সন্ত্রাস প্রতিরোধে মহানবী (সা:)’র কৌশল

108

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
২। ন্যায়ানুগ পন্থার বিপরীতে বিকৃত পথে জীবন চালানো। প্রাচীনকালের আদ, সামুদ, লুত, মাদায়েনবাসীসহ বিভিন্ন জাতিকে আল-কুরআনে আল্লাহ ফাসাদকারী হিসেবে গণ্য করেছেন। কারণ তারা সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠভাবে জীবন-যাপনের পরিবর্তে বিকৃত পথে জীবনকে চালিত করেছিল।
আল্লাহ বলেন: “যারা দেশে সীমালংঙ্ঘন করেছিল এবং সেখানে অশান্তি  বৃদ্ধি করেছিল। “আল-কুরআন, ৮৯:১১-১২” অন্য আয়াতে অল্লাহ বলেন: “তোমরাই তো পুরুষ উপগত হচ্ছ, তোমরাই তো রাহাজানি করে থাক এবং তোমরাই তো নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্য কাজ করে থাক। উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু এই বলল, আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আনয়ন কর- যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” “আল-কুরআন, ২৯:২৯”
৩। আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়। সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের ফলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় তাও ফাসাদ। আল্লাহ বলেন: “সে বলল. রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্তকরে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অপদস্থ করে, এরাও এরূপই করবে।” “আল-কুরআন ২৭:৩৪।” অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন, “আর সেই শহরে ছিল এমন নয় ব্যক্তি, যারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করত এবং সৎকর্ম করত না।” “আল-কুরআন, ২৭:৪৮।”
৪। জুলুম, অবিচার ও লুটতরাজের কাজে প্রশাসনিক ক্ষমতার ব্যবহার করা। যে ধরণের শাসন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষমতাকে মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের পরিবর্তে জুলুম, অবিচার ও লুটতরাজের কাজে ব্যবহার করা হয় তাকে আল-কুরআন ‘ফাসাদ’ নামে অভিহিত করেছে। আলাহ বলেন: ‘‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।” “আল-কুরআন, ২: ২০৫।”
৫। সন্ত্রাসের মাধ্যমে যারা সমাজে অশান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায় আল-কুরআন তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ বলেন: “যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” “আল-কুরআন, ২: ২৭”
৬। অন্যায়ভাবে বা পৃথিবীতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করার শামিল। আল্লাহ বলেন: “এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করার কারণ ব্যতীত কেউ কাউকেও হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল।” “আল-কুরআন, ৫: ৩২”
৭। পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের শাস্তি ও পরিণতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় এটা তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের মহাশাস্তিরয়েছে।” “আল-কুরআন, ৫: ৩৩”
হাদীসে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ : ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস আল-হাদীসের সন্ত্রাস শব্দটি সরাসরি ব্যবহৃত না হলেও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিভিন্ন দিক বুঝাতে বেশ কিছু পরিভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সেসব পরিভাষার অন্যতম হলো, আল-কতলু বা হত্যা, আয-যুলম বা অত্যাচার, আত-তারভী, বা ভয় প্রদর্শন, হামলুছ ছিলাহ বা অস্ত্র বহন করা, আল-ইশারাতু বিছ-ছিলাহ বা অস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিত করা ইত্যাদি। তবে এসব পরিভাষা ছাড়াও বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ডকে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ বুঝাতে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কয়েকটি নিম্নে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হলো।
