আত্মত্যাগের দীক্ষা : মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা

88

ফেরদৌস কবির টিপু

১৯৯৫ সালে একদিন গিয়েছি সেগুনবাগিচাস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে। ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন দেখছি। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা পোস্টারে। বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা ছোট্ট একটা পোস্টার। ছবির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটা অটোগ্রাফ। ছয়ের দশকে আন্দোলনমুখর উত্তাল সময়ে কোনও এক স্কুলছাত্রীকে তিনি সেটি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেই অটোগ্রাফে লিখেছিলেন ‘এৎবধঃ ঃযরহমং ধৎব ধপযরবাবফ ঃযৎড়ঁময মৎবধঃ ংধপৎরভরপব’ (বিশাল ত্যাগের মাধ্যমেই মহৎ কিছু অর্জন করতে হয়)। মনে আছে, তাঁর কথাটা আমার মনে প্রচন্ড আলোড়ন জাগিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ কিনেছিলাম সেই পোস্টারটি। এত বছর পর আজও তাঁর সেই অমোঘ সত্য উচ্চারণ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর বাণীর যথার্থতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। জগৎজুড়ে অসংখ্য মহামানবের জীবনীতে এর কার্যকর/বাস্তব প্রতিফলন দেখেছি।
দুনিয়াজুড়ে ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে আত্মত্যাগের প্রয়োজনীয়তা এবং মহিমা আমরা সবাই কমবেশি উপলব্ধি করি। ত্যাগ ছাড়া পৃথিবীতে মহৎ কিছুই অর্জিত হয়নি। আমাদের পূর্বপুরুষদের কারও কারও ত্যাগের নিদর্শন হচ্ছে বর্তমান বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সভ্যতা। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মহামানবের আত্মত্যাগেরই অভিজ্ঞান। আপন সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য পিতামাতার ত্যাগ যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনই জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধির জন্যও সমাজের অসংখ্য মানুষকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ও আমাদের পূর্বপুরুষদের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল। তাঁরা তাঁদের বর্তমানকে ত্যাগ করেছিলেন আমাদের নিরাপদ বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার জন্য। গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আমরা কি তাঁদের সেই আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করেছি? আমরা কি তাঁদের ত্যাগ থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছি? আমরা কি একইভাবে (হয়ত ভিন্নমাত্রায় ভিন্ন প্রেক্ষিতে) আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নততর এবং উজ্জ্বলতর আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে? এ প্রশ্নের উত্তর নিঃসন্দেহে আমাদের সবাইকে হতাশ করে।
’৭১-এ সামষ্টিকভাবে পুরো জাতি অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশা-দুর্গতি ভোগ করেছিল (স্বল্প সংখ্যক রাজাকার/আলবদর ছাড়া)। দেশের সাধারণ মানুষ সারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেনি-তারাও নানাভাবে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। আর যাঁরা জীবন বাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁরা তো জেনেশুনে সচেতনভাবে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল। হাজার হাজার মুক্তিসেনা লাখ লাখ সাধারণ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল এটা ভেবে যে, তাঁদের উত্তরপুরুষরা একটা স্বাধীন দেশে আত্মমর্যাদা নিয়ে নিরাপদে সুখে শান্তিতে বাস করবে। তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণে আমরা যে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি এ ব্যাপারে আজ আর কেউ দ্বিমত পোষণ করে না। পঁয়তাল্লিশ বছর পর গণতন্ত্রের পয়লা সবক নির্বাচনটাও পাস করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্রিটেনের গ্রানাডা