ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য নিরূপণ

139

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

ভাষা ও উপভাষার সীমারেখা সর্বদা স্পষ্ট নয়, যেমন নয় উপভাষা থেকে উপভাষার পার্থক্য। উপভাষা প্রধানত ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা রূপভেদ কিন্তু সামাজিক উপভাষার অস্তিত্বও গুরুত্বপূর্ণ। এক সময়ে ধারণা করা হতো শিষ্ট বা স্ট্যান্ডার্ড ভাষাই বিশুদ্ধ আর আঞ্চলিক ভাষা বিকৃত বা অশুদ্ধ কিন্তু সে ধারণার অবসান হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো ভাষার শিষ্ট বা স্ট্যান্ডার্ড রূপ একটি সামাজিক উপভাষা বৈ নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে কোনো ভাষার একটি বিশেষ রূপ বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং সেটি শিষ্ট রূপে গৃহীত হয়। প্রায়শ ভাষার এই আধুনিক শিষ্ট রূপটি কৃত্রিম বা মিশ্রিত হয়ে থাকে তুলনামূলকভাবে আঞ্চলিক বা গ্রাম্য বা লোকরূপের মধ্যেই ভাষার প্রাচীন রূপ কিছুটা অবিকৃত থাকে। অর্থাৎ ভাষার পরিবর্তন শিষ্টরূপ অপেক্ষা আঞ্চলিক রূপে কম ঘটে থাকে। ভাষার ইতিহাস পুনর্গঠনে আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষার বিশ্লেষণ ঐ জন্য প্রয়োজন হতে পারে।
ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পন্ডিতদের ধারণা ছিলো, অনুন্নত জাতি বা সম্প্রদায়ের বিশেষত আদিবাসীদের ভাষা তাদের জীবনযাত্রার মানের মতোই অনুন্নত। কিন্তু আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির আদিবাসীদের ভাষা বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে, ঐ সব অনুন্নত আদিবাসীদের ভাষা অন্যান্য উন্নত জাতির ভাষার মতোই পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত। আজকের পৃথিবীতে যে সব মানবগোষ্ঠী একান্তই আদিম রয়ে গেছে, যাদের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত উপাদান কাঠ, হাড় বা পাথরের টুকরোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং যারা পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছে, তাদের ভাষাও উন্নত ও সুসভ্য মানুষের ভাষার মতোই মানব মনের ভাবের আদান-প্রদানে সক্ষম। আবার শহরের আধুনিক ভাষার তুলনায় গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা মোটেও পশ্চাৎপদ নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে উপভাষা সম্পর্কিত ধারণা খুব স্বচ্ছ ছিলোনা। তখন পর্যন্ত আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বা গ্রাম্য ভাষাকে শিষ্ট বা সাধু ভাষার বিকৃত ও ভ্রান্তরূপ বলে বিবেচনা করা হতো। ১৯৭৫ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস বা উদ্ভব ও বিবর্তন স্থির করতে গিয়ে বিভিন্ন ভাষা ও উপভাষার সংগঠন-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড বা শিষ্ট ভাষা বিশেষ ঐতিহাসিক বা সামাজিক কারণে কোনো না কোনো উপভাষা থেকেই উদ্ভুত এবং উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা শিষ্ট বা সাধু ভাষার বিকৃত রূপ নয়। উপভাষাতত্ত্বে অগ্রণী ফরাসিরা; আঞ্চলিক ভাষাতত্ত্বে ইতালিয়ানদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রথম উপভাষা-মানচিত্র প্রণয়ন করেন জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ জর্জ ওয়েংকার তিনি তাঁর উপভাষা-প্রশ্নমালার উত্তর ভাষাতত্ত্ব-প্রশিক্ষণহীন গ্রাম্য স্কুল-শিক্ষকদের সহায়তায় সংগ্রহ করেছিলেন। ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোল শাস্ত্রের উদ্ভাবক ফরাসি পন্ডিত জুল গিলিয়েগাঁ, তিনি ফরাসি উপভাষা জরিপে দুই হাজার প্রশ্ন সম্বলিত একটি প্রশ্নমালা ব্যবহার করেন। এই প্রশ্নমালার উত্তর সংগ্রহে তিনি ই. এডমন্ট নামে একজন দক্ষ কর্মীকে নিযুক্ত করেছিলেন যিনি ফরাসি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ঐ প্রশ্নমালার উত্তর সংগ্রহ করেন। ফলে ফরাসি উপভাষা মানচিত্র জার্মান মানচিত্র থেকে নির্ভরযোগ্য হতে পেরেছিলো। ফরাসি ১৮৯৭ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংগৃহীত উপাদানের ভিত্তিতে ১৯০২-১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত। সমসাময়িক কালে ভারতীয় উপমহাদেশে জর্জ গ্রিয়ার্সন ভাষা জরিপ করেন। তিনি একটি প্রচলিত লোক কাহিনী বা গল্পের সাধুভাষায় লিখিতরূপ বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল শিক্ষকদের কাছে প্রেরণ করেন, তারা নিজ নিজ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় গল্পটি রূপান্তরিত করে ফেরত পাঠান। এভাবে গ্রিয়ার্সন বিভিন্ন ভাষা ও উপভাষার নমুনা সংগ্রহ করে তাঁর বিশ্লেষণ কয়েক খন্ডে ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে ১৯০৩ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষার উপভাষা পরিচয় ঐ সার্ভের ৫ম খন্ডের ১ম ভাগে প্রকাশিত হয়। ইতালির ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোল প্রকাশিত হয় ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, প্রণেতা কে. জেবার্গ এবং কে. জুড।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে উপভাষাতত্ত্ব মূলত শব্দের বিশ্লেষণে কেন্দ্রীভূত ছিলো। মুখের ভাষায় প্রচলিত শব্দের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে উপভাষাতাত্ত্বিকেরা শব্দার্থ, বিকিরণ এবং বাক্যে তাঁদের ভূমিকা অনুযায়ী শব্দের ইতিহাস পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছেন। ভৌগোলিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক জ্ঞানের সহায়তায় শব্দের ইতিহাস ব্যাখ্যার এক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিলো, এছাড়াও শব্দের ইতিহাস অনুসন্ধানে জাতীয় মানস এবং পুরাতন ও নতুন ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণাদি সতর্কভাবে পরীক্ষা করা হতো। উপভাষা বিশ্লেষণে একটি ভাষা উদ্ভব ও বিকাশে যেসব উপাদানের সংস্পর্শে আসে সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকৃত হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শেষ ও প্রথম দিকে ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোলের তত্ত্বগত ধারণা ছিলো নিম্নরূপ,
ক.    একটি ভাষার উপভাষাগত পার্থক্য প্রধানত শব্দ ও ধ্বনি সংগঠনে পাওয়া যায়, তুলনামূলকভাবে রূপ ও বাক্ বা ব্যাকরণে পার্থক্য কম।
খ.    সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্যের জন্যে গুরত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উপভাষার সংখ্যা বেশি কারণ বিভিন্ন সামন্তের অধীনে বিভিন্ন অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতা; অপর দিকে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শাসনে বিভিন্ন অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় ফলে উপভাষার সংখ্যাও কমে যায়।
গ.    ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্যের জন্যে ভৌগোলিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। সমতল ভূমির তুলনায় পার্বত্য ভূমিতে ভাষাতাত্ত্বিক প্রান্তিক অঞ্চল বেশি। সহজ যোগাযোগের জন্যে একটি ভাষাতাত্ত্বিক উদ্ভব, আগম বা পরিবর্তন সহজেই সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে অন্যদিকে একটি পার্বত্য অঞ্চলের ভাষা ভৌগোলিক কারণে সমতল ভূমিতে পরিব্যাপ্ত মূল ভাষার বিকাশ ও বিবর্তন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
