। যদিও বলা হয়ে থাকে যে যারাথুস্ত্রাবাদের মূল তত্ত্ব হলো সৎ ও অসৎ এর দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ এই ধর্মকে দ্বৈতবাদী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই ধর্মও যে ছিল একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত তা হাউগ (ঐধঁম) প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। হাউগের মতে, “যারাথুস্ত্রা সৎ ও অসৎ নামক নীতি দু’টিকে কার্যত পরস্পর বিরোধী মনে করতেন না; বরং তাঁর মতে এ দু’টি হলো একই প্রাথমিক সত্তার দুই অংশ বা দুই দিক।” “এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, সাইয়েদ আবুল হাই, দর্শন ও মনোবিদ্যা পরিভাষা কোষ (দ্বিতীয় খ-), পৃ. ১১৭০-১১৭৬; মুহাম্মদ ইকবাল, প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান, অনুবাদকÑ কামালউদ্দিন খান (পূর্ব পাকিস্তান ইকবাল একাডেমী, ঢাকা : ১৩৭২ বাংলা) পৃ. ১-৬”।
এটি আংশিক চীনা ও জাপানীদের ধর্মমত। কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খৃ. পূ.) একজন শাসক ও ধর্ম প্রচারক হিসেবে পরিচিত। তাঁর ধর্মমত কনফুসীয় মতবাদ নামে খ্যাত। অতি
প্রাচীন ধর্ম হওয়ায় যদিও এ ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু জানা যায় না, তবুও অনেক গবেষক মনে করেন, পৌত্তলিকতার পরিবর্তে রাজার উপাসনাই এ ধর্মের মর্মবাণী। “নূর নবী, আল্লাহ্তত্ত্ব, পৃ. ১০”।  কিন্তু মাইকেল এইচ. হার্ট “বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী” নামক গ্রন্থে কনফুসীয় মতবাদের প্রবক্তা কনফুসিয়াস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখান যে, কনফুসিয়াস এক ঈশ্বরের প্রতিই মানুষকে আহবান জানিয়েছিলেন। “কনফুসীয় মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাইকেল এইচ. হার্ট, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী, সংকলকÑমোঃ হুমায়ুন কবীর (সোলেমানিয়া বুক হাউস, বাংলা বাজার, ঢাকা: ২০০১), পৃ. ৩৬২-৩৬৮”।
উপরে পৃথিবীর পাঁচটি বড় বড় ধর্মে আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করা হয়েছে এসব ধর্মের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, আর তা হলো, আদিতে প্রত্যেকটি ধর্মই ছিল মূলত তৌহিদবাদী যদিও কালের পরির্তনে একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মগুলোতে দ্বিত্ববাদী ও বহুত্ববাদী চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে কোন না কোনভাবেই আল্লাহতে বিশ্বাস রয়েছে। তবে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যারা আল্লাহ্তে বিশ্বাস করেন এমন লোকদের মধ্যেও আল্লাহ্র স্বরূপ, শক্তি, সংখ্যা ও গুণাগুণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আল্লাহ্ সম্পর্কিত মতামতের এ বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য মোটামোটিভাবে ফুটে উঠেছে অনেকেশ্বরবাদ, দ্বিÑঈশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদÑএ তিনটি মতবাদে। “বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ঈঁহহরহমযধস এ. ডধঃঃং, চৎড়নষবসং ড়ভ চযরষড়ংড়ঢ়যু (ঘড়ি উবষযর: উরংপড়াবৎু চঁনষরংযরহম ঐড়ঁংব, ১৯৯৩), ঈযধঢ়ঃবৎ-ঢঢঠ.”।
নিম্নে এ তিনটি মতবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং এ প্রসঙ্গে কুরআনের বক্তব্য উল্লেখ করা হলো ঃ
(ক) অনেকেশ্বরবাদ বা বহু ঈশ্বরবাদ : এ মতবাদ বহুদেববাদ নামেও পরিচিত। এ মত বহু স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ঈশ্বর বা দেবতার বিশ্বাসী। এ মতে বিশ্বাসী মানুষের এক এক সমস্যা এক এক দেবতা সম্পাদন করে থাকেন। অতীত কালের ন্যায় বর্তমান কালেও বহুদেববাদে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কম নয়। “আমিনুল ইসলাম, জগৎ জীবন দর্শন, পৃ ১৭৮”।
(খ) দ্বিÑঈশ্বরবাদ : এ মতে বিশ্বাসীরা কল্যাণ ও অকল্যাণের উৎস হিসেবে স্বতন্ত্র স্বভাবের ও পরস্পর বিরোধী দুই দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। “প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৯”। পারসিক ধর্মে এরূপ দু’জন দেবতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়।
(গ) একেশ্বরবাদ ঃ এ মতে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি পূর্ণ স্বভাব ও সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। এ মতবাদ অনুযায়ী বিশ্বের সৃষ্টি, এর স্থিতি, স্থায়ীত্ব, ক্রমবিকাশ, ক্রমোন্নতি, প্রতিপালন, পরিপোষণ, ক্ষয়, লয় প্রভৃতি সকল ব্যাপারেই এক ঈশ্বর তথা আল্লাহ্র কোন সমসক্ষ বা শরীক নেই। “ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০”।
আল্লাহ সম্পর্কিত উপরে যে তিনটি মতবাদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেশ করা হলো এর মধ্যে একেশ্বরবাদ তথা তৌহিদাবাদী মতবাদটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় বহু দেববাদ ও দ্বিÑঈশ্বরবাদ ধারণার যৌক্তিকযোগ্য বলে মনে হয়। আর সেটি হল, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে যেয়ে দেখানো হয়েছে যে, শিরকের তথা বহুদেববাদের অন্ধকারময় আবর্তে সর্বপ্রথম মানুষের ধর্মীয় জীবনের সূত্রপাত হয়। “সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, সীরাতে সরওয়ারে আলম (প্রথম খ-), পৃ. ৩৮”।
অতঃপর ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে এ অন্ধকার দূরীভূত হয় এবং আলোর রেখা উজ্জ্বল হতে থাকে। এভাবে অবশেষে তওহীদ বা এক আল্লাহ্র ধারণায় উপনীত হয়। কিন্তু কুরআন এর সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য পরিবেশন করে বলেছে, দুনিয়ার পরিপূর্ণ আলোকে মানুষের জীবনের সূত্রপাত হয়। আল্লাহ্ সর্বপ্রথম যে মানুষটিকে সৃষ্টি করেছিলেন ঐ প্রথম মানুষটিকে কুরআনের পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে আদম (আ.) এবং প্রথম ঐ ব্যক্তিটিকে তিনি কবেন প্রথম নবী এবং এই এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেন তার জোড়া। অতঃপর ঐ জোড়ার বংশ ধারা চালু করেন। শত শত হাজার হাজার বছর ধরে তা চলতে চলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীতে যত মানুষ জন্ম নিয়েছে সবাই ঐ প্রথম জোড়াটির সন্তান।