টেলিভিশন ‘ডড়ৎষফ রহ ধপঃরড়হ’ প্রোগ্রামে ‘গধলড়ৎ কযধষবফ’ং ডধৎ’ নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে। ঢাকা, নোয়াখালি, কুমিল্লা, ফরিদপুর এবং সিলেটের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ২নং সেক্টরের বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকার নিয়ে সেটি তৈরি করা হয়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। সেই সেক্টরের একজন সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপটেন মালেক চৌধুরী। সেই ডকুমেন্টারিতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিটিশ উপস্থাপিকা ভানিয়া কিউলির (ঠধহরুধ কবষিবু) কাছে বর্ণনা করেন, কীভাবে পাকসেনারা সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করছে, নারী নির্যাতন করছে এবং কীভাবে তাঁরা পাকহানাদারদের প্রতিরোধ করছেন। ভানিয়া কিউলি এক পর্যায়ে যুদ্ধরত ক্যাপটেন মালেককে প্রশ্ন করেন: ডবষষ পধঢ়ঃধরহ, যিধঃ ধনড়ঁঃ ুড়ঁৎ ভধসরষু? (ভালো কথা ক্যাপটেন, তোমার পরিবারের খবর কী?)। উত্তরে ক্যাপটেন মালেক বলেন ‘ওহ ভধপঃ ও ফড়হ’ঃ শহড়ি যিধঃ’ং যধঢ়ঢ়বহরহম ঃড় ঃযবস. ও যধাব মরাবহ ঁঢ়. ও যধাব ংববহ ঃযব ভধঃব ড়ভ ড়ঃযবৎ ভধসরষরবং যিবহ ধহ (ইবহমধষবব) ড়ভভরপবৎ ফবংবৎঃবফ ধহফ লড়রহবফ ঃযব গঁশঃরভড়ঁল. ডযধঃ যধঢ়ঢ়বহবফ ঃড় ঃযবরৎ ভধসরষরবং? ঞযবু বিৎব ধষষ পধঢ়ঃঁৎবফ ধং ঢ়ৎরংড়হবৎং ধহফ শবঢ়ঃ রহ ঃযব পধহঃড়হসবহঃ. ও ফড়হ’ঃ শহড়ি যিধঃ’ং নববহ ফড়হব ঃড় ঃযবস. কহড়রিহম ধষষ ঃযরং ও ৎধহ ধধিু. ও লঁংঃ মধাব ঁঢ়. ও লঁংঃ ঃযরহশ ড়ভ মড়ফ ধহফ যিধঃবাবৎ মড়ফ ফড়বং. ঞযধঃ’ং ধষষ. ঝড় ও যধাব হড় ৎরমযঃ ঃড় ঃযরহশ ধনড়ঁঃ ঃযবস, ুড়ঁ ংবব. ঝরহপব ও যধাব ংধপৎরভরপবফ ঃযবস যড়ি পধহ ুড়ঁ ঃযরহশ ধনড়ঁঃ ঃযবস হড়’ি? [সত্যি কথা হলো, আমি জানি না আমার পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যে কী ঘটছে। আমি যে আশা (তাদের পাবার) ছেড়ে দিয়েছি। যে সমস্ত (বাঙালি) অফিসার সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছে তাদের পরিবারের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমি তা দেখেছি। জানতে চান তাদের কী হয়েছে? তাদের সবাইকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা হয়েছে। জানি না তাদের ওপর (নির্যাতন) কি করা হচ্ছে। এসব জেনেশুনেই আমি (সেনাবাহিনী থেকে) পালিয়েছি (যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য)। আমি সব আশা ত্যাগ করেছি (পরিবারের জন্য)। আমি শুধু আল্লাহর চিন্তা করি এবং তাঁর ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। এই হল আমার (পরিবারের) খবর। সুতরাং তাদের নিয়ে চিন্তা করার কোনও অধিকার আমার নেই। যেহেতু আমি তাদের উৎসর্গ করে দিয়েছি (দেশের জন্য), তুমিই বল এখন আমি কীভাবে তাদের নিয়ে চিন্তা করতে পারি?]
মাত্র ২২/২৩ বছরের এই তরুণ ক্যাপটেনের সাহসী মন্তব্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজ পরিবারকে উৎসর্গ করার অসংকোচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা শুনে আমার চোখে প্রায় জল এসেছিল। এই তরুণের দেশপ্রেমের বিশালতা দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা আপনি নত হয়ে এলো। জানি না সেই তরুণ অফিসার আজও বেঁচে আছেন কি না। তাঁর মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা এভাবেই অকাতরে নিঃশঙ্কচিত্তে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য হাসিমুখে তাঁদের সর্বস্ব ত্যাগ করে গেছেন।
আমরা কি তাঁদের ত্যাগের উপযুক্ত মূল্যায়ন করেছি? মূল্যায়ন বলতে আমি শুধু পুরস্কারের কথা বলছি না। বলছি তাঁরা যে মহৎ উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, আমরা পরবর্তী প্রজন্মেরা কি জাতির সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি? মুক্তিযুদ্ধের পঁয়তাল্লিশ বছর পর আমাদের দুঃখিনী বাংলা মা আজ পেট্রল বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। সহজেই অনুমেয় আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।