১। একে অপরের প্রতি অত্যাচার করা নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন: “হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার জন্য অত্যাচার হারাম করেছি এবং তা তোমাদের জন্যও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর অত্যাচারে লিপ্ত হয়ো না।” “ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদাবি, অনুচ্ছেদ: তাহরীমুয যুলুম, বৈরূত: দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবি, তা.বি., খ. ৪, পৃ. ১৯৯৪।”
২। স্বাভাবিকভাবে একজনের রক্ত, সম্পদ, সম্মান হানী করা অপরজনের জন্য হারাম। রাসূল (সা.) বলেন: তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান পরস্পরের জন্য ঐরূপ হারাম যে রূপ হারাম তোমাদের এই শহর, তোমাদের এই মাস এবং তোমাদের এই দিন “ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়: আল-ঈমান, অনুচ্ছেদ: কওলিন নাবিয়্যি (সা.) রুববা মুবালাগিন আও’আ মিন সামিঈন, বৈরূত: দারু ইবনু কাছীর, ১৯৮৭, খ. ১, পৃ. ৩৭।”
৩। কোন মুসলিমকে আতঙ্কিত করা অবৈধ। রাসূল (সা.) বলেন: “কোন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিম ভাইকে আতঙ্কিত বা সন্ত্রস্ত করা বৈধ নয়।” “ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-আদাব, অনুচ্ছেদ: মাই ইয়াখুযুশ শাইআ ‘আলাল মিযাহি, বৈরূত: দারুল কিতাব আল- আরাবিয়্যা, তা.বি.খ. ৪, পৃ. ৪৫৮”
৪। কোন মুসলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারী ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর সদস্য নয়। এ মর্মে রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি তোমাদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, সে আমাদের অন্ত র্ভুক্ত নয়।” “ইমাম বুখারী, সহীহ আল- বুখারী, অধ্যায়: আদ- দিয়াত, অনুচ্ছেদ: কওলুল্লাহি তা’আলা ওয়া মান আহইয়াহা/ আল-মায়িদাহ- ৩২, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ২৫২০”
৫। কোন মুসলিমের অস্ত্র দ্বারা হুমকি দেয়া নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের মাঝে কেউ যেন তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দ্বারা হুমকি না দেয়। কেননা হতে পারে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও শয়তান তার হস্তদ্বয় আঘাত হানার ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটবে; অতঃপর সে এ অপরাধের কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে”। “ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়: আল-ফিতান, অনুচ্ছেদ: কওলুন্নাবিয়্যি স. মান হামালা আলান্নাস সিলাহা ফা লাইসা মিন্না, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ২৫৯২”
রাসূল (সা.) বলেন: “কোন ব্যক্তি যদি লোহা দ্বারা তার ভাইকে হুমকি দেয় তবে তা থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত  ফিরিশতাগণ তার প্রতি অভিশাপ করতে থাকেন যদিও হুমকি প্রদানকৃত ব্যক্তি তার সহোদর ভাই হয়।” “ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আল- বিররি ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদব অনুচ্ছেদ: আন-নাহইউ আনিল ইশারাতি বিসসিল্লাহি ইলা মুসলিমিন, প্রাগুক্ত, তা.বি, খ. ৪, পৃ. ২০২০।”
৬। আত্মঘাতি হামলার মাধ্যমে আত্মহত্যাও হারাম। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি পৃথিবীতে নিজেকে কোন বস্তু দ্বারা হত্যা করবে কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে।” “ইমাম বুখারী, সহীহ আল- বুখারী, অধ্যায়: আল- আদাব, অনুচ্ছেদ : মা ইউনহা ‘আনিস সিবাবি ওয়াল লা’নি, প্রাগুক্ত, খ. ৫, পৃ. ২২৪৭।” রাসূল (সা.) আরো বলেন: “যে ব্যক্তি নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করবে তাকে জাহান্নামে অনুরূপভাবে শাস্তি দেয়া হবে। যে ব্যক্তি নিজেকে আঘাত করে আত্মহত্যা করবে তাকেও জাহান্নামে অনুরূপভাবে আঘাত করা হবে।” “ইমাম বুখারী, সহীহ আল- বুখারী, অধ্যায়: আল-জানাইয, অনুচ্ছেদ: মা জা‘আ কাতিলিন নাফস, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৪৫৯”
৭। শুধু মুসলিম ব্যক্তি নয়, কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের হত্যা করাও নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি মুসলিম জনপদে বসবাসকারী চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলিমকে হত্যা করবে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব হতেও তার সুগন্ধ পাওয়া যাবে।” “ইমাম বুখারী, সহীহ আল- বুখারী, অধ্যায়: আল- জিযইয়া ওয়াল মাওয়াদিআতি, অনুচ্ছেদ: ইছমু মান কাতালা মু‘আহিদা বিগাইরি জুরম, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ১১৫৫”