সকল জাতির ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বর্ণণাধারা এক বাক্যে ঘোষণা করে যে, একজন মানুষ থেকেই মানুষ জাতির বংশ ধারার সূচনা হয়। বিজ্ঞানের অনুসন্ধান থেকেও একথা প্রমাণিত হয়নি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় পৃথক পৃথক মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল। বরং অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক এ ধারণা পোষণ করেন যে, প্রথমে একজন মানুষই জন্মে থাকবে এবং দুনিয়ার যেখানেই যত মানুষ পাওয়া যাবে সবাই ঐ একজন মানুষেরই সন্তান। “এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ড. মরিস বুকাইলি, মানুষের আদি উৎস, অনুবাদÑআখতার উল-আলম (জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা: তৃতীয় প্রকাশ, ১৯৯৬”।
কিন্তু পরবর্তীতে হযরত আদম (আ.)-এর সন্তানদের মধ্যে যারা ছিল ভাল ও সৎ তারা পিতার নির্দেশিত সোজা পথে চলতে থাকে। কিন্তু যারা অসৎ ছিল তারা এ পথ ত্যাগ করে ধীরে ধীরে সব রকমের অন্যায় ও অপকর্মের জন্ম দেয় এবং চাঁদ, সূর্য, তারকা, বৃক্ষ, পশু ইত্যাদির উপাসনায় মগ্ন হয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন বলেছে, “শুরুতে সব মানুষ একই পথে চলছিল। (তারপর এ অবস্থা অব্যাহত থাকল না এবং মতবিরোধ দেখা দিল) অতঃপর আল্লাহ নবী পাঠালেন, তারা ছিলেন (সত্য-সোজা পথ অবলম্বনকারীদের জন্য) সুসংবাদ দানকারী এবং (বক্র-ভুল পথ অবলম্বনের পরিণাম সম্পর্কে) ভীতি প্রদর্শনকারী। তাদের সাথে নাযিল করেন সত্য গ্রন্থ। যাতে সত্যের ব্যাপারে লোকদের মধ্যে যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল সে সম্পর্কে ফয়সালা করা যায়। আর এ মতবিরোধ দেখা দেবার কারণ এটা নয় যে, শুরুতে তাদেরকে সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি………।“সূরা ২, আয়াত ২১৩”।
পবিত্র কুরআন পর্যালোচনা করলে বহুদেববাদ, দ্বিÑঈশ্বরবাদ প্রভৃতি মতবাদ যে অসার এবং অযৌক্তিক তা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় দেখানো হয়েছে। কুরআনে বলা হচ্ছে, “আসমান যমীনে যদি আল্লাহ্ ছাড়া আরও ইলাহ থাকতো, তবে বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ওলট-পালট হয়ে যেত।” “সূরা ৭৮, আয়াত ২২”।
বিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে আজ অবধি বিশ্ব ব্যবস্থাপনা একই নিয়মের অধীনে চলছে। আজ পর্যন্ত এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। যদি একের অধিক আল্লাহ্ থাকতো তাহলে অবশ্যই যে বিশ্বব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা যেত সেই কথাটি উপরের আয়াতে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে অন্যত্র বলা হচ্ছে, “বল, আল্লাহ্র সাথে যদি অন্য ইলাহ্ হতো, যেমন লোকেরা বলছে, তাহলে তারা আরশ অধিপতির রাজত্ব দখল করার জন্যে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করত।” “সূরা ১৭, আয়াত ৪২-৪৩”।
মানুষেরা যেসব জিনিষকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করে, আল্লাহ্র সাথে শরীক করে সে সমস্ত জিনিসও সৃষ্ট। যেমন সূর্য, চন্দ্র, বাতাস, পানি, সাপ, বড় বড় গাছ ইত্যাদি। সৃষ্টি যে কোন দিন স্রষ্টা হতে পারে না, সৃষ্টিকে স্রষ্টা অংশীদার ভাবা যে সাংঘাতিক ভাবে অযৌক্তক তা কুরআনে উপমার মাধমে বলা হচ্ছে। কুরআনে বলা হচ্ছে, “তোমাদের আমি যে রূযী দিয়েছি, তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস-দাসীরা কি তাতে তোমাদের সমান সমান অংশীদার? তোমরা কি তাদেরকে সেরূপ ভয় কর, যেরূপ নিজেদের লোককে ভয় কর?” “সূরা ৩০. আয়াত ২৮”।
এখানে মহান আল্লাহ্ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বোঝাচ্ছেন, গোলাম ও মালিক যেমন একই মর্যাদার অধিকারী নয় তেমনি স্রষ্টা ও সৃষ্টি একই মর্যাদার অধিকারী নয়। অর্থাৎ সৃষ্টিকে স্রষ্টার আসনে বসানো বা স্রষ্টার সাথে অংশীদার বানানো চরম মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আসলে মানব প্রকৃতির মধ্যেই এক আল্লাহ্র স্বীকারোক্তি বিদ্যমান। কিন্তু সত্যকে জানা সত্ত্বেও যারা অসৎ পথ অবলম্বন করে তারা ধীরে ধীরে বহু দেব-দেবীর আরধনায় মশগুন হয়ে পড়ে। আর মূলত মানুষের সামনে হারিয়ে যাওয়া সত্য পথটি আবার সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্যই যুগে যুগে আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠান। “সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, সীরাতে সরওয়ারে আলম (১ম খ-), পৃ. ৩৮”।
তৎকালীন আরব সমাজের মুশরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাসের দিকে লক্ষ্য করে কুরআন বলছে, “যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর তাদের কে পয়দা করেছে? তাহলে তরা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ্।” “সূরা ৪৩, আয়াত ৮৭”।
সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, বহুদেববাদ ও দ্বিÑঈশ্বরবাদ গ্রহণযোগ্য কোন মতবাদ নয়। বরং এ মতবাদদ্বয় মানব প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক।
উপরে ‘একত্ববাদের ধারণ’ সংক্রান্ত বিষয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, দ্বি-ঈশ্বরবাদ ও বহু ঈশ্বরবাদ নয় বরং একেশ্বরবাদই অধিক যুক্তিযুক্ত। এবং মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটি ওঠে সেটি হলো, এই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র সাথে জীব ও জগতের সম্পর্ক কী? অর্থাৎ আল্লাহ্ এই জগতের অন্তরে না এই জগতকে অতিক্রম করে আছেন? এই মূল প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত মতবাদের “বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আমিনুল ইসলাম, জগৎ দর্শন, পৃ. ১৮৮-১৯৪; শ্রী প্রমোদবন্ধু সেগুপ্ত, পাশ্চাত্য দর্শন, পৃ. ৩৩০-৩৪৫”।
