কাজির বাজার ডেস্ক
এই শীতের মাঝেই খুব ছোট্ট একটা পরিস্থিতি কল্পনা করুন। ভাবুন, বেশ গরম পড়েছে। সূর্যের তাপে জ্বলে যাচ্ছে আপনার তালু। ঘেমে ভিজে গেছে শরীর এমনকি পোশাকটাও। সে সময়েই খুব ছোট একটি সমস্যায় পড়ে গেলেন। যেমন- রাস্তায় আঁটসাঁট যানজট, ফলে অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় মেজাজ ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে আপনার জন্য। এমনকি খুব মার্জিত ভদ্রলোকের পক্ষেও দুয়েকটা গালিগালাজ করে ফেলা অসম্ভব নয়।
ভাবছেন, শুধু আপনার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়? একদমই না। আশেপাশের তাপমাত্রা বেশি থাকলে মেজাজ সপ্তমে চড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখা যায় হরদম। একদম পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণাতেই দেখা গেছে, তাপমাত্রার পারদ চড়লে চড়ে যায় মেজাজ। এমনকি এই মেজাজ থেকে অনেক সময়ে অপরাধের জন্ম নেয়।
গরম যখন বেশি পড়ে, খুন, আক্রমণ, ধর্ষণ, নাশকতা, এমনকি জনবহুল এলাকায় গুলি চালিয়ে দেওয়ার মতো অপরাধের ঝুঁকি তখন বেড়ে যায়, দেখা গেছে বিভিন্ন গবেষণায়। ভাবছেন গরমে রেগে যাওয়া মানুষ শুধু অন্যেরই ক্ষতি করে? না। বরং বছরের তপ্ত দিনগুলোতে আত্মহত্যার ঝুঁকিও থাকে বেশি।
গরম থেকে যে শুধু একজন বা কয়েকজন মানুষের মাঝে সহিংসতা দেখা যায়, ব্যাপারটা তাও নয়। একদম পুরো দেশ বা পুরো জাতির মানুষের মাঝে প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, তৈরি করছে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধের মতো ভয়াল পরিস্থিতি, এমনটাও ঘটে চলেছে পৃথিবীতে।
প্রমাণ হয়েছে গবেষণায় : একই সাথে ক্যালিফোর্নিয়া এবং কেনিয়া- এই দুই জায়গায় একটি গবেষণা করা হয় ২০১৭-২৮ সালের দিকে। অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলতে দেওয়া হয়। কিছু অংশগ্রহণকারী ছিলেন স্বাভাবিক তাপমাত্রার একটি ঘরে। অন্যরা ছিলেন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ উত্তপ্ত একটি ঘরে।
প্রথমে দেখা গেলো, সহিংসতার কোনো সুযোগ নেই- এমন ভিডিও গেম খেলতে দিলে দুই ঘরের গেমারদের মাঝে আচরণগত কোনো পার্থক্য দেখা দেয় না। কিন্তু যুদ্ধভিত্তিক একটি ভিডিও গেম খেলতে দেওয়ার পর দেখা গেলো, উত্তপ্ত ঘরটির গেমাররা বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠছেন। এমনকি অযথাই অন্যান্য গেমারের ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন।
এখানে একটা ব্যাপার হলো, এমন আচরণ ক্যালিফোর্নিয়ার গেমারদের মাঝে দেখা যায়নি, শুধু কেনিয়ার গেমারদের মাঝে দেখা গেল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা আবিষ্কার করেন, কিছুদিন আগেই একটি নির্বাচন হয়ে গেছে ওই দেশে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যেসব গেমাররা অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাদের মাঝেই দেখা গেছে গরম থেকে আবিভর্‚ত সহিংস আচরণ।
এ বিষয়ে গবেষণাটির সহ-লেখক, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কেলের অধ্যাপক ড ইয়ান বলিংগার বলেন, “হয়তো সরাসরি গরমের কারণে মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে না, বরং গরমের কারণে মানুষের মাঝে ইতোমধ্যেই সুপ্ত সহিংসতা অনেকগুণে বেড়ে যায়।”
২০১১ সালের একটু পুরনো আরেক গবেষণা করা হয়েছিল বেসবল খেলোয়াড়দের ওপর। দেখা গেছে, পরিবেশ বেশি গরম থাকলে খেলোয়াড়দের মাঝে একে অন্যকে আঘাত করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
এর পাশাপাশি রাগবি খেলোয়াড়দের আচরণেও তাপমাত্রার প্রভাব দেখা গেছে। তাপমাত্রা বেশি থাকলে তাদের মাঝে ফাউল করার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়।
কিন্তু গরমের সাথে সহিংসতার সম্পর্ক কী? : গবেষণায় তো নিশ্চিত হওয়া গেল আসলেই গরম বাড়লে রাগ, সহিংসতা বাড়ে। কিন্তু রাগের সাথে গরমের সম্পর্ক কী? সভ্য মানুষ নিজের রাগ, ক্ষোভ, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিন্তু যখন গরম বেড়ে যায়, তখন আসলে আমাদের শরীর নিজেকে ঠান্ডা রাখতে গিয়ে আর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। এ থেকেই দেখা দেয় সমস্যা।