প্রশ্ন হল কেন আমরা পারছি না? এ প্রশ্নের হাজারো উত্তর পাওয়া যাবে। বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের নানা মত প্রকাশ করবেন। আমি সে-সব বিচার-বিশ্লেষণ না-করে সেই প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর নিয়ে দু’টো কথা বলতে চাই। সেটা হল-’৭১-এ যুদ্ধকালীন দেশের জন্য ত্যাগ করার যে মানসিকতা সর্বস্তরের জনমনে তৈরি হয়েছিল-বিজয় অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তা কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। আমরা কেউ-ই সেই ‘আত্মত্যাগের’ চেতনাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করিনি। অবশ্যই যুদ্ধকালীন ঐক্য, চেতনা এবং শান্তিকালীন দেশপ্রেমের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংকটের সময় মানুষ যেভাবে ত্যাগের বাসনা নিয়ে দেশের মুক্তির জন্য এগিয়ে যায়-ঠিক একইভাবে শান্তিকালীনও একদল মানুষকে আত্মত্যাগের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ-গড়ায় এগিয়ে আসতে হয়। তা না-হলে সেই দেশ-জাতি কাক্সিক্ষত মুক্তি অর্জন করতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের অর্জন বলা যায় প্রায় শূন্য। স্বাধীনতা পেয়ে আমরা সবাই এখন মত্ত, ছোট্ট দেশের অল্প পরিমাণ সম্পদ যে-যেভাবে পারি নিজেদের ভোগদখলে নিতে। নেতৃত্ব পেয়ে যে নেতা যত বেশি সম্পদ অবৈধভাবে বাগাতে পারে সেই তত শক্তিশালী। দেশের মানুষও তা নির্জীবভাবে কপালের লিখন বলে মেনে নিয়েছে বলে মনে হয়। নেতা হওয়ার পর কেউ যদি বিশাল সম্পদের মালিক না-হতে পারে তবে তাকে তার আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ব্যর্থ হিসেবেই চিহ্নিত করে, এমনকী তার ‘বোকামির’ (!) জন্য হাসিতামাশা করে! কোনও সৎ, দেশপ্রেমিক নেতা যদি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চায় তবে আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে শুধোয় ‘নির্বাচন করতে চান? বস্তা বস্তা টাকা আছে?’ আমার এক উচ্চশিক্ষিত আত্মীয় একবার আমাকে বলল ‘অমুক নাকি নির্বাচন করতে চান? জানো কত টাকা লাগবে? পাঁচ কোটি টাকার কম নির্বাচন ‘খেলা’ যাবে না!’ এটাকে সবাই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ‘নির্বাচন খেলা’! রাজনীতি আর নির্বাচন তাদের কাছে আর দশটা ক্রীড়ার মতো একটা ক্রীড়া! জনসেবা এবং উন্নয়নের ব্রত কি ‘ক্রীড়ার’ মধ্যে থাকে?
প্রশ্ন হল যে মানুষ ৫ কোটি টাকা বিলিয়ে নির্বাচন জিতবে-তাকে দিয়ে কি জনসেবা বা উন্নয়ন হবে? ক্ষমতা পেয়ে যে তার সদ্য বিনিয়োগকৃত ৫ কোটি টাকা উসুল করে আরও ১৫ কোটি কামাবে নাকি এলাকার উন্নয়ন, জনসেবায় মনোসংযোগ করবে? এই অতি সহজসরল ফরমুলাটাও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে উপলব্ধি করতে দেওয়া হচ্ছে না। ভোটাররাও জনসেবা বা উন্নয়ন পাওয়ার আশা ছেড়ে নির্বাচন এলে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে যে যা পারে টু-পাইস কামিয়ে নেয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, গ্রামে মহল্লায় রাতে লোকজন পাহারা বসায় (নির্বাচনের ঠিক আগের দিনগুলোতে) যাতে প্রতিপক্ষের প্রার্থীর লোকজন টাকার বস্তা নিয়ে ঢুকতে না পারে। ভোটার প্রতি ৫০০/১০০০ টাকায় (নির্ভর করে প্রার্থী কতটা পয়সাওয়ালা) ভোট কিনে নির্বাচিত নেতা যখন ৫ বছরেই কোটি কোটি (কেউ কেউ শত কোটি) টাকার মালিক হয় তখন সেই একই ভোটার আবার তাকে ‘দুর্নীতিবাজ/চোর/বাটপাড়/থানার দালাল’ বলে গালি দেয়! ‘সত্যি সেলুকাস (!)’ আবারও পুনরাবৃত্তি করতে হয়। কেউ কেউ অবশ্য তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে, ‘অমুক ভাই পাঁচ বছরেই লাল হয়ে গেছেন (নিশ্চয়ই টাকার গরমে!), বা ‘অমুক ভাই রাইজ করে ফেলেছে, এত টাকা বানাইছে যে তার চৌদ্দপুরুষও খেয়ে শেষ করতে পারবে না। আর এমপি মন্ত্রী না-হলেও চলবে।’ এখানে হাসির বিষয়, বরং বলা যায় নির্মম রসিকতা হল-একদিকে ভোটাররা নিজেদের পবিত্র আমানত ভোটাধিকার পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করে, আবার অন্যদিকে সেই জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে ‘আন্তরিক অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক স্বচ্ছ আচরণ বা জনসেবা আশা করে! ভোট-বাণিজ্য এবং জনসেবা/উন্নয়ন যে দুটো বিপরীত মেরুর জিনিস-তা অনেকে অনুধাবন করতেও ব্যর্থ হয়।