সৃষ্টি হয়েছে তা হলো : (১) অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ (উবরংস), (২) সর্বেশ্বরবাদ (চধহঃযবরংস), (৩) সর্বধরেশ্বরবাদ (চধহবহঃযবরংস) ও (৪) ঈশ্বরবাদ (ঞযবরংস)। নিম্নে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো ঃ
(১) অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ (উবরংস) ঃ এই মতবাদ অনুযায়ী আল্লাহ সম্পূর্ণভাবে এই জগৎকে অতিক্রম করে আছেন (এড়ফ রং যিড়ষষু ঃৎধহংপবহফবহঃ)।
(২) সর্বেশ্বরবাদ (চধহঃযবরংস) ঃ এই মতবাদ অনুসারে আল্লাহ সম্পূর্ণ জগতের অন্তর্বর্তী বা জগতের অন্তরে আছেন (এড়ফ রং যিড়ষষু রসসবহবহঃ)।
(৩) সর্বধরেশ্বরবাদ (চধহবহঃযবরংস)-ও ঈশ্বর (চধহঃযবরংস) এই দুই মতবাদ অনুসারে আল্লাহ জগতের অন্তর্বর্তী ও অতিবর্তী উভয়ই। আল্লাহ জগতকে অতিক্রম করে আছেন এবং জগতের অন্তরেও আছেন। (এড়ফ রং নড়ঃয রসসধহবহঃ ধহফ ঃৎধহংপবহফবহঃ)।
তবে উভয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলোÑ ঈশ্বরবাদীদের মতে, আল্লাহ একাধারে জগতের অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী বটে। তবে তিনি পুরাপুরিভাবে জীবকুলের অতিবর্তী। কিন্তু সবধরেশ্বরবাদীদের মতে, আল্লাহ্ যেভাবে জগতের অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী, ঠিক একইভাবে জীবকুলেরও অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী। কিন্তু অতিবর্তী ঈশ্বরবাদও সর্বেশ্বরবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। উভয় মতই চরম বলে মনে
হয়। অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ মেনে নিলে আল্লাহ্কে একজন যন্ত্র নির্মাতার সাথে কল্পনা করতে হয়। যিনি এই জগতরূপ বিশাল যন্ত্রটিকে তৈরি করে জগতের বাইরে চলে গেছেন। আর আল্লাহ্ ছাড়া যদি জগত আপনা আপনিই চলতে পারে তাহলে আল্লাহ্র প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না। অপর পক্ষে, সর্বেশ্বরবাদকে এক শূণ্যগর্ভ মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা, এই মতবাদ বহুকে উপেক্ষা করে কেবল এককে স্বীকার করে। কিন্তু বহুকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র একের ধারণা শূন্যগর্ভ। এই মতবাদে জীব ও আল্লাহ্ এক অভিন্ন। এখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু পার্থক্যকে কেন্দ্র করেই ধর্মের অস্তিত্ব সম্ভব। তাই এই মতবাদ ধর্ম সম্পর্কীয় অনুভূতির কোন যক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অপরদিকে সর্বধরেশ্বরবাদ মতবাদটিকে গ্রহণযোগ্য বলা যেতে পারে। এই মতবাদ অনুযায়ী আল্লাহ্ একই সাথে জীব ও জগতের অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী। পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর মতে, জগতের শুধু বাইরে নয়, জগতের মধ্যেও এবং জগতের কর্মকান্ড পরিচালনায় নিয়ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন।” “আমিনুল ইসলাম, জগৎ জীবন দর্শন, পৃ. ১৮৯”।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, মহান আল্লাহ্পাক আসমান ও যমীনকে সৃষ্টি করে যেমন সিংহাসনে আসীন হয়েছেন তেমনি তিনি সর্বদাই জীবকুলের নিকটবর্তী হয়ে প্রত্যেকটি জীবের কর্মবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনের কিছু বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য ঃ “তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টন করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়।” “সূরা ২, আয়াত ২৫৫”।
“পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহ্রই। অতএব, তোমরা যে দিকেই মুখ ফেরাও, সে দিকেই আল্লাহ্ বিরাজমান।” “সূরা ২, আয়াত ১১৫”।
“নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা নিকটেই আছেন তিনি আহবানে সাড়া দেন।” “তিনি তোমাদের সাথেই আছেন, তোমরা যেখানেই থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।” “সূরা ১১, আয়াত ৬১।” “… আমি তার গ্রীবস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” “সূরা ৫০, আয়াত ১৬”।
বস্তুতপক্ষে এটা বলা যেতে পারে, আত্মা যেমন বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজকে প্রকাশ করে কিন্তু তাই বলে মানসিক প্রক্রিয়ার সমষ্টি যেমন আত্ম নয় তেমনি সসীম বস্তু ও শান্ত জীবের সমষ্টিই আল্লাহ্ নন। বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ্ জগতের মধ্যে থেকেও জগতের বাইরে রয়েছেন। যে আল্লাহ্ একাধারে জগতের বাইরে থেকেও জগতের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া করে চলেছেন তাঁর প্রকৃতি কী, এটা আলোচনা করা অতীব জরুরী বিধায় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির নিরীখে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হচ্ছে।
কোন জিনিসের স্বরূপ বা প্রকৃতি (ঘধঃঁৎব) যেমন সেই জিনিসের গুণাবলীর মাধ্যমে জানা যায় তেমনি আল্লাহ্র স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হলেও তা আল্লাহ্র গুণাবলীর মাধ্যমে জানতে হবে। “ড. এম. হুদা, সাধারণ দর্শণের মূলতত্ত্ব (এম.বি.প্রিন্টিং পাবলিকেশন্স, ঢাকা : দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯০), পৃ. ২৮৪”।
বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্কে যেমন বিভিন্নভাবে গ্রহণ করা হয়েছে তেমনি দর্শনের কোথাও আল্লাহ্কে ‘নিছক একটি শক্তি’ অথবা ‘প্রথম বা আদি নিমিত্ত’ (ঋরৎংঃ পধঁংব) অথবা ‘বিশ্বজাহানের আত্মা’ আবার কোথাও আল্লাহ্ এই বিশ্বজাহানের কারখানটিকে একবার চালিয়ে দেবার প্রয়োজন পূর্ণ করে (তাঁর সৃষ্টি থেকে) পৃথক হয়ে গেছেন “জন ক্লোভার মোনজ্মা, চল্লিশ জন সেরা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব, “ভূমিকা”।
