আজ বিশ্বনাথ হানাদার মুক্ত দিবস

64

জাহাঙ্গীর আলম খায়ের, বিশ্বনাথ থেকে :
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ হানাদার মুক্ত হয়। ওইদিন দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বিশ্বনাথের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার ও এ অঞ্চলের রাজাকারদের পরাজিত করে দেশের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন। অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে (২০১৪ সাল) এ পর্যন্ত বিশ্বনাথ হানাদার মুক্ত হওয়ার সঠিক ইতিহাস বা তারিখ নিয়ে অনেকের মধ্যেই মতবিরোধ রয়েছে। কেউ ৯ ডিসেম্বর, কেউ ১০ ডিসেম্বর আবার কেউবা ১১ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ হানাদার মুক্ত দিবস বলে থাকেন। বিশ্বনাথ মুক্ত দিবসের নির্দিষ্ট তারিখ ও প্রকৃত তথ্য অনেক লেখক ও সাংবাদিকরা ঢাকার সেগুন বাগিচার জাতীয় জাদুঘরে খোঁজ করেও পাননি। তবে ১৯৯৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মরহুম আব্দুন নূর’র আত্মজীবনী মূলক একটি লিখা এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে জানা গেছে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ হানাদার মুক্ত দিবস। যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের ১১টি সেক্টরের মধ্যে সিলেটের বিশ্বনাথ থানাটি ৪ ও ৫নং সেক্টরের অধীনে ছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭১সালের ২০নভেম্বর ৪নং সেক্টরের ১নং কোম্পানী কমান্ডার আব্দুন নূর কমলগঞ্জ থানার পতনসার ইউনিয়ন শত্র“ মুক্ত ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সেখানকার শফিক চৌধুরীকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করেন। ওই দিন রাজনগর কামারচক ইউনিয়নকেও হানাদার মুক্ত করেন। তারপর ৫ ডিসেম্বর সমশের নগরে আব্দুন নূর হানাদারদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করেন। এতে অনেক হানাদার প্রাণ হারান এবং বাকিরা মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে যান। তিনি ৫ ডিসেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে শমসেরনগর ও রাজনগর এলাকা শত্র“ মুক্ত করেন। তখন হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া একটি মোটর সাইকেল নিয়ে কমান্ডার আব্দুন নূর ও তার সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধা জগলু তরফদারকে সাথে নিয়ে বালাগঞ্জের দিকে চলে আসেন। ৮ ডিসেম্বর জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যেমে বালাগঞ্জকে শত্র“ মুক্ত ঘোষণা করেন। পরদিন ৯ ডিসেম্বর কমান্ডার আব্দুন নূর তাজপুর, কুরুয়া, দয়ামীর, নাজির বাজার, রশিদপুর শত্র“ মুক্ত ঘোষণা করে পথসভা করেন। ওই দিন (৯ ডিসেম্বর) বিশ্বনাথ থানাকে শত্র“ মুক্ত ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা রশিদপুর এসে জানতে পারেন একদল রাজাকার ও বিশ্বনাথ থানার তৎকালীন ওসি আবুল হোসেন, দারগা আলী হোসেন স্থানীয় রাজকারদের নিয়ে বিশ্বনাথকে মুক্ত দিবস ঘোষণা ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে দিচ্ছেন না। এ সংবাদে উত্তেজিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুন-নূরের নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরে পৌঁছেন, এবং পুলিশ ও রাজাকারদের সঙ্গে বাক যুদ্ধে লিপ্ত হন। এক পর্যায়ে রাজাকাররা পালিয়ে যায় এবং থানা পুলিশ আত্ম-সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। থানা পুলিশের আত্ম-সমর্পণে অধিক রাত হওয়ায় ওই দিন আর বিজয় পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। তাই উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিগামী মানুষকে পরদিন ১০ ডিসেম্বর সকালে থানা সদরে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ীতে চলে যান। ১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বিশ্বনাথ থানা সদরের রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক বিরাট সমাবেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বিশ্বনাথকে শত্র“ মুক্ত ঘোষণা করেন বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ আব্দুন নূর। তিনি বিশ্বনাথ ইউনিয়নের মিরেরচর গ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আব্দুল মুতলিব বিএসসিকে তখন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। এই সমাবেশে চতুরদিক থেকে বিপুল সংখ্যক জনতা ‘‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’’ গগণবিদারী শ্লোগান দিয়ে সমাবেশস্থলে যোগ দেন। পতাকা উত্তোলনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে বিলম্ব হওয়ায় পরদিন সমাবেশ করার পুনরায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১১ ডিসেম্বর দৌলতপুর গ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুর রব চৌধুরী ওরফে সমুজ মিয়ার সভাপতিত্বে এক বিজয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান অথিতির বক্তব্য রাখেন খাজাঞ্চী ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান রায়পুর টিমাইঘর গ্রামের মৌলভী মরহুম আমজদ আলীর ছেলে ৫নং সেক্টরের কোম্পানী কমান্ডার মোঃ আব্দুন নূর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন খাজাঞ্চী ইউনিয়নের শহীদ সুলেমান নগর গ্রামের ৫নং সেক্টরের ল্যান্স নায়ক গোলাম মস্তফা। সমাবেশে স্থানীয় জনগণের পক্ষে বক্তব্য রাখেন মরমী কবি হাছন রাজার দৌহিত্র প্রাক্তন মন্ত্রী মরহুম দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরীর ছেলে দেওয়ান সমসের রাজা চৌধুরী, মিরেরচর গ্রামের প্রশাসক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আব্দুল মুতলিব বিএসসি, একই গ্রামের মরহুম আব্দুল মন্নান মনাফ, চান্দসির কাপন গ্রামের মরহুম ইসকন্দর আলী সারং, একই গ্রামের মরহুম কয়েছ চৌধুরী, বিশ্বনাথ ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মুফতির গাঁওয়ের আকমল আলী, রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ধর্মদা গ্রামের তজম্মুল আলী, বিশ্বনাথ ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আছলম খান, একই ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামের একরাম মিয়া, রামপাশা ইউনিয়নের নরসিংহ পুর গ্রামের মরহুম আইন উল্লা মহাজনসহ নেতৃবৃন্দ।
প্রসঙ্গত, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশ্বনাথের ১৩২ জনের মধ্যে সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২৬জন। এর মধ্যে ৫ জন শহীদ, একজন বীরবিক্রম এবং একজন বীরপ্রতিক রয়েছেন। বীরবিক্রম হলেন উপজেলার রহিমপুরের মরহুম সুবেদার আব্দুল মালেক ও বীর-প্রতীবক উপজেলার দেওশলস ইউনিয়নের আগ্নোপাড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন, খাজাঞ্চি ইউনিয়নের শহীদ সুলেমান নগররের শহীদ সুলেমান হোসেন, বাওনপুর গ্রামের শহীদ আব্দুল আহাদ ও শহীদ দীগেন্দ্র কুমার দাস, দেওকলস ইউনিয়নের সৎপুর গ্রামের শহীদ শামছুল হক এবং সৈয়দপুরের (সদুরগাও) শহীদ নরমুজ আলী।