ফের বিশ্বসেরার মুকুট অস্ট্রেলিয়ার

37

final_win_bg_278271528স্পোর্টস ডেস্ক :
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এর আগে কখনোই সেমিফাইনালের বাধা পেরোতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। এবার নিজেদের মাটিতে সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাঁদিয়ে ফাইনালে উঠলেও তার ভার যেন সইলো না কিউইদের। পুরো টুর্ষামেন্টে দারুণ খেলে অপরাজিত হয়ে মেলবোর্ণ ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ফাইনাল মঞ্চে এলেও শিরোপার মহারণে তাদের বড়ই ‘বেমানান’ লেগেছে। ফাইনালে কেবল টস জয়-টাই কিউইদের অর্জন থেকেছে। পুরো খেলায় আর কখনোই ফাইনালিস্টের যোগ্যতা দেখাতে পারেনি ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বাহিনী।
গতকাল রবিবার (২৯ মার্চ) মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১১তম বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে রিচার্ড হ্যাডলি-মার্টিন ক্রো’র উত্তরসূরীদের ৭ উইকেটে হারিয়েছে অ্যালান বোর্ডার-স্টিভ ওয়াহ’র উত্তরসূরীরা। নিশ্চিত করেছে তাদের পঞ্চম শিরোপা। এ জয়ের মাধ্যমে ২০১১-২০১৫ পর্যন্ত ক্রিকেটের রাজত্ব হারানো অস্ট্রেলিয়া আবারও রাজমুকুট ছিনিয়ে নিল। এ মুকুট তাদের মাথায় শোভা পাবে আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হওয়া ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন নিউজিল্যান্ড দলপতি ম্যাককালাম। গ্র্যান্ট ইলিয়টের ইনিংস সর্বোচ্চ ৮৩ আর রস টেইলরের ৪০ রানের উপর ভর করে ৪৫ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে নিউজিল্যান্ড ১৮৩ রান সংগ্রহ করে।
কিউইদের হয়ে ব্যাটিং উদ্বোধন করেন দলপতি ম্যাককালাম এবং ১০৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা মার্টিন গাপটিল। তবে, শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ হন ২৪৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ম্যাককালাম। কিউই সমর্থকদের কাঁদিয়ে ইনিংসের পঞ্চম বলে মিচেল স্টার্কের শিকার হয়ে ফেরেন ম্যাককালাম। স্টার্কের বলে বোল্ড হওয়ার আগে কোনো রানই করতে পারেননি কিউই অধিনায়ক। ফলে, ক্রিকেট ইতিহাসের বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ম্যাককালাম নাম লেখান।
দলপতির বিদায়ের পর গাপটিলের সঙ্গে জুটি বাঁধতে আসেন ৭৪টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা কেন উইলিয়ামসন। গাপটিলকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সতর্কভাবে ব্যাট চালাতে থাকেন তিনি।
ইনিংসের ১২তম ওভারে অজি দলপতি মাইকেল ক্লার্ক অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের হাতে বল তুলে দেন। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়ে নিজের দ্বিতীয় বলেই বিশ্বমঞ্চের সর্বোচ্চ স্কোরার মার্টিন গাপটিলকে ফেরান ম্যাক্সওয়েল। ৩৪ বলে একটি করে চার আর ছয়ে ১৫ রান করা গাপটিল বোল্ড হয়ে সাজঘরের পথ ধরেন। এ সময় কিউইদের দলীয় রান ছিল ৩৩। আউট হওয়ার আগে গাপটিল-উইলিয়ামসন জুটি তোলে ৩২ রান।
গাপটিলের বিদায়ের পর ক্রিজে আসেন রস টেইলর। কিন্তু আগে থেকে ক্রিজে থাকা উইলিয়ামসনের সঙ্গে টেইলরের বোঝাপড়া শুরু হওয়ার ইঙ্গিতেই আঘাত হানেন মিচেল জনসন। ১৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ব্যক্তিগত ১২ রান (৩৩ বলে) করা উইলিয়ামসনের দেওয়া ফিরতি ক্যাচ লুফে নিয়ে তাকে সাজঘরে পাঠান তিনি। ফলে দলীয় ৩৯ রানের মাথায় কিউইদের তৃতীয় উইকেটের পতন ঘটে।
এরপর ১৫৯ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা অভিজ্ঞ রস টেইলর ইনিংস মেরামতের দায়িত্ব নেন ৬৭ ওয়ানডেতে নামা ইলিয়টকে সঙ্গে নিয়ে।