এমন ধারণা করা হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য এই সবের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রকৃত স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানার্জন সম্ভব নয় বলে মনে হয়। তাছাড়া যাকে আল্লাহ্ বলে স্বীকার করা হবে তিনি যদি শুধুমাত্র উপরোক্ত প্রকৃতি সম্পন্ন হন তাহলে একজন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন এবং মেধাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে তার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যাকে আল্লাহ্ বলে স্বীকার করা হবে তাঁকে হতে হবে সর্বগুণে গুণান্বিত এক সত্তা আল্লাহ্র স্বরূপ বা প্রকৃতি কী? এর যথার্থ জবাব আর-কুরআনে সবিস্তারিত ও সম্পূর্ণাঙ্গ রূপে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কুরআনে এই বিষয়ে এত বেশি আলোচনা করা হয়েছে যে, এতটুকুন ছোট্ট পরিসরে এতদসম্পর্কিত ধারণা পেশ করা দুরূহ। তাই নিম্নে এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারণা পেশ করা হচ্ছে।
যে প্রকৃতি সম্পন্ন হওয়ার জন্য কোন সত্তাকে আল্লাহ্ বলে গণ্য করতে হবে তাঁর প্রথম পরিচয় হল সেই সত্তার অবশ্যই সৃষ্টি করার যোগ্যতা থাকতে হবে। “সূরা ৯৬, আয়াত ১”।
তবে একজন মানুষ যখন প্রকৃতির কোন জিনিসের সহযোগিতায় কোন যন্ত্র তৈরি করেন তখন তাঁকে স্রষ্টা (ঈৎবধঃড়ৎ) বলা যায় না। বরং তিনি একজন আবিষ্কার্তা (ওহাবহঃড়ৎ)। স্রষ্টার গুণসম্পন্ন তাঁকেই বলা যাবে যিনি কোন কিছুর সাহায্য ছাড়া যখন, খুশী, যেমন খুশী, যেভাবে খুশী, যা খুশী, তা সৃষ্টি করতে পারবেন। সেদিক থেকে আল্লাহ্ই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। মহান আল্লাহ্ কুরআনে বলেন, “নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। ..— শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা ও আদেশ দান করা।” “সূরা ৭, আয়াত ৫৮”।
কুরআন অন্যত্র বলা হচ্ছে, “আল্লাহ্ সব কিছুই স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহন করেন।” “সূরা ৩৯, আয়াত ৬২”।
বলা বাহুল্য, সৃষ্টিকর্মে আল্লাহ্র কোন সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু ইচ্ছা হলেই তিনি তৎক্ষণাৎ কোন কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম।” “সূরা ১৬, আয়াত ৪০”।
যিনি স্রষ্টা হবে তিনি সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হবেন না। তিনি সৃষ্টির জণ্য নির্ভুল বিধান প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখবেন। তাইত কুরআনে বলা হচ্ছে, “আমি বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াতের বিধান তোমাদের কাছে পৌছাবে তখন যারা সেই বিধানের অণুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয়, দুঃখ বেদনা।” “সূরা ২, আয়াত ৩৮”।
আল্লাহ্কে অবশ্যই স্বয়ম্ভূ ও চিরন্তর হতে হবে। অথাৎ তাকে অবশ্যই তার নিজের অস্তিত্বের কারণ হতে হবে। তাঁর অস্তিত্ব কারও উপর নির্ভর করবে না। “সূরা ১১২,; সূরা ৫৭, আয়াত ৩”।
আল্লাহ্র অবশ্যই এই জগতের উপর আধিপত্য থাকতে হবে, তাঁকে সর্বস্থানে বিদ্যমান থাকতে হবে এবং প্রত্যেক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় সম্পর্কে তাঁকে অবশ্যই অবগত থাকতে হবে। “সূরা ৩, আয়াত ১৮৯; সূরা ৮৫, আয়াত ১৬; সূরা ৪, আয়াত ২৬; সূরা ২, আয়াত ১১৫; সূরা ৪, আয়াত ১১”।
তাঁকে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ বিচক্ষণতা তথা প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হবে যাতে তিনি মানুষের সব ধরণের কর্মকান্ড বিশেষ করে নৈতিক কর্মের নির্ভুল পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। “সূরা ৪৫, আয়াত ৩৭; সূরা ৭৬, আয়াত ৩০”।
তাকে হতে হবে সকল দোষত্রুটি, দুর্বলতা ও অক্ষমতা থেকে মুক্ত। “সূরা ১২, আয়াত ১০৮; সূরা ৩৭, আয়াত ৮০”।
জীবন ও মৃত্যু থাকবে তাঁরই করায়ত্বে। “সূরা ৭, আয়াত ১৫৮; সূরা ৯, আয়াত ১১৬”।
উপরোক্ত গুণাবলী ছাড়া অসংখ্য গুণাবলী রয়েছে মহান আল্লাহ তা’আলার; যে গুণাবলী মাধ্যমে আল্লাহর প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যেতে পারে। কিন্তু এত ছোট পরিসরে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া কঠিন। সেই সমস্ত গুণাবলীর নাম, সূরা এবং তৎসংক্রান্ত কিছু কিছু আয়াত নিম্নে উল্লেখ করা হচ্ছে ঃ  তিনি এক, তাঁর সমকক্ষ নেই (১২২ ঃ ১); তিনি কারো সন্তান নন এবং তাঁর সন্তানও কেউ নয় (১১২ ঃ ৩); তিনি তওবা কবূলকারী (৯ ঃ ১০৪, ২৪ ঃ ১০, ৪৯ ঃ ১২); তিনি ধৈর্যশীল (১৭ ঃ ৪৪, ২২ ঃ ৫৯); তিনি রিযিক দাতা (৬২ ঃ ১১) শ্রবণকারী (৭ ঃ ২০); গোপন ও প্রকাশ্য সম্পর্কে জ্ঞান (৯ ঃ ৯৪); তিনি প্রবল ক্ষমতাশালী (৮ ঃ ১০); তিনি অনুগ্রহকারী (২৫ ঃ ২৮); কেউ তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয় (৮ ঃ ৪৭); প্রতিটি জিনিসের উপর তাঁর জ্ঞান পরিব্যপ্ত (৭ ঃ ৮৯); তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ (২০ ঃ ১১৪); তিনি সর্বজয়ী (৩৫ ঃ ২)
একক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্র ধারণা, একত্ববাদ, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হলো। এখন আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। তবে এখানে একটা বিষয় প্রথামেই বলে নেয়া প্রয়োজন আর সেটি হলো, প্রকৃতপক্ষে, স্থানÑকালে কোন জাগতিক বস্তুকে যেভাবে প্রমাণ করা যায় আল্লাহ্র অস্তিত্বের বিষয়টি ঠিক সেভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে জাগতিক কোন বস্তুর মত আল্লাহ্র প্রমাণের বিষয়টি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় না বলে একথা বলা যাবে না যে, আল্লাহ্র বুঝি অস্তিত্ব নেই। কেননা, আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ অভিজ্ঞাতাভিত্তিক নয় তেমনি আল্লাহ্র অনস্তিত্বকেও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় না। এটি আসলে হৃদয় মনে উপলব্ধির বিষয়। এরপরও দার্শনিকরা দাশনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নিম্নে দর্শন ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ ছাড়াও কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