৮। সন্ত্রাসীর অন্তরে দয়ামায়া থাকে না, তাই সে হতভাগা। রাসূল (সা.) বলেন: “একমাত্র দুর্ভাগা ব্যক্তি হতেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়”। “ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল- আদাব, অনুচ্ছেদ: ফির রহমাতি, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ৪৪১”
৯। ইচ্ছাকৃত কোন মু‘মিনকে হত্যা করা বড় গুনাহসমূহের অন্যতম যার গুনাহ আল্লাহ মা‘ফ করবেন না। রাসূল (সা.) বলেন: “আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপনকারী ও ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু‘মিন ব্যক্তিকে হত্যার গুনাহ ব্যতীত অন্য যে কোন গুনাহকে আল্লাহ হয়তো ক্ষমা করে দিবেন।” “ইমাম আবু দাউদ, আস- সুনান, অধ্যায়: আল ফিতান, অনুচ্ছেদ: ফী তা’যীমি কতলিল মু‘মিনি, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ১৬৭”
১০। অন্যায়ভাবে মু‘মিনকে হত্যাকারীর কোন ইবাদত কবুল করা হবে না। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন মু‘মিন ব্যক্তিকে হত্যা করবে আল্লাহ তার কোন নফল ও ফরয ইবাদত কবুল করবেন না।” “ইমাম আবু দাউদ, আস- সুনান, অধ্যায়: আলফিতান, অনুচ্ছেদ: ফী ত’যীমি কতলিল মু‘মিন, প্রাগুক্ত, তা.বি., খ. ৪, পৃ. ১৬৭”
১১। নিষিদ্ধ পন্থায় অপরের রক্তপাত ঘটানো মু‘মিনকে উচ্চ মর্যাদা থেকে স্খলিত করে। রাসূল (সা.) বলেন: “মু‘মিন ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন জীবন-যাপন করতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত  হারাম পন্থায় অন্যের রক্তপাত না ঘটাবে।” “ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আলফিতান, অনুচ্ছেদ: ফী তা’মীমি কাতলিল মু‘মিন, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ১৬৭”
১২। কোন মুসলিমকে হত্যা করা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার থেকেও গুরুতর। রাসূল (সা.) বলেন: “আল্লাহর নিকট সারা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার চেয়েও গুরুতর হচ্ছে কোন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা।” “ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আদ-দিয়াত আন রাসূল (সা.) অনুচ্ছেদ: মা জাআ ফী তাশদীদি কতলিল মু‘মিননি, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৩, খ. ২, পৃ. ৪২৬”
১৩। নিরাপত্তা প্রদানকৃত যে কোন ধর্মাবলম্বীকে হত্যাকারীর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। রাসূল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রদানকৃত ব্যক্তিকে হত্যা করে আমার সাথে ঐ হত্যাকারীর কোন সম্পর্ক থাকবে না, যদিও নিহত ব্যক্তি কাফির হয়।” “ইমাম আত-তাবারানী, আল-মু‘জামুস সগীর, অধ্যায়: হারফুল হামযাহ, অনুচ্ছেদ: আল-আলফ মিন ইসামিহি আহমাদ, বৈরুত: আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ১৯৮৫, খ. ১, পৃ.১৪১৫”
সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম : আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম। আল্লাহ বলেন: “নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন।” আল-কুরআন, ৩: ১৯। অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন, “কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভৃক্ত।” আল-কুরআন, ৩ : ৮৫। ইসলাম শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই শান্তি। এ জীবনব্যবস্থার এরূপ নামকরণই প্রমাণ করে যে, মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি  প্রতিষ্ঠার চিন্তা ইসলামের সামগ্রিক প্রকৃতি ও মৌল দৃষ্টিকোণ হতে উৎসারিত। তাই ইসলামের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান থেকে শান্তির ফল্গুধারা নিঃসৃত হয়। শান্তিময় পরিবেশের স্থায়িত্ব বজায় রাখার শান্তি বিঘিœত করে এমন সকল কর্মকান্ড প্রতিরোধ অপরিহার্য। তাই যৌক্তিকভাবেই ইসলাম শান্তি  প্রতিষ্ঠা ও এর