ঘ.    উপভাষা বিলোপ বা অবক্ষয়ের গতি সাম্প্রতিককালে দ্রুততর হয়েছে, কারণ গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি অনুকরণ ও গ্রহণের চেষ্টা করছে। ‘‘গরষশধ ষারপয, ‘খরহমঁরংঃরপ এবড়মৎধঢ়যু,’ ঞৎবহফং রহ খরহমঁরংঃরপং. ঞযব ঐধমঁব, গড়ঁঃড়হ, ১৯৭০ ’’
ফরাসি উপভাষাবিদ্ গিলিয়েগাঁ শব্দের উদ্ভব বা আগমের দুইটি কারণ নির্দেশ করেছেন, একই ধ্বনিবিশিষ্ট ভিন্নার্থক শব্দের সংঘাত এবং শব্দ সংগঠনের অনুপযোগিতা। সমধ্বন্যাত্মক শব্দের ভিন্ন পরিবেশের জন্যে নির্দিষ্ট ভিন্ন অর্থ যখন একই পরিবেশে ব্যবহৃত হতে থাকে তখন নির্দিষ্ট তাৎপর্য ব্যাহত হয় এবং একটি নতুন শব্দ ঐ দুইটি ভিন্ন অর্থের একটিকে গ্রহণ করে ফলে অভিন্ন ধ্বনিবিশিষ্ট ভিন্নার্থক পরিবেশের অবসান ঘটে। যেমন, ফরাসি, গালকন উপভাষার ‘গাত’ শব্দটির দুটি অর্থ ছিলো বিড়াল ও মোরগ। অনেক বাক্যে এটা বোঝা যেত না যে কথক কি বলছেন, কুকুরটা কি বেড়াল ধরেছে না মোরগ? ফলে ‘গাত’ শব্দটি এক সময় থেকে কেবল মোরগ অর্থেই ব্যবহৃত হতে থাকে, বেড়ালের জন্যে অন্য শব্দের উদ্ভব হয়। সময়ের বিবর্তনে একটি শব্দের ধ্বনি সংগঠন বদলে যেতে পারে, অনেক সময় দেখা গেছে যে একটি শব্দ হয়তো শুরুতে ব্যবহার উপযোগী ছিলো কিন্তু ক্রমে ক্রমে শব্দটি অতিহ্রস্ব বা দীর্ঘ হয়ে পড়ার ফলে বা নতুন কোনো ধ্বনি উপাদান সংযোজিত হওয়ার ফলে ভিন্ন অনুষঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় একটি নতুন উপযোগী শব্দের উদ্ভাবন স্বাভাবিক, এভাবেই সমধ্বনি বিশিষ্ট ভিন্নার্থক শব্দে এবং অনুপযোগী শব্দ সংগঠনের কারণে নতুন শব্দের সৃষ্টি হতে পারে। উপভাষা নির্ণয়ে ফরাসিরা শব্দের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন যেমন দিয়েছিলেন জার্মানরা।
ইতালির নব-ভাষাতত্ত্ববিদরা উপভাষাতত্ত্বে মূল্যবান অবদান রেখেছেন, তাঁদের তত্ত্বের ভিত্তি ছিলো জার্মান ও ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক ভুগোলতত্ত্ব। নব-ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে একটি ভাষার মধ্যে অশুদ্ধ বলে কিছু নেই, যা টিকে থাকে সবই শুদ্ধ। তাদের মতে একটি ভাষার বিবর্তন প্রধানত ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক পটভূমি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সুতরাং তারা উপভাষা বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছেন। তারা সম্পর্কিত উপভাষাসমূহের তুলনামূলক পর্যালোচনায় গুরুত্ব দিয়েছেন। যেসব ভৌগোলিক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে একটি ভাষার উপভাষা বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয় তার প্রতি খুবই মনোযোগ দেন। এভাবেই ‘এরিয়েল লিঙ্গুইস্টিক্স’ বা আঞ্চলিক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। তারা ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য নিরূপণের জন্যে ‘সেস্ট্রাল’ এবং ‘পেরিফেরাল’ বা কেন্দ্র ও প্রাপ্ত অঞ্চলের যে পার্থক্য নির্দেশ করেন উপভাষার সীমানা নির্দেশের জন্যে যে ধারণা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ভাষা-অঞ্চলের যেখানে একটি ভাষাতাত্ত্বিক আগম বা উদ্ভব ঘটে সেটি কেন্দ্র অঞ্চল একটি ভাষা-অঞ্চলে সমগ্র ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের প্রেক্ষিতে অবশ্য কোনো কেন্দ্র অঞ্চল নেই। ভাষাতাত্ত্বিক প্রান্ত অঞ্চলে (ভৌগোলিক অর্থে) সাধারণত কিছু প্রাচীন বা অপ্রচলিত রূপ রক্ষিত থাকে কিন্তু প্রাপ্ত অঞ্চলে প্রাপ্ত সমস্ত ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যই প্রাচীন বা অপ্রচলিত রূপ নয়। তবে যদি দুইটি ভিন্ন প্রাপ্ত অঞ্চলে অভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক রূপ পাওয়া যায় তাহলে তা অপ্রচলিত বা প্রাচীন রূপ হয়ে থাকে। উপভাষাতত্ত্বের উপরোক্ত ধারণা