শুধু তাই নয়, গরমে ঘেমে গেলে শরীর থেকে অনেক খনিজ বের হয়ে যায়। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে খনিজ দরকার। আর তাই খনিজের ঘাটতি হলে মেজাজের লাগামটাও হয়ে পড়ে ঢিলে।
বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহকারী অধ্যাপক ড আম্রুতা নোরি-সার্মা ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখেন, গরমের দিনে মানসিক সমস্যা নিয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ভর্তি হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
তার মতে, বেশি গরম পড়লে মানুষের ঘুম হয় না ঠিকমত। এ কারণেও তাদের মেজাজ খারাপ থাকে, দরকারের সময়ে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কাজেকর্মে হয়ে ওঠে বেপরোয়া।
তবে গরম পড়ছে মানেই সবাই হিংস্র হয়ে উঠবে, ব্যাপারটা এমন নয় কিন্তু। গরমের কারণে কেউ রেগে লঙ্কাকাÐ ঘটাতে পারেন, আবার কেউ রেগে গেলেও নিজের মাঝে চেপে যেতে পারেন। তবে গরমে রাগ বাড়বে, এটা নিশ্চিত।
বিশ্বজুড়ে বাড়ছে গরম, চড়ছে মেজাজ : অ্যাসোসিয়েশন ফর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে এবং শহরে সাধারণত গরম বেশি পড়ে, ঠান্ডা অঞ্চলের তুলনায় সেসব অঞ্চলে অপরাধের প্রবণতা বেশি থাকে। গরম বাড়লে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অপরাধ।
২০১১ সালের একটি গবেষণায় বিভিন্ন বছরে এফবিআইয়ের অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছর বছর তাপমাত্রা বাড়লে সেই সাথে সহিংস অপরাধের পরিমাণও বাড়ে সমানতালে। এই গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বছরের গড় তাপমাত্রা মাত্র এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে সহিংস অপরাধ বাড়বে অন্তত ৬ শতাংশ।
শুধু তাই নয়, বরং পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্ট বৈরি আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন, এমন শিশু-কিশোররা পরবর্তীতে বদমেজাজি মানুষে পরিণত হন বলে দেখা গেছে, মূলত খরা, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, এবং দাবানলের পর যে খাদ্য সংকট তৈরি হয়, তার শিকার হয় শিশুরাই। শৈশব এবং কৈশোরে খাবারের অভাব থেকেই তাদের মাঝে এমন সহিংসতার প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে থাকে।
মৌরিতানিয়ায় ২০০৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে, দশ বছর পর তাদের মাঝে আচরণগত সমস্যা যেমন অসামাজিকতা এবং আগ্রাসী মনোভাব দেখা দেয়। সুপুষ্ট শিশুদের মাঝে এমনটা দেখা যায় না।
খাদ্য সংকটের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগো কমে যায়। পূর্ব আফ্রিকার পশুপালকদের ওপর ২০১২ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের মাঝে আয়ের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এর ফলে তাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে বিদ্বেষ এবং দ্ব›দ্ব।
গবেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে সিয়েরা লিওন, ফিলিস্তিন, এবং মানাগুয়ার মতো এলাকাগুলোতে। দিন দিন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং পরিবেশ বিপর্যয়য়ের ফলে এ ধরনের সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না।
যুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধের ওপরেও তাপমাত্রার ব্যপক প্রভাব দেখা যায়, যেমনটা সম্প্রতি দেখা গেছে সিরিয়ায়। বছর জুড়ে ভয়াবহ এক খরা দেশটির বিপুল পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল মানুষ দলে দলে চলে আসে রাজধানীর দিকে। এক পর্যায়ে তাদের সম্মিলিত অসন্তোষ থেকে দেশজুড়ে তৈরি হয়ে এক অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা, যাতে গৃহযুদ্ধের আগুন আরও ফুঁসে ওঠে।
একইভাবে উগান্ডা, সুদান, কেনিয়া, এবং ইথিওপিয়াতেও দেখা যায় পরিবেশগত কারণ থেকে উদ্ভুত দ্ব›দ্ব। তবে এ ধরনের ঘটনা শুধুই মধ্যপ্রাচ্যে অথবা আফ্রিকায় ঘটে ভাবলে ভুল করবেন। এশিয়া এবং আমেরিকাতেও এমন ঘটনার নজির রয়েছে।