কাজির বাজার ডেস্ক
বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে সংঘটিত অগ্নিকাÐের বিষয় তদন্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহŸায়ক করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসন ও শৃঙ্খলা শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইমরান হোসেন স্বাক্ষরিত গতকাল এক অফিস আদেশে এ কথা জানানো হয়।
কমিটির অপর সদস্যরা হলেন, জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রতিনিধি এবং কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়)। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, এই কমিটি, সংঘটিত অগ্নিকাÐের উৎস ও কারণ উদঘাটন; অগ্নি দুর্ঘটনার পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়-দায়িত্ব আছে কি না তা উদঘাটন এবং এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধকল্পে সুপারিশ প্রেরণ।
কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রদান করতে বলা হয়েছে। কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে বলেও অফিস আদেশে জানানো হয়েছে। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে লাগা আগুনে পুড়ে গেছে ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত ৪টি ফ্লোর। এর মধ্যে আছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভ‚ঁইয়ার দুটি মন্ত্রণালয়। বিষণœ মনে পুড়ে যাওয়া ভবন দেখে গেছেন তিনি। দুপুর সাড়ে ১২টায় পুড়ে যাওয়া ভবন পরিদর্শন করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। এসময় তার চোখে-মুখে বিষণœতার ছাপ দেখা যায়। ভবন পরিদর্শন শেষে দুপুর ১২টা ৪৩ মিনিটে নীরবে সচিবালয় ত্যাগ করেন তিনি। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া অফিস দেখে বিমর্ষ আসিফ মাহমুদ তখন ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে বলেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। এসময় ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত আসিফ মাহমুদকে সান্ত¡না দেন।
এর আগে সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে আসিফ মাহমুদ বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি।
তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
জানা গেছে, অগ্নিকাÐের ঘটনায় উত্তরবঙ্গ সফরের মাঝপথেই ঢাকায় ফেরেন আসিফ মাহমুদ।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তারা আগুন লাগার খবর পায় বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে। ২ মিনিটের ব্যবধানে রাত ১টা ৫৪ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট কাজ শুরু করে। পরে ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো হয়। সবশেষ ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রায় ১০ ঘণ্টা পর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তা পুরোপুরি নেভে।
আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য নিহত হয়েছেন। তার নাম মো. সোহানুর জামান নয়ন। আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। আগুন লাগার কারণও তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
৭নম্বর ভবনের চারটি তলা পুড়ে ছাই : দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অগ্নিকাÐে ৭ নম্বর ভবনটির ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে পুড়ে যাওয়া ভবনটিতে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে।
জানা গেছে, ছাই হয়ে যাওয়া ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল। এসব মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব নথি, কম্পিউটারসহ সবকিছু এখন ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে মধ্যরাতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাÐের শুরুতে রাত ১টা ৫৪ মিনিট থেকে সচিবালয়ে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে। তবে তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে ১৯টি ইউনিটের দীর্ঘ প্রায় ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা।
৭ নম্বর ভবনে যেসব মন্ত্রণালয় : প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ীÑ সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়সহ বিভাগের অফিস রয়েছে। সচিবালয়ে এক নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সামনেই পড়বে সাত নম্বর ভবন। নয়তলার এই ভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর। এছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অংশ রয়েছে।
এদিকে অগ্নিকাÐের সংবাদের পরপরই সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা সচিবালয়ের গেটের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। তারা সচিবালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করেছেন। আপাতত কাউকে সচিবালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
এছাড়া ভবনটির নিরাপত্তা ও ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধার কাজে সহায়তায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে আগুনের ঘটনায় দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তারা উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তা করবেন।
৮ তলায় মিলল পুড়ে যাওয়া কুকুরের দেহ : সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের ৮তলা থেকে একটি কুকুরে পুড়ে অংগার হয়ে যাওয়া দেহ খুঁজে পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। রাতের বেলা সচিবালয়ের মতো একটি জায়গায় ৮তলায় কীভাবে একটি কুকুর গেল, সেটি নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে ফায়ার ফাইটার মো. ইমরান শিকদার বলেন, কোনো ভবনে আগুন নির্বাপণ করার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুরো ভবন খুঁজে দেখা হয়। কারণ সেখানে আহত বা নিহত অবস্থায় কেউ থাকতে পারেন। সেই কাজ করার সময় আমরা কুকুরের পুড়ে যাওয়া দেহটি খুঁজে পাই। পুড়ে যাওয়া ৭ নম্বর ভবন সার্চ করা আরেক ফায়ার ফাইটার মো. তরুণ বলেন, সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ৮তলা পুরোপুরি পুড়ে গেছে। এখানে দেওয়ালের প্লাস্টার খসে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। কাগজ পত্র সব পুড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, শুধু ৮তলা নয় ভবনের ৬, ৭ ও ৯ তলাতেও কম বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এর আগে রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ ভবনে আগুন লাগার সংবাদ পায় ফায়ার সার্ভিস। এর মিনিট দুয়েক পরই সচিবালয়ে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটটি আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করে। আগুনের তীব্রতা বাড়লে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণ কাজে যোগ দেয়। পরে ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার ফাইটার নয়ন নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের : বাংলাদেশ সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে গিয়ে ট্রাকের চাপায় ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন নিহতের ঘটনায় সংস্থার পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে কর্মরত রুহুল আমিন মোল্লা বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে ট্রাক চালক মো. বেল্লাল হোসেন ওরফে সুমন (৩৬) ও তার সহকারী ফরহাদ হোসেন (২০)। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর। মামলার অভিযোগে বলা হয়, বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন বাদী রুহুল আমিন। আগুন ছড়িয়ে পড়লে তিনি ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাহায্য চান। এর প্রেক্ষিতে সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের স্পেশাল টিম আসে। এই টিমের টিম লিডার ছিলেন মো. হুমায়ুন কবির। তার নেতৃত্বে মিনিবাস গাড়ি ও স্পেশাল টিমের আট জন ফায়ার ফাইটারসহ সচিবালয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেন। অপারেশনাল কাজ চলার সময়ে ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন ডেলিভারি হোজ নিয়ে সচিবালয়ের মেইন গেটের সামনের রাস্তা পার হওয়ার সময় গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে কাওরান বাজারগামী একটি ট্রাক দ্রæত ও বেপরোয়া গতিতে ফায়ার ফাইটার নয়নকে চাপা দিলে তিনি মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতসহ রক্তাক্ত হন। তাৎক্ষণিক বাদীসহ সহকর্মীরা উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় নয়নকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় উপস্থিত ছাত্রজনতা ঘাতক ট্রাকের চালক বেলাল ও হেলপার ফরহাদকে ট্রাকসহ আটক করে ডিউটিরত থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরের ফায়ার ফাইটার নয়নের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।