ইতালিয়ানদের অবদান। ‘ওনরফ’ জার্মান, ফরাসি ও ইতালিয়ান উপভাষাবিদরা ভাষার আঞ্চলি বৈচিত্র্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যসমূহকে উপভাষা মানচিত্রে দৃশ্যমান করে তোলার পদ্ধতিরও উদ্ভাবক। একটি উপভাষা মানচিত্রে একটি বিশেষ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের অবস্থান এবং সীমা সমশব্দরেখা বা ‘আইসোগ্লস’ এর সাহায্যে নির্দেশ করা হয়। একটি ভাষার আঞ্চলি বৈচিত্র্যসমূহ যে সব সমশব্দ রেখার সাহায্যে বিবৃত করা হয় সেগুলো সমশব্দ রেখাগুচ্ছ। কোনো ভাষারই আঞ্চলিক বৈচিত্র্যসমূহ এক প্রকার নয়, তবে উপভাষা মানচিত্রে যেসব অংশে সমশব্দরেখা কম সে সব অঞ্চলকেই ঐ ভাষার বিভিন্ন উপভাষার কেন্দ্র অঞ্চল বা ‘ফোকাল এরিয়াজ’ বলা হয়। নতুন উদ্ভব বা আগম একটি কেন্দ্র অঞ্চল থেকে উদ্ভুত হয়ে সম্প্রসারিত হয় এবং তা ঐ কেন্দ্র অঞ্চলের প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গৃহীত হয়। একটি উপভাষা অঞ্চলের প্রান্ত বা সীমান্ত অঞ্চলসমূহ উপভাষা বৈশিষ্ট্যের সন্ধি অঞ্চল বা ‘ট্রানজিশান এরিয়াজ,’ আর সম-শব্দরেখা অঞ্চল বহির্ভূত এলাকা সম্প্রসারিত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দূরবর্তী অঞ্চল বা ‘রেলিক এরিয়াজ’। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক কারণে দূরবর্তী অঞ্চলের সৃষ্টি হতে পারে। ‘‘ডরহভৎবফ চ. খবযসধহহ, ‘ইৎড়ধফবহরহম ড়ভ খধহমঁধমব গধঃবৎরধষং.’ ঐরংঃড়ৎরপধষ খরহমঁরংঃরপং. ঘবি ণড়ৎশ, ঐড়ষঃ, জরহবযধৎঃ ধহফ রিহংঃড়হ, ১৯৬৬, চ. ১২৬-১২৮. ’’
ইতালির নব-ভাষাতাত্ত্বিকেরাই ভাষার ‘সাবস্ট্রেটাম’ বা ‘উপস্তর’ তত্ত্বের উদ্ভাবক। এই তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য, যদি কোনো জনগোষ্ঠী তার মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে অপর কোনো ভাষা গ্রহণ করে তাহলে পরবর্তী ভাষাটি পূর্ববর্তী ভাষার প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রে একটি ভাষাতাত্ত্বিক উপস্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। ‘‘গরষশধ ওারপয, ওনরফ’’ উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে আর্যভাষা বিস্তারের পূর্বে অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর মুন্ডা এবং অন্যান্য অনার্যভাষার প্রচলন ছিলো। অনুমান করা যেতে পারে যে এই সব অঞ্চলে আর্যভাষার প্রচলন হলেও সম্ভবত পূর্ববর্তী অনার্য ভাষাসমূহের প্রভাবে পরবর্তী আর্যভাষার সংগঠনে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে, যার প্রমাণ ধরা পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষায় বিশেষত পূর্ববঙ্গীয়তে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী অনার্যভাষাসমূহকে বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাভাষার উপস্তর বলা যেতে পারে। সম্ভবত ঐ কারণেই বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলা উপভাষায় ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনির অভাব, স্পৃষ্ট তালব্য ধ্বনির পরিবর্তে ঘৃষ্ট বা উষ্ম দন্ত্য ধ্বনির ব্যবহার, স্বরধ্বনিতে সানুনাসিকতার অভাব এবং তাড়নজাত মূর্ধন্য ধ্বনির অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এই সব ধ্বনিগত উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি আর্যপূর্ব অনার্যভাষাসমূহের ধ্বনি সংগঠনের কারণে হতে পারে। এ সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত নিম্নরূপ,