স্থায়িত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সকল ধরণের সন্ত্রাসকে প্রতিরোধে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্র্মূল করার নির্দেশনা দান করে। ইসলাম বলতে প্রথমত ও প্রধানত কুরআন ও রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ বা হাদীসকেই বুঝায়। রাসূল (সা.) বলেছেন: “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, এই দু‘টি জিনিসকে যতক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত  তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না, সে দু‘টি জিনিস হলো আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন ও তাঁর রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ তথা হাদীস।” “ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, অধ্যায়: আল-ক্বাদর, অনুচ্ছেদ: আন-নাহইউ আনিল কওলি বিল ক্বাদর, মিসর: দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবিয়্যি, তা.বি., খ. ২, পৃ. ৮৯৯”
তাই সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা বলতে সন্ত্রাস প্রতিরোধে কুরআন ও রাসূল (সা.) এর সুন্নাহতে বর্ণিত নির্দেশনাসমূহ বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য যে, সন্ত্রাস প্রতিরোধক আয়াত, হাদীস ও রাসূল (সা.) এর আদর্শ এত বেশি যে, তার সবগুলো এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা অসম্ভব। তাই এ ব্যাপারে ঐ তিন উৎসের মৌলিক নির্দেশনাসমূহ নিম্নে পেশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। সন্ত্রাস প্রতিরোধে আল-কুরআনের নির্দেশনা ঃ আল-কুরআনে প্রথমত সাধারণতভাবে সন্ত্রাসের কারণ সৃষ্টি হওয়ার ছিদ্রপথ বন্ধ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
১। ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ ও অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ করতে নিষেধ প্রদান করে আল-কুরআনে নির্দেশনা এসেছে যে, “আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘন; তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।” “আল-কুরআন, ১৬: ৯০”
২। সন্ত্রাস মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনের ফলেই সৃষ্ট। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে আল-কুরআনে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহ বলেন: “বল, হে কিতাবীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি কর না; এবং যে সম্প্রদায় ইত:পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে ও সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।” “আল-কুরআন, ৫: ৭৭” অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; কিন্তু সীমালঙ্ঘন কর না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।” “আল-কুরআন, ২: ১৯০” উপরোক্ত প্রথম আয়াতে আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য করে এবং দ্বিতীয় আয়াতে সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রের প্রসঙ্গ বর্ণিত হলেও অন্যান্য আয়াত ও হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ি মুসলিমদের জন্যও সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ।
৩। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ। সন্ত্রাস নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাই সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল-কুরআনে নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ বলেন: “দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটাইও না, তাঁকে ভয় ও আশার সাথে ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকবর্তী।” “আল-কুরআন, ৭: ৫৬”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত মুফাসসির হাফিয ইবনে কাছীর (র.) বলেন, “শান্তি  স্থাপনের পর ভূ-পৃষ্ঠে বিপর্যয় ও যে সকল কর্মকা- পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কেননা যখন কাজ-কারবার শান্তি পূর্ণ পরিবেশে যথাযথভাবে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়, তবে তা হবে বান্দার জন্য বেশী ক্ষতিকর। এজন্য আল্লাহ                                 (চলবে)