দার্শনিকগণ আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ “আরো দেখুন, ঈঁহহরহমযধস এ. ডধঃঃং, চৎড়নষবসং ড়ভ চযরষড়ংড়ঢ়যু, ঢ়ঢ়. ৪১৩-৪১৮; উৎ. অনফঁষ ঔধষরষ গরধ অ ঈড়ঃবসঢ়ড়ৎধৎু চযরষড়ংঢ়যু ড়ভ জরষরমরড়হ (ওংষধসরপ ঋড়ঁহফধঃরড়হ, উযধশধ: ১৯৮২), ঈযধঢ়ঃবৎ-ঠওও. ”।
দিতে যেয়ে যে সমস্ত যুক্তির অবতারণা করেছেন সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে উপস্থাপন করা হল ঃ
প্রথমত, তত্ব বিষয়ক যুক্তি ঃ এই যুক্তিটির মূল বক্তব্য হলো, আল্লাহর ধারণার (ওফবধ ড়ভ এড়ফ) মধ্যেই আল্লাহ্র বাস্তবতা (জবধষরঃু ড়ভ এড়ফ) নিহিত। এখানে চিরন্তর বা ধারণা থেকে অস্তিত্বের উপনীত হওয়া বা অস্তিত্বের সিন্ধান্ত করাই হল যুক্তিটির সার কথা।
দ্বিতীয়ত, আদিকারণ বিষয়ক যুক্তি : এই যুক্তিটির মূল বক্তব্য হলো, বিনা কারণে কোনো কার্যের উদ্ভব সম্ভব নয়। কাজেই এই সৃষ্ট জগতেরও কোন কারণ আছে। সৃষ্ট জগতের কারণ কোন সসীম বস্তু
হতে পারে না। কেননা তাহলে তার আবার অন্য কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। জগতের কারণ অসীম (ওহভরহরঃব) হওয়া প্রয়োজন। এই কারণ হলে আল্লাহ্।
তৃতীয়ত, উদ্দেশ্য সম্বন্ধীয় যুক্তি ঃ  এই যুক্তিটির মূল বক্তব্য হলো, এ বিশ্বের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি ঘটনায় এক উদ্দেশ্যের পরিষ্কার প্রমাণ দেখা যায়। আর যেখানে উদ্দেশ্য আছে সেখানে সচেতন বুদ্ধির পরিচালনাল প্রশ্ন আছে; অতএব, জগতের পরিচালক হিসেবে, জগতের মহাপরিকল্পক হিসেবে এক অনন্ত ও অসীম আল্লাহ্র অস্তিত্ব রয়েছে।
চুতুর্থ, নৈতিক যুক্তি ঃ এই যুক্তিটির মূল বক্তব্য হলো, সাধারণত দেখা যায় এ জগতের ধার্মিকগণ প্রায়ই অসুখী থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে ধার্মিককে সুখী করা সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে এ কাজ কার? একমাত্র আল্লাহ্ই ধার্মিকতা ও সুখের সমন্বয় সাধন করতে পারেন। ধার্মিক ব্যক্তি ইহজীবনে সুখী না হলেও পরজীবনে আল্লাহ্ তাকে সুখী করতে পারেন। অতএব, আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়।
আল্লাহ্র অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ব্যাপারে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, পরীক্ষাগারে বা বাস্তব যাচাই পদ্ধতিতে কোন জিনিসকে যেমন প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায়, আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণটি ঠিক সেরকম নয়। তবে একথা ঠিক নয় যে, অদৃশ্যে বিশ্বাসের নাম বিজ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয়েই মধ্যেই অদৃশ্যের কার্যকারিতা রয়েছে। “ড. ওয়াহীদুদ্দীন খান, আধুনিক চিন্তাধারা বনাম ধর্ম, পৃ. ৪০”।
ধর্মের মূূল চক্ররেখা চূড়ান্ত বাস্তবতা নির্ণয়ের দিক নির্দেশ করে, অপরদিকে বিজ্ঞান ততক্ষণ পর্যন্ত দৃশ্যমান জ্ঞান, যতক্ষণ তা প্রাথমিক ও বাহ্যিক বিষয় সম্পর্কে কথা বলে। আর যখন তা বস্তুর চূড়ান্ত ও প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ের উদ্যোগ নেয়Ñযা মূলত ধর্মের রাজ্যভুক্ত তখন তাও ঠিক সেভাবে অদৃশ্য বিশ্বাস এর পন্থা অনুসরণ করে। উদাহরণস্বরূপ মাধ্যাকর্ষণ নীতির কথা বলা যায়। হরহামেশা আমরা দেখি একটি পাখি মরে গেলে মাটিতে পড়ে, একটি পাথরকে মাটি থেকে উঠাতে গেলে শক্তি খরচ হয়, তেমনি পাহাড় থেকে নামার তুলানায় পাহাড়ে উঠা কঠিন। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই আমাদের সামনে আসে, সেগুলোর মধ্যে বাহ্যত কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু উপরে উল্লিখিত ইন্দ্রিয়নুভূত ঘটনারাজি এবং যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবতাসমূহকে একসাথে মিলিয়ে দেখলে সবকিছুর মধ্যে একটা শৃঙ্খলা পরিদৃষ্ট হয়; যার নাম দেয়া যায় মাধ্যাকর্ষণ নীতি। যদিও এই নীতি কখনও বাস্তবে পরিদৃষ্ট চক্ষুষ বস্তু নয়, বিজ্ঞানীরা যে জিনিসটি দেখেছেন, পরীক্ষা করেছেন, তা স্বয়ং আকর্ষণ নীতি নয় বরং অন্য কিছু যাকে তারা যুক্তির খাতিরে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং স্বীকার করেছেন যে, এর মধ্যে এমন কোন বস্তু বিদ্যামান, যাকে তারা মাধ্যাকর্ষণ নীতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন।
এই জন্য বলা যায়, বিজ্ঞান যেমন দৃশ্যমান বস্তুকে স্বীকার করে তেমনি অদৃশ্যমান বিষয়ের উপরও বিশ্বাস করে। অদৃশ্যমান বিষয়গুলোর প্রতি যদি আস্থা বা বিশ্বাস করা না হয় তাহলে মাধ্যাকর্ষণ নীতি, পরমাণুর অস্তিত্বের ধারণা- সব মিথ্যা হয়ে যেত।
আসলে একটি অদৃশ্য বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার ফলাফলের কারণে বিজ্ঞানীরা সুদৃঢ বিশ্বাস পোষণ করে পরোক্ষভাবে একথার স্বীকৃতি দেন যে, যে সমস্ত বাস্তবতার উপর আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি, আদিতে তা একটি কল্পিত (ঐুঢ়ড়যঃবঃরপধষ) সিন্ধান্তই হয়ে থাকে। অতঃপর যখন ক্রমান্বয়ে নুতন নতুন বাস্তবতা প্রতিভাত হয়ে এই সিন্ধান্তের সত্যতা প্রমাণিত হতে থাকে তখন তা বাস্তবতা রূপ প্ররিগ্রহ করে, এমনকি শেষ পর্যন্ত আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাসে পরিণত হয়। “প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২”।
ঠিক একই ভাবে আল্লাহ্কে প্রমাণ করতে গিয়ে এরূপ করা হয়না যে, কোন দূরবীক্ষণ যন্ত্রের
গরধ, অ ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ জরষরমরড়হ (ওংষধসরপ ঋড়ঁহফধঃরড়হ, উযধশধ: ১৯৮২), ঈযধঢ়ঃবৎ-ঠওও.