বাঙলাদেশে আর্য-ভাষার আগমনের পূর্বে, কোল আর দ্রাবিড়, আর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ভোট-চীনা, এই তিনটি ভাষারই অস্তিত্বের প্রমাণ পাই … আর্যদের আগমনের কালে যে ভাষা দ্রাবিড় আর কোল-ই ছিলো, এই অনুমান মেনে নিতে প্রবৃত্তি হয় … সমস্ত উত্তর-ভারতময়- বাঙলাদেশকেও ধরে-দ্রাবিড়- আর কোল-ভাষী লোকদের অবস্থানের পক্ষে প্রমাণ আর যুক্তি বিস্তর আছে, ‘‘ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঙলাভাষা আর বাঙালি জাতের গোড়ার কথা,’ বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫০, পৃ. ৩৩।’’
বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভবের পরে অধিকতর সংখ্যায় বিভিন্ন উপভাষার সংগঠনের বর্ণনামূলক বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে। সাংগঠনিক বিশ্লেষণে উপভাষা বৈশিষ্ট্য কেবল তথ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি রবং যে নিয়মে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট পারস্পরিক-সম্পর্কে-সম্পর্কিত, সেগুলোর ওপরেও আলোক নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সাংগঠনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন উপভাষার সমান্তরাল ব্যবস্থাসমূহের তুলনামূলক পর্যালোচনায় বিভিন্ন উপভাষার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য স্ফুটনে ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্বের দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সাংগঠনিক বিশ্লেষণের ফলে উপভাষাতত্ত্বে নতুন নতুন সংজ্ঞা ও ধারণা সংযোজিত হয়েছে, যেমন ‘ডায়াসিস্টেম’- গ্রাফের সাহায্যে দুইটি ভাষা বা উপভাষা ব্যবস্থার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যকে প্রদর্শিত করা। ‘ইডিয়লেক্ট’-একজন ভাষাভাষীর বাক-বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করা প্রভৃতি। দ্বিভাষী সম্প্রদায়ে ভাষা ব্যবস্থার অবস্থা পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি নির্ণয় এবং সহ-অবস্থানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা বা উপভাষা সংগঠনের পারস্পরিক প্রভাব নির্ণয়ের মাধ্যমে ভাষাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবপর হয়েছে। মার্কিন উপভাষাবিদ হ্যানস্ কুরাথ্, র‌্যাভেন ম্যাকডেভিড এবং উইলিয়াম লেবভ ভাষার বৈচিত্র্য অবলোকনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন, তাঁরা ভাষার ভৌগোলিক বা আঞ্চলিক বৈষম্য অপেক্ষা সামাজিক বৈচিত্র্য অবলোকনে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিংশ শতাব্দীতে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালিতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাষার বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। সোয়াবিয়ান উপভাষাবিদ্ ফিশার আবিষ্কার করেছেন যে দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির আঞ্চলিক উপভাষার সীমানা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজনৈতিক সীমারেখার সঙ্গে অভিন্ন। জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির উপভাষা সীমানাগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে জাবের্গ দেখিয়েছেন যে ঐ সব দেশের উপভাষা বৈচিত্র্য নির্দিষ্ট এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের প্রত্যক্ষ ফল। ফ্রান্সে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা, গত কয়েক শতাব্দী যাবৎ এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে ঐ দেশে উপভাষার সামারেখা খুব স্পষ্ট নয়, বিভিন্ন উপভাষার পার্থক্যও অস্পষ্ট, ব্যতিক্রম কেবল দূরবর্তী অঞ্চলসমূহ। ইতালিতে একক সময়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শক্তি শাসিত নগর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলো ফলে বিভিন্ন উপভাষার সীমারেখাও বেশ স্পষ্ট। জার্মানিতে রাষ্ট্রনৈতিক ভাঙ্গাগড়া গেছে বেশি, অনেক ছোট ছোট    (চলবে)