সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

43

kibriaবিগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামীলীগ অঙ্গ সংগঠন ও কিবরিয়া স্মৃতি পরিষদ। ২০০৫ সালের এই দিন হবিগঞ্জ সদর উপজেলা বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় তিনিসহ ৫ জন নিহত ও কমপক্ষে ৭০ জন আহত হন।
বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডি : ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। বক্তব্য শেষে যখন তিনি মঞ্চ থেকে নেমে সহকর্মীদের নিয়ে বৈদ্যের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেইটে আসেন তখনই গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে শাহ এএমএস কিবরিয়া, তার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী প্রাণ হারান। আহত হন কমপক্ষে ৭০ নেতাকর্মী।
কিবরিয়া হত্যা মামলা ও তদন্ড কার্যক্রম : এ ঘটনার পরদিন ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু মামলাটির স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে দলীয় বিবেচনায় পরিচালিত হতে থাকে।
সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে তৎকালীন জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, জেলা বিএনপির কর্মী ও ব্যাংক কর্মকর্তা আয়াত আলী, কাজল মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহ-দপ্তর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জিয়া স্মৃতি গবেষণা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী, বিএনপি কর্মী তাজুল ইসলাম, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জমির আলী, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন মোমিন ও ছাত্রদল কর্মী মহিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়। আব্দুল কাইয়ুমকে স্বীকারোক্তির জন্য ৪৭ দিন রিমান্ডে নেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলার বাদী এডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করেন। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামী করে এই আলোচিত মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকান্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামী করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল। সম্পুরক চার্জশীটে ১ম ১০ জনের বাইরে অভিযুক্তরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, লস্কর ই তৈয়বা সদস্য আব্দুল মজিদ কাশ্মীরি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু’র ভাই মাওলানা তাজ উদ্দিন, মহিউদ্দিন অভি, শাহেদুল আলম দিলু, সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ, ফজলুল আলম মিজান, মিজানুর রহমান মিঠু, মোহাম্মদ আব্দুল হাই, মোহাম্মদ আলী, মুফতি সফিকুর রহমান, বদরুল এনায়েত মোঃ বদরুল, বদরুল আলম মিজান।
২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশীটের উপর হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আবেদনে আসমা কিবরিয়া উল্লেখ করেন, যেহেতু তদন্তকারী কর্মকর্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে উল্লে¬খ রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতা কর্মীদের পরস্পর যোগসাজসে হরকাতুল জিহাদ সদস্যদের সহায়তায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সিলেটের মেয়র বদর উদ্দিন কামরানের উপর দুই দফা হামলা, আওয়ামীলীগের এমপি জেবুন্নেছা হকের বাসায় গ্রেনেড হামলা, বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা, সুরঞ্জিত সেনের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ও কিবরিয়ার উপর বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু অন্য কারো নাম অভিযোগপত্রে নেই। তাই তা যথাযথভাবে তৈরি হয়নি। এছাড়াও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এমদাদুল হককে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মূল তথ্য উদঘাটন হবে বলে আসমা কিবরিয়া দাবি করেন। তিনি আরও দাবি করেন অভিযোগপত্রে দন্ডবিধি ১১৪ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারা কার উপর বর্তায় তা পরিষ্কার ভাবে সামনে আসেনি। তার দৃঢ় বিশ্বাস, অভিযোগপত্রে যাদের নাম এসেছে তার বাইরেও আরও অনেকেই জড়িত রয়েছেন।
আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকান্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র : ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিলেট অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্তর্ভুক্ত আসামীরা হলেন সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। একই সাথে পূর্বের চার্জশীটভূক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহকে চার্জশীট থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। ৩ ডিসেম্বর মামলার শুনানিকালে অভিযোগপত্রে ত্র“টির কথা উল্লেখ করে সংশোধিত অভিযোগপত্র জমা দেয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ প্রেক্ষিতে ২১ ডিসেম্বর সংশোধিত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। একই সাথে পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়া হয়।
সিসিক মেয়র আরিফ ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়র গউছের আত্মসমর্পণ : ৩য় দফা সম্পূরক চার্জশীট আদালতে গৃহিত হওয়ার পর ২৮ ডিসেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছ। এর দু’দিন পর ৩০ ডিসেম্বর একই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন সিলেট সিটি কর্পোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ৩১ ডিসেম্বর আরিফুল হক চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে স্থানীয় সরকার আইনে মেয়র পদ থেকে তাদেরকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
মৃত্যুবার্ষিকীর বিভিন্ন কর্মসূচি : ২৭ জানুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১০ম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা ও হবিগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা। পৃথকভাবে এ কর্মসূচিগুলো পালন করবে আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠন এবং কিবরিয়া স্মৃতি সংসদ। এছাড়া ঢাকায় মরহুমের গোরস্থানে পুস্পস্তবক অর্পণ করবে কিবরিয়া পরিবার। আসমা কিবরিয়া জানান, মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচি থাকলেও রাজনৈতিক কারণে পুলিশ তার অনুমতি দেয়নি। এ ব্যাপারে ফেব্র“য়ারি মাসে বড় ধরণের কর্মসূচি পালন করা হবে।
আহতদের আর্তনাদ : বৈদ্যোর বাজার ট্র্যাজেডিতে অনেকেই এখনও পঙ্গু অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। সেই ভয়াল স্মৃতি এখনও তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি এডভোকেট মো. আবু জাহির এমপি বলেন, আমি বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হলেও এখনও আমার গায়ে গ্রেনেডের শত স্পি­ন্টার। পায়ে স্টিল লাগানো। তবে আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি এটাই বড় কথা।
নবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর চৌধুরী বলেন, ওই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছি। এ ঘটনা এখনও আমি ভুলতে পারিনি। বিচার যেহেতু শুরু হয়েছে আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আহত আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল্লাহ সরদার বলেন, সেদিন বিকট শব্দের পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। কিছুই মনে ছিল না আর। দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হলেও কোনভাবে চলাফেরা করেন তিনি। গ্রেনেড হামলায় আহত অ্যাডভোকেট আব্দুল আহাদ ফারুক বলেন, আমি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছি। তবে শরীরের যে বেদনা বইতে হয়েছিল তা ছিল কঠিন। আল্লাহর রহমতে এখন সুস্থ আছি। গ্রেনেড হামলায় আহত কুদ্দুছ মিয়া জানান, আমরা অনেক কষ্টে আছি। এখন আর আমাদের খোঁজ নেয় না। তবে আমরা সরকারি ভাবে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। ২৭ জানুয়ারির কথা স্মরণ করতেই আঁতকে উঠেন তিনি।
এদিকে আওয়ামীলীগের প্রবীণ এই নেতার মৃত্যুতে আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।