ব্রিটিশ টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানে মেজর (তৎকালীন) খালেদ মোশাররফ বিমর্ষচিত্তে কিন্তু গর্বভরে, যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগ এবং ত্যাগের কথা বলেন। উপস্থাপিকা ভানিয়া কিউলির এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন কোনও এলাকায় পাক আর্মির বিরুদ্ধে অপারেশন করে ফিরে আসি, পরবর্তীকালে খবর পাই পাক আর্মি সেই এলাকার গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমাদের ভয় হয় যে, গ্রামের সাধারণ মানুষরা কৃষক মজুররা বোধহয় আর আমাদের আশ্রয় দেবে না-সহযোগিতা করবে না। কারণ আমাদের কর্মকান্ডের জন্য তারা পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার হচ্ছে। কিন্তু না, উলটো গ্রামের মানুষ আমাদের বলে যে আমরা যেন পাক আর্মির বিরুদ্ধে আমাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখি। ঞযবু ংঃরষষ ধিহঃ ঃযধঃ বি ংযড়ঁষফ মড় রহঃড় ধপঃরড়হ (রহ ঃযবরৎ ধৎবধং)… বাবহ রভ ঃযবু যধাব ঃড় ংধপৎরভরপব বাবৎুঃযরহম. ঞযবু ঃবষষ ঁং, ঃযবু (চধশ অৎসু) পধহহড়ঃ ঃধশব ঃযব ংড়রষ ড়ঁঃ ড়ভ ড়ঁৎ পড়ঁহঃৎু. ঊাবহ রভ ঃযবু শরষষ ঁং ধষষ বি ড়িহ’ঃ ষবঃ ঃযবস ঃধশব ড়ঁৎ ংড়রষ. খবঃ ঃযব ংড়রষ ৎবসধরহ.
[তারা (জনগণ) তবু চায় আমরা তাদের এলাকায় অপারেশন করতে যাই, যদিও তাদেরকে সবকিছু ‘ত্যাগ’ করতে হবে। তারা বলে ওরা (পাক আর্মি) আমাদের মাটি নিতে পারবে না। ওরা যদি আমাদের সবাইকে মেরে ফেলে তবু ওদেরকে আমাদের মাটি নিতে দেবো না। আমাদের মাটি আমাদেরই থাকবে।]
ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশের মানুষ মাত্র ৪৫ বছর আগে দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল-সেই দেশের এক শ্রেণির মানুষ আজ কীভাবে টাকার বিনিময়ে তাদের পবিত্র আমানত ভোটাধিকার বিক্রি করে। কোথায় গেল সেই ত্যাগ? আজ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, বিশেষ করে সুশিক্ষিত সচেতন মানুষের উচিত সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। জাতীয় সংকটের সময় যে ত্যাগ-তিতিক্ষার আকাক্সক্ষা সাধারণ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে, শান্তিকালীনও ঠিক একই রকম আত্মত্যাগের অনুভূতি চেতনা অন্তত সমাজের একটা অংশের মধ্যে সদা জাগ্রত থাকতে হবে। তা না-হলে, দেশ-জাতির মুক্তি স্বপ্ন-স্বপ্নই থেকে যাবে। কোনও তন্ত্রমন্ত্রই কাজ দেবে না যদি না অন্তত জাতীয় নেতৃত্বের একটা অংশের মধ্যে আত্মত্যাগের চেতনা থাকে, যা দেশের সাধারণ মানুষকে দেশ গড়ার কাজে উজ্জীবিত করবে। নিঃসন্দেহে এটা একটা সুকঠিন কাজ। কারণ শ্রেষ্ঠ মানবীয় গুণাবলি যেমন সততা, দেশপ্রেম, পরার্থপরতা বা আত্মত্যাগের প্রশংসা করা যত সহজ, তা চর্চা করা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। আমার মতে, এটা মানবচরিত্রের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, যে মানুষ সর্বদা অন্য সৎ, ত্যাগী, পরোপকারী মানুষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ-সেই মানুষ নিজে সৎ, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক, পরোপকারী হতে চায় না। কিন্তু এ সুকঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে।
আত্মত্যাগের দীক্ষাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। এ শিক্ষাকে আত্মস্থ না-করলে আমাদের পরিত্রাণ নেই। পৃথিবীর সব উন্নত জাতিই তাদের মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসে তার নজির ভুরি ভুরি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ব্রিটেন প্রবাসী।