সাহায্যে স্বয়ং আল্লাহ্কে দেখিয়ে দেওয়া হয়, বরং এভাবে এর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, সৃষ্টিরাজির নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য একথার প্রমাণ যে, এর পিছনে কোন প্রজ্ঞাময় সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। এভাবে আমাদের যুক্তি সরাসরি আল্লাহ্ না মেনে পারা যায় না। উপরোক্ত কথাগুলো সামনে রেখে আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণের জন্য কুরআন উল্লিখিত কিছু বিজ্ঞান ভিত্তিক আয়াতের পর্যালোচনা করে উক্ত আয়াতগুলো যে বিজ্ঞানের বক্তব্যের সাথে হুবহু সাদৃশ্যমান-এর ভিত্তিতে আল্লাহ্র অস্তিত্বের বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রমাণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হবে। কেননা কুরআনের বক্তব্য যদি প্রবক্তা তিনি স্বয়ং আল্লাহ্। কেননা কুরআন এখন থেকে দেড় হাজার বৎসর পূর্বে নাযিল হয়েছে, আর বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যা দিচ্ছেÑ যা কুরআনের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে তা মাত্র একশত বৎসর পূর্বেই প্রমাণ। তবে এখানে একটি বিষয় প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হচ্ছে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য সম্বলিত কুরআনের বাণী সংখ্যায় সুপ্রচুর। এত ছোট পরিসরে তার সবটুকু কেন সামান্য অংশও উল্লেখ করা মুশকিল। এখানে সংক্ষেপে মাত্র তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করা হলো ঃ
প্রথমত, পানির প্রসঙ্গটি উল্লেখযোগ্য। কুরআনের দু’টি জায়গায় পানির একটি বিশেষ নীতি প্রকৃতির বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, “তিনিই দুই দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটির পানি মিষ্টি, সুপেয় এবং অপরটির পানি লোনা, খরÑ উভয়ের মধ্যে তিনি রেখে দিয়েছেন এক অন্তরাল, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।” “সূরা ২৫, আয়াত ৫৩”।
অন্য জায়গায়, “তিনি প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া যারা পরস্পর মিলিত হয়, কিন্তু ওদের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা ওরা অতিক্রম করতে পারে না। “সূরা ৫৫, আয়াত ১৯-২০”।
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে পানির যে বহিঃপ্রকাশের উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রাচীনতম যুগ থেকে মানুষের জানা থাকলেও এই ঘটনা প্রকৃতির কোন নিয়মের অধীনে ঘটে চলছে তার কারণ অতি সম্প্রতি জানা গেছে। আধুনিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, তরল পদার্থের মধ্যে পৃষ্ট প্রসারণ (ঝঁৎভধপব ঞবহংরড়হ)-এর একটি বিশেষ নিয়ম রয়েছে এবং এই নিয়মই উভয় প্রকার পানিকে পৃথক রাখে। উক্ত আয়াতদ্বয়ে যে বরযাখ বা অন্তরাল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত পৃষ্ঠ প্রসারণ (ঝঁৎভধপব ঞবহংরড়হ)-এর দিকেই ইংগিত করছে। “ড. ওয়াহীদুদ্দীন খান, আধুনিক চিন্তাধারা বনাম ধর্ম, পৃ. ১৫৯”।
দ্বিতীয়ত, রাত ও দিনের আবর্তন সংক্রান্ত প্রসংঙ্গটি উল্লেখ করা যায়। কুরআনে বলা হচ্ছে, “তিনি দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাতে ওদের একটি অন্যটিকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে।” “সূরা ৭, আয়াত ৫৬৪”।
এই আয়াতে রাত ও দিনের বাহ্যিক আগমন-নির্গমনের কথা বলা হলেও পৃথিবীর আপন কক্ষপথে পরিভ্রমলের একটি অতি সুন্দর ইঙ্গিত রয়েছে। যা আধুনিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার প্রথম মহাশূন্য ভ্রমণকারীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা যায়। আর তা হলো, তিনি মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে এই রূপে দেখেছেন যে, সূর্যের সম্মুখে আপন অক্ষের উপর আবর্তিত হওয়ার কারণে তার উপর আলো ও আঁধারের আগমন নির্গমনের একটি দ্রুত ধারাবহ (জবঢ়রফ ঝঁপপবংংরড়হ) অব্যাহত রয়েছে। “ড. ওয়াহীদুদ্দীন খান, আধুনিক চিন্তাধারা বনাম ধর্ম, পৃ. ১৬১। আরো দেখুন, ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল”।
তৃতীয়ত, মহাশূন্য বিজয়ের কথা বলা যায়। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘হে জ্বীন ও মানবমন্ডলী, যদি তোমরা প্রবেশ করতে পার আসমান ও যমিনের এলাকায়, তাহলে তাতে প্রবেশ কর। তোমরা এতে প্রবেশ করতে পারবে না মহাক্ষমতা ব্যতিরেকে।’ “সূরা ৫৫, আয়াত ৩৩”।
উপরোক্ত আয়াতে যে শর্তে (যদি) কথা বলা হয়েছে তা অর্জিত হতে পারে এমন কথা বোঝাচ্ছে। কেননা ‘যদি’ বুঝাতে আরবীতে ‘ইজা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে তা অর্জন করা সম্ভব নয় বোঝায়। উপরোক্ত আয়াতে ‘ইন’ শব্দটি দ্বারা এমন এক যদির ধারণা দেওয়া হয়েছে যা অর্জনযোগ্য। এ প্রসঙ্গে ড. মরিস বুকাইলী বলেন,
“মহাশূন্য বিজয়ের কর্মসূচীতে এই মানুষেরা যে মহাক্ষমতার (সুলতান) বলে সাফল্য অর্জন করবে, ধারণা করা যেতে পারে যে, সেই ক্ষমতা আসবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র তরফ থেকে।” “ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ২৬৯”।
কুরআনে বর্ণিত অসংখ্য বিজ্ঞান ভিত্তিক আয়াতের মধ্যে এখানে মাত্র দু’একটি আয়াত পেশ করা হলো যা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। যদি আল্লাহ্ বলে সত্তা না থাকেন তাহলে এখন থেকে দেড় হাজার বৎসর পূর্বে সম্পূর্ণ অক্ষর জ্ঞানহীন একজন মানুষের দ্বারা এমন বক্তব্য পেশ করা আদৌ সম্ভব নয়। আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণকে ‘জাগতিক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক প্রমাণ’, ‘উদ্দেশ্যমূলক প্রমাণ’, ‘আত্মিক চেতনা ভিত্তিক প্রমাণ’ এবং ‘প্রত্যাদেশ ভিত্তিক’ প্রমাণে বিভক্ত করে দেখানো যেতে পারে। এখন কুরআনের আলোকে উপরোক্ত শিরোনামে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বর্ণনা করা হচ্ছে।
