কামারুজ্জামানের ফাঁসি ঝুলে গেল!

35

58_61190কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী অপরাধী আল বদরপ্রধান কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর আপাতত ঝুলে গেল। কারণ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত ওই রায়ের রিভিউ আবেদন সোমবার খারিজ করলেও গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সেই খারিজের রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেননি বিচারপতিরা। রাতে জানা গেছে রিভিউ আবেদন খারিজের আদেশের খসড়া পাঠানো হয়েছে প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিদের কাছে।
চার বিচারপতি এই আদেশে স্বাক্ষর করার পর তা আইন মন্ত্রণালয় হয়ে যাবে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর সেই রায় কার্যকর করা হবে। সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও রায় না পৌঁছানোর কারণে কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা শেষ দেখার পরও মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়নি। জানা গেছে, আগে রায়ের সংক্ষিপ্ত কপির ভিত্তিতে আরেক জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হলেও এবার কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে তা না হয়ে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন খারিজের রায়ে স্বাক্ষর করবেন বিচারপতিরা। আর এই পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ করতে কিছু সময় দরকার।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের রায়ের কপি এসে পৌঁছাবে এমন প্রত্যাশায় গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ও সুপ্রিমকোর্টে ভিড় করেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। সকাল থেকেই বিভিন্ন সংবাদকর্মীরা সুপ্রিমকোর্টে ও কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অবস্থান নেন। তবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রায়ের কপিতে বিচারপতিরা স্বাক্ষর না করায় প্রথমে কোর্ট থেকে এবং পরে খবর পেয়ে কারাগারের সামনে থেকে ফিরে যান সংবাদকর্মীরা । মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের রায় ঘোষণা করা হয় গত সোমবার। রিভিউ আবেদন খারিজ করে যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে যাবতীয় প্রস্তুতি নেয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। গুঞ্জন চলতে থাকে যেকোনো মুহূর্তে পৌঁছাতে পারে রায়ের কপি। বিকালেই কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে সোমবার রাত ১০টার দিকে সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের কপি না পাওয়ায় পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। রিভিউ খারিজের আদেশে বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর তা সংশ্লিষ্টদের কাছে আসার কথা।
এদিকে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় ছাড়া দন্ড কার্যকর করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে এ মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, রিভিউ আবেদনের শুনানিতে আমরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছি। তা খন্ডনের বিষয়টি জানতে হবে। আর এ জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় ছাড়া দন্ড কার্যকর উচিত হবে না। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল বিভাগের রায়ের ক্ষেত্রেও বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া ‘ভিন্নমত’ রেখেছিলেন এবং এর ফলে সব বিচারকের স্বাক্ষরসংবলিত রায়টি পেতে ঘোষণার পরও ১০৭ দিন (৩ নভেম্বর থেকে ১৮ ফেব্র“য়ারি) লেগেছিল। আপিল বিভাগে ‘ভিন্নমত’ প্রকাশকারী আবদুল ওয়াহাব মিয়া প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের যে বেঞ্চে কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদনের শুনানি হয়েছে সেখানেও অন্যতম বিচারক ছিলেন। গত সোমবার রিভিউ আবেদন খারিজের রায় ঘোষণা করতে প্রধান বিচারপতি কেবল একটি শব্দ উচ্চারণ করেন তা হলো ‘ডিসমিসড’। তিনি এর বেশি কিছু বলেননি। আদালত সূত্রে আরো জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার সংক্ষিপ্ত রায়ে সব বিচারকের স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি, তবে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা হলে বিচারকের স্বাক্ষরসংবলিত রায় পাওয়া যেতে পারে। তবে ‘ভিন্নমত’ প্রকাশকারী বিচারক যদি এই রায়েও বিস্তারিত কিছু লেখার জন্য কিছুটা সময় নেন তাহলে সবার স্বাক্ষরযুক্ত রায় পেতে কিছুটা অতিরিক্ত সময় হয়তো লাগতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রটির মতে, এর ফলে মূল রায়ে প্রভাব পড়বে না, রায় কার্যকর কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে মাত্র। সরকারি মহল যখনই রায়ের লিখিত কপি হাতে পাবেন তারপর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষার যে সর্বশেষ আইনি ধাপ রয়েছে কামারুজ্জামানকে তার জন্য কিছুটা সময় দেয়া হবে। এদিকে ফাঁসির দন্ড কার্যকর করার সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে। এমনকি কামারুজ্জামানের পরিবার শেরপুরে তার নিজ গ্রাম বাজিতখিলা মুদিপাড়ার বাড়িতে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
রিভিউ খারিজ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতিরা স্বাক্ষরের পর তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে হবে। এরপর কামারুজ্জামানকে রিভিউ আবেদন খারিজের তথ্য জানানো হবে। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা কারা কর্তৃপক্ষ সেটি জানতে চাইবে। প্রাণভিক্ষার আবেদন জানানোর ইচ্ছে প্রকাশ করলে তাকে একটা যুক্তিসঙ্গত সময় দেয়া হবে। এরপর আবেদনটি রাষ্ট্রপতি নিষ্পত্তি করবেন। তারপর যে সাজা বহাল থাকে সেটা কার্যকর হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল আজকালের খবরকে বলেন, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, বিবেচনা করবেন, রাষ্ট্রপতির কাছে সেই ফাইল ৭ দিনও থাকতে পারে আবার ১৫ দিনও থাকতে পারে। আবার রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, উনি বিবেচনা করবেন না তাহলে আবেদনপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ঘণ্টার ভেতরে ফেরত পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দ কার্যকর হবে না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষা চাননি। এ সুযোগের বিষয়টি তাকে জানানো হলেও তিনি আবেদন করেননি। আর তার আত্মীয়-স্বজনরাও আগে তার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। সুতরাং তার ব্যাপারে সব রীতি-নীতি মেনেই দন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। তিনি বলেন, কখন দন্ড কার্যকর হবে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, তার দন্ড বহাল আছে। কার্যকরের দিন সরকার নির্ধারণ করবে। অন্য ফাঁসির রায়ের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত উল্লেখ করে এ রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদন্ড , দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদ দেয়া হয়।