পাওয়ার প্লে’র দশ ওভারে নিউজিল্যান্ডের রান আসে ৩১। ম্যাককালামের উইকেটটি হারিয়ে কিউইরা এ রান তোলে। যা এ আসরে কিউইদের সর্বনিম্ন স্কোর। এর আগে পাওয়ার প্লেতে কিউইদের সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ৫৭ রান। ২০ ওভার শেষে ম্যাককালাম বাহিনীর রান দাঁড়ায় ৬৬। তবে, ততক্ষণে আরও দুই ব্যাটসম্যান ফিরে যান। টপঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড এ রান তোলে।
এরপর টেইলর-ইলিয়ট জুটি বেশ সতর্ক থেকেই এগোতে থাকেন। এরই মধ্যে দলীয় শতক পেরোয় কিউইরা। ১৫৮ বলে দলীয় শতক আসে নিউজিল্যান্ডের। এরপর ৫১ বলে তিনটি চারের সঙ্গে একটি ছক্কা হাঁকিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের নবম অর্ধশতক পূরণ করেন ইলিয়ট।
৩০ ওভার শেষে আর কোনো উইকেট না হারিয়ে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ১২১ রানে। অজি বোলারদের সামলে খেলতে থাকেন টেইলর আর ইলিয়ট। তবে, জেমস ফকনার ব্যাটিং পাওয়ার প্লে’র শুরুতে অর্থাৎ ৩৬তম ওভারের প্রথম বলে ফিরিয়ে দেন অভিজ্ঞ রস টেইলরকে। উইকেটের পেছনে ব্র্যাড হাডিনের গ্লাভসবন্দি হওয়ার আগে টেইলর করেন ৪০ রান। তার ৭২ বলের ইনিংসে ছিল মাত্র দু’টো চারের মার। দলীয় দেড়শো রানে আউট হওয়ার আগে ইলিয়টকে সঙ্গে নিয়ে ১১১ রানের জুটি গড়েন টেইলর।
টেইলরের বিদায়ের পর অজি বোলাররা দ্রুতই ফেরান কিউইদের ড্যাশিং ব্যাটসম্যান কোরি অ্যান্ডারসনকে। এবারও ফকনারের আঘাত। স্কোরবোর্ডে কোনো রান জমা না হতেই পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরের পথ ধরেন অ্যান্ডারসন (২ বলে ০ রান)। পরের ওভারে মিচেল স্টার্ক ফিরিয়ে দেন নিউজিল্যান্ডের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লুক রঞ্চিকে। কোনো রান না করেই মাইকেল ক্লার্কের তালুবন্দি হয়ে ফেরেন রঞ্চি। ফলে, ১৫১ রানের মাথায় কিউইদের ষষ্ঠ উইকেটের পতন ঘটে।
৪০ ওভার শেষে কিউইদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ উইকেট হারিয়ে ১৬৫ রান। টপঅর্ডারের ছয় ব্যাটসম্যান ফিরে গেলেও ব্যাটিং ক্রিজের একপ্রান্ত ধরে রাখেন ইলিয়ট। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে আসেন ১৮ বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলা আর ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপের শেষ ইনিংসে খেলতে নামা ড্যানিয়েল ভেট্টোরি। তবে, ৪১তম ওভারে মিচেল জনসনের করা শেষ বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন ভেট্টোরিও। আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ৯ রান (২১ বল থেকে)।
উড়তে থাকা অজি বোলারদের তোপে একের পর এক উইকেট হারানো কিউইদের শেষ ভরসা হিসেবে ব্যাটিং ক্রিজে থাকা গ্র্যান্ট ইলিয়টও অনেকটা আত্মসমর্পণ করেন শেষ পর্যন্ত। জেমস ফকনারের ৪২তম ওভারের পঞ্চম বলে উইকেটের পেছনে থাকা হাডিনের গ্লাভসে ধরা পড়েন ইলিয়ট। আউট হওয়ার আগে তিনি ৮২ বলে ৭টি চার আর একটি ছয়ে ৮৩ রানের ঝলমলে এক ইনিংস সাজান। তার বিদায়ে দলীয় ১৮১ রানের মাথায় কিউইদের অষ্টম উইকেটের পতন ঘটে।
ইলিয়টের বিদায়ের পর টেল এন্ডারের আর কেউ দাঁড়াতে না পারায় ৪৫তম ওভারে ১৮৩ রানেই ভেঙে পড়ে কিউই ব্যাটসম্যানদের ডানা। ৪৫তম ওভারের পঞ্চম বলে মিচেল স্টার্কের তালুবন্দি হয়ে ফেরেন ম্যাট হেনরি। কোনো রান না করেই মিচেল জনসনের বলে সাজঘরে ফেরেন তিনি। আর ওভারের শেষ বলে রানআউটের ফাঁদে পড়ে কিউইদের শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে বিদায় নেন টিম সাউদি। ১১ বলে ১১ রান করে আউট হন এ বোলার।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ তিনটি করে উইকেট নেন মিচেল জনসন এবং জেমস ফকনার। মিচেল স্টার্ক পান দু’টি উইকেট আর একটি উইকেট দখল করেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