সৃষ্টি জগতের দিকে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায় এই জগৎ আল্লাহ্র সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই জগতে বিদ্যমান এমন একটি বস্তুও নেই যা নিজ থেকেই বিদ্যমান। প্রতিটি ক্ষুদ্র-বৃহৎ বস্তুর পিছনে একজন নির্মাতা অবশ্যই আছে। এর এটা একটা বাস্তবিকই অর্থহীন কথা যে, সৃষ্টিকে স্বীকার করা হবে কিন্তু স্রষ্টাকে স্বীকার করা হবে না। ঠিক একইভাবে এটিও বিশ্বাস করা যায় না যে, এই বিরাট সৃষ্টি জগৎ এমনিতেই সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং এর পিছনে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। একমাত্র অস্তিত্বশীল স্রষ্টাই এই জগতের প্রতিটি বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন, এবং সেই সৃষ্টির প্রকৃতি, এর গঠনবিন্যাস, এর কার্যকারিতা প্রভৃতির উপলব্ধির দ্বারা এক আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া উপায় যে নেই সেই সত্যটি পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে। যেমন কুরআনে বলা হচ্ছে, “তোমাদের আল্লাহ্ এক ও একক। সেই দয়াবান ও করুণাময় আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই। (এই সত্যটি চিহ্নিত করার জন্য যদি কোন নিদর্শন বা আলামতের প্রয়োজন হয় তাহলে) যারা বুদ্ধি বিবেক ব্যবহার করে তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর ঘটনাকৃতিতে, রাত্রদিনের অনবরত আবর্তনে, মানুষের প্রয়োজনীয় ও উপকারী সামগ্রী নিয়ে সাগর দরিয়ার চলমান জলযানসমূহে, বৃষ্টি ধারার মধ্যে, যা আল্লাহ্ বর্ষণ করেন ওপর থেকে তারপর তার মাধ্যমে মৃত ভূমিতে জীবন দান করেন এবং নিজের এই ব্যবস্থাপনা বদৌলতে পৃথিবীতে সব রকমের প্রাণী ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন, আর বায়ূ প্রবাহ এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালায় অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।” “সূরা ২, আয়াত ১৬৩-১৬৪”।
কুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে, “তিনি অর্থাৎ আল্লাহ্ আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা। তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন……।” “সূরা ৪২, আয়াত ১১”।
কুরআনে আরো বলা হচ্ছে, “হে মানব জাতি। ইবাদত কর তোমাদের রবের যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সবার সৃষ্টিকর্তা….।” “সূরা ২, আয়াত ২১; আরো দেখুন, সূরা ১৬, আয়াত ১০-১১; সূরা ৬, আয়াত ৯৯; সূরা ৫০, আয়াত ৯-১১”।
পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, কুরআনের অনেক জায়গায় বলা হয়েছে, এই জগতকে বিনা উদ্দেশ্য সৃষ্টি করা হয়নি। এই জগতে যে নিয়ম শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্য, ঐক্য বিরাজমান এদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আল্লাহ বোঝাতে চাচ্ছেন যে, প্রকৃতির সকল ঘটনারাজির ঐক্য বিধানের জন্য নিশ্চয়ই একজন স্রষ্টা প্রয়োজন। যে ঐক্যের মধ্যে কোন ফাটল বা অসামঞ্জস্যতা থাকবে না। কুরআনে বলা হচ্ছে, “সেই মহান সত্তাই সাত আসমানকে স্তরে স্তরে তৈরি করেছেন। তুমি সেই করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোথাও কোন ক্রটি দেখতে পাবে না। “সূরা ৬৭, আয়াত ৩-৪”।
কুরআনের অন্যত্র বলা হচ্ছে, “আমি আকাশ ও ভূমন্ডল এবং তন্মধ্যস্থ যাবতীয় ব্স্তু খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। নিশ্চয়ই আমি উভয়কেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করেছি কিন্তু অধিকাংশ লোকই অনুধাবন করে না।” “সূরা ৪৪, আয়াত ৩৮-৩৯”।
এটিকে দর্শনের পরিভাষায় আল্লাহর অস্তিত্বের তত্ত্ব বিষয়ক প্রমাণ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এটি হলো, মানুষের মনে আল্লাহর ধারণার উপস্থিতিই তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। কুরআনে বলা হচ্ছে, মানুষ বিপদে পড়লে অকস্মাৎ সে আল্লাহ্কে স্মরণ করে, আসমান যমীনের সৃষ্টির ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও সে জবাব দেয় যে, মহান আল্লাহ্ই এগুলো সৃষ্টি করেছেন। “সূরা ৪১, আয়াত ৫১; সূরা ৪৩, আয়াত ৯”।
এখানে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে যদি আল্লাহ্র অস্তিত্ব না-ই থাকে তাহলে মানুষের অন্তরে এমন ধারণা কে সৃষ্টি করে? সুতরাং এ থেকে প্রমাণিত হয়, আল্লাহ্র অস্তিত্ব অত্যন্ত সুষ্পষ্ট।
আল্লাহ্ যুগে যুগে মানব জাতিকে হিদায়েতদানের জন্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। “সূরা ৩৫, আয়াত ২৪”।
সেই সাথে ঐসব নবী-রাসুলকে তিনি সঙ্গে দিয়েছেন আসমানী গ্রন্থ। ঠিক এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)Ñকে পবিত্র কুরআন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। “সূরা ৬, আয়াত ১৯”।
পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় চ্যালেঞ্জ “সূরা ২, আয়াত ২৩; সূরা ১০, আয়াত ৩৮; সূরা ১১, আয়াত ১৩; সূরা ১৭, আয়াত ৮৮ এবং সূরা ৫২, আয়াত ৩৩-৩৪”।
দিয়ে বলা হয়েছে যে, এই কিতাব স্বয়ং আল্লাহ্রই বাণী এবং মানুষ ও জ্বীনকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে যে, তোমরা যদি মনে কর এটি আল্লাহ্র বাণী নয় তাহলে তোমরা অনুরূপ একটি অধ্যায় বা সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। এই চ্যালেঞ্জ যে মানুষ গ্রহণ করেনি তা নয়। কিন্তু মানুষ অনুরূপ একটি অধ্যায় তো দূরের কথা একটি ছোট সূরাও রচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্র অস্তিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত।  সব শেষে কোন্ কোন্ ভিত্তির উপরই নির্ভর করে আল্লাহ্র সাথে মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা আলোচনা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কুরআনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি বিষয়ে অতি সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে ঃ মানুষের দুটি দিক রয়েছে, ১. দৈহিক দিক, ২. আত্মিক দিক। দৈহিক দিকের চেয়ে আত্মিক দিকটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই আত্মিক দিকের সঙ্গে খোদ আল্লাহ্র প্রকৃতিগত সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়। কেননা কুরআনে বলা হচ্ছে, “মানুষ আপনাকে রূহ্ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন রূহ আমার প্রভুর দির্দেশ। “সূরা ১৭, আয়াত ৮৫”।