নিউজিল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ১৮৪ রানের টার্গেটে অজিদের হয়ে ব্যাটিং উদ্বোধন করতে নামেন অ্যারন ফিঞ্চ এবং ডেভিড ওয়ার্নার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী জুটি দাঁড়াতেই পারেনি ফাইনালে। টিম সাউদির করা ইনিংসের প্রথম ওভার থেকে এক রান তুলে নিয়ে দ্বিতীয় ওভারে ট্রেন্ট বোল্টের আঘাতে মাঠ ছাড়েন ৪৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা অ্যারন ফিঞ্চ। বোল্টের চতুর্থ বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে শূন্য রানে ফেরেন তিনি।
দলীয় দুই রানের মাথায় ফিঞ্চকে হারিয়ে আরেক ওপেনার ৬২ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ডেভিড ওয়ার্নার এবং তিন নম্বরে নামা ৫৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা স্টিভেন স্মিথ শুরুর বিপর্যয় কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। বেশ সতর্ক থেকেই শিরোপা জয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে অজিরা।
এরমধ্যে ইনিংসের পঞ্চম ওভারে সাউদির একটি বলে প্রথম স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন ওয়ার্নার। তবে, স্লিপে দাঁড়ানো রস টেইলর ডাইভ দিয়েও নিজের আয়ত্ত্বে নিতে পারেননি বলটি। স্বল্প পুঁজি নিয়েও লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিতে থাকে নিউজিল্যান্ড। পাওয়ার প্লে’র দশ ওভার থেকে অজিরা এক উইকেট হারিয়ে তোলে ৫৬ রান।
১৩তম ওভারে ১০ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ম্যাট হেনরি তার ব্যক্তিগত তৃতীয় ওভারের দ্বিতীয় বলে ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে কিউইদের খানিক জাগিয়ে তোলেন। হেনরির বলে পুল করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ইলিয়টের তালুবন্দি হন ৪৫ রান করা ওয়ার্নার। তিনি ৪৬ বলে ৭টি চারের মারে সাজান তার ইনিংসটি। দলীয় ৬৩ রানের মাথায় দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটে। ওয়ার্নার আউট হওয়ার আগে তার সঙ্গে স্মিথের জুটি যোগ করে ৬১ রান।
ইনিংসের ১৫তম ওভারে ম্যাট হেনরির প্রথম বলটি ব্যাট-প্যাডকে ফাঁকি দিয়ে স্মিথের স্ট্যাম্পে গিয়ে আঘাত হানে। তবে, সে আঘাতে সাজঘরে ফিরতে হয়নি স্মিথকে। স্ট্যাম্পে লাগলেও বলের গতি না থাকায় স্ট্যাম্পের বেল পড়েনি। ফলে, এ যাত্রায় বেঁচে যান স্মিথ।
২০ ওভার শেষে অজিদের সংগ্রহ দাঁড়ায় দুই উইকেট হারিয়ে ৯৮ রান। দলীয় শতক আসে ১২৫ বলে। এরমধ্যে ৫৬ বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫৮তম অর্ধশতক হাঁকান মাইকেল ক্লার্ক। ৩০ ওভার শেষে আর কোনো উইকেট না হারিয়ে অজিরা তোলে ১৫৭ রান।
বড় কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ক্লার্ক-স্মিথ জুটি এগোতে থাকে স্বাচ্ছন্দ্যে। ১১২ রানের বড় জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরের দিকে এগোতে থাকেন অজি দলপতি ক্লার্ক এবং স্মিথ। জয়ের মাত্র ৮ রান দূরে থাকতে অবশ্য ম্যাট হেনরির বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ওয়ানডে ইনিংস খেলা ক্লার্ক। তার ৭২ বলে ৭৪ রানের ইনিংসে ১০টি চারের পাশাপাশি ছিল একটি ছয়। এই ঝলমলে ইনিংস খেলে নিজের বিদায়ী ম্যাচটিকেও স্মরণীয় করে রাখেন অজি দলপতি।
ক্লার্কের বিদায়ের পর আর কোনো বিপদ হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসনকে নিয়ে দলকে নিরাপদেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন। ৩৩.১ ওভার খেলে মাত্র তিনটি উইকেট হারিয়ে পঞ্চম শিরোপা নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়া। খেলার শেষাবধি ক্যারিয়ারের সপ্তম অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫৬ রানে অপরাজিত থাকেন স্মিথ।
নিউজিল্যান্ডের হয়ে ম্যাট হেনরি দু’টি এবং ট্রেন্ট বোল্ট একটি করে উইকেট পান।