অর্থাৎ এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আর তা হলো, স্বয়ং আল্লাহ্র রুহানিয়াত মানুষের মধ্যে ফুঁকে দেওয়া হয়েছে। এদিক থেকে বলা যায় মানুষের সাথে আল্লাহর একটা আধ্যাত্মিক (ঝঢ়রৎরঃঁধষ) সম্পর্ক রয়েছে। আর এটাই বলা হচ্ছে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে, “তোমরা আল্লাহ্র রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে যাও।” “সূরা ২, আয়াত ১৩৮”।
জ্ঞানগত দিক : পবিত্র কুরআন থেকে জানা যায় মহান আল্লাহ্ হচ্ছেন সকল জ্ঞানের আধার; তিনি সুবিজ্ঞ। ভূমন্ডল ও নভোমন্ডল এমন কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নেই যে সম্পর্কে তিনি পরিজ্ঞাত নন। “সূরা ৪০, আয়াত ২; সূরা ৪১, আয়াত ৪৭; সূরা ৫৭, আয়াত ৪”।
মূলত জ্ঞানগত দিক থেকে আল্লাহ্কে সর্বজ্ঞানী বলা হয়। এই জ্ঞানের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ তিনি মানুষকে দিয়েছেন। ফেরেশতারা হয়তো এক এক দিক ও বিভাগ সম্পর্কে মানুষ অপেক্ষা বেশী জ্ঞান রাখে। কিন্তু মানুষ জগতের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে কমবেশী জ্ঞানের অধিকারী। “সূরা ২, আয়াত ৩১”।
এই জন্য মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের আপত্তির মুখে আল্লাহ্ যেমন বলেছেন আমি যা জানি তোমরা তা জাননা। “সূরা ২, আয়াত ৩০”।
অপর দিকে, মানুষ সৃষ্টির পর জ্ঞানের পরীক্ষায়ও ফেরেশতারা মানুষের কাছে পরাজিত হয়। “সূরা ২, আয়াত ৩২”।
সুতরাং বলা যেতে পারে যে, যদিও সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আল্লাহ্ই পরিপূর্ণভাবে জ্ঞান; কিন্তু এটা বলা যেতে পারে যে, সেই জ্ঞানের একটা ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করলেও মানুষ তা করছে।
বিশ্ব জাহানের বিশাল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের অধিকারী মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। “সূরা ২, আয়াত ২৫৫”।
তিনি মানুষকে তার একচ্ছত্র কর্তৃত্বের কিছু অংশ দিয়ে এই পৃথিবীতে খেলাফতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। “সূরা ২, আয়াত ৩০”।
এবং অন্য কোন সৃষ্টি জীব বা পদার্থ নয় স্বয়ং মানুষই সেই দায়িত্বের বোঝা বহন করতে সম্মত হয়েছেন। “সূরা ৩৩, আয়াত ৭২”।
সুতরাং বলা যেতে পারে যে, বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে মানুষ আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সে তাঁরই সাহায্যকারী। “মুহাম্মদ ইকবাল : ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন অনুবাদ সম্পাদকÑ অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ঃ ১৯৫৭), অধ্যায়-৪; সূরা ৬১, আয়াত ১৪”।
নৈতিক দিক থেকেও মানুষের সাথে আল্লাহ্র সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়। ইচ্ছার স্বাধীনতা থেকেই নৈতিকতার উৎপত্তি। এদিক থেকে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ্ সকল প্রকার ইচ্ছার একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি ইচ্ছার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করেন। তিনি যখন যা খুশী তখনই তা বাস্তবায়ন করেন। যখন কোন কিছু করা ইচ্ছা হয় তখনই তিনি শুধু বলেন, “হও”, আর অমনি তা হয়ে
যায়।” “সূরা ৩, আয়াত-৪৭”।  এদিক থেকে বলা যায় যে, মানুষ সীমিতভাবে হলেও নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। আর এই স্বাধীনতা ভোগ করে বলেই কুফর বা ঈমান গ্রহণ করার পূর্ণ ইখতিয়ার তার রয়েছে। “সূরা ১৮, আয়াত ২৯”। সুতরাং এ কথা বলা যেতে পারে যে, নৈতিকতার সর্বোচ্চ উৎস হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ আর মানুষ তার নিজ পরিসরে নৈতিক বোধসম্পন্ন এক সীমাবদ্ধ জীব।  এ পর্যন্ত আল্লাহ্ সম্পর্কিত বিষয়ে যতটুকু আলোচনা করা হয়েছে সেখানে একটি বিষয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দার্শনিক, বিজ্ঞানী সব শ্রেণীর মানুষের মনে আল্লাহ্র ধারণার স্বীকারোক্তি প্রচ্ছন্নভাবে হলেও বিদ্যমান। বিভিন্ন ধর্মে, দর্শনে এবং বৈজ্ঞানিক আলোচনায় আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি দৃঢ়ভাবে স্বীকৃতÑ এবং বহু বা দুই নয় এক আল্লাহ্র প্রতিই মানুষের যৌক্তিক আকর্ষণ বিদ্যমান। অবশ্য আল্লাহ্ সম্পর্কিত আলোচনা এত ব্যাপক এবং বিশাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আলোচ্য প্রবন্ধে যেসব শিরোনামে এবং যেসব দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করা হয়েছে তা ছাড়াও মঙ্গল অমঙ্গলের ধারণার সাথে আল্লাহ্র সম্পর্ক, আল্লাহ্র গুণাবলী প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে এবং ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করা যেতে পারে। ‘আল্লাহ্র ধারণা’ বিষয়ে বিস্তারিত পাঠের জন্য প্রবন্ধের শেষে “সহায়ক তথ্য নির্দেশনা” প্রদান করা হলো।
তথ্য নির্দেশনা
* খলিফা আব্দুল হাকীম, ইসলামী ভাবধারা, অনুবাদÑ সাইয়েদ আব্দুল হাই (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৭০) পৃ. ৫৪-৯০।
* ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খ- (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০০), পৃ. ৬৩৪-৬৩৬।
* মুহাম্মদ শাহজাহান, আল-গাযালীর দর্শন, উত্তরণ অফসেট প্রিন্টিং প্রেস, রাজশাহী, ২০০০।
* মুহাম্মদ শাহজাহান, আলÑফারাবীর দার্শনিক চিন্তাধারা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০২ পৃ. ১৫-১৯।
* আল্লামা শিবলী নু’মানী, ইসলামী দর্শন, অনুবাদÑ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮১, পৃ. ২০৭-২১৪।
* মুহাম্মদ আল-গাযালী, ইসলামী আকীদা, অনুবাদÑ মুহাম্মদ মুসা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৬, পৃ. ১-৫৬।
* আল-গাযালী, কিমিয়ায়ে সা’আদাত, অনুবাদÑনুরুর রহমান (এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা : ১৯৯৫।)
লেখক-শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। (সমাপ্ত)