চার প্রার্থীর একযোগে সংবাদ সম্মেলন সিলেট-২ আসনের নির্বাচন বাতিল না করলে আইনগত পদক্ষেপ

19

স্টাফ রিপোর্টার

সিলেট-২ আসনের নির্বাচনে জাল ভোট, আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি, প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীকে জিম্মি করা, এজেন্টদেরকে মারধর ও বের করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছেন চার প্রার্থী। তারা একযোগে সংবাদ সম্মেলন করে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরেন এবং এ আসনে নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায়, আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রার্থীরা।
সোমবার বেলা ২টায় সিলেট নগরের একটি হোটেলে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য দেন, বর্তমান সংসদ সদস্য গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খান, জাতীয় পার্টির প্রার্থী, সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহইয়া চৌধুরী, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আব্দুর রব মল্লিক ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী, বিশ^নাথ আওয়ামী লীগ নেতা ও পৌর মেয়র মুহিবুর রহমান।
আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় বিশ^াস করেছিলাম, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছিল নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, সরকারের ইন্টেলিজেন্সের বড় বড় কর্মকর্তারা বলেছেন- নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। সবকিছুর উপর আস্থা এনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু কী ঘটেছে তা আপনারা পর্যবেক্ষণ করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন লক্ষ্য করলাম- এটা প্রহসন ছাড়া সত্যিকারের কোনো নির্বাচন নয় তখন বেলা ১.৫০ মিনিটে আমরা চার প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।’
ভোটের দিন সকালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইয়াহইয়া চৌধুরীকে একটি কেন্দ্রে জিম্মি করে প্রায় একঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি কেন্দ্রে গিয়ে পেয়েছি স্বয়ং নৌকার প্রার্থী শফিক চৌধুরী দাঁড়িয়ে টেবিল কাস্ট করছেন। এ কেন্দ্রে আমি যাওয়ার আগে লাঙলের এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রতিকার পাইনি। বরং, নৌকার সমর্থক ও বহিরাগত লোকজন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী একই সুরে কথা বলেছে।’
এই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করার জন্য সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা স্থানীয় ইউএনওকে বললেও উপকার হয়নি। একইভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ তার কাছে রয়েছে বলে জানান তিনি।
মুহিবুর রহমান নির্বাচনের দুদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন- ‘বিশেষ কোনো প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ভোট শুরুর আগে আগেই সিল মারা হবে।’ সেই সূত্র উল্লেখ করে আজকের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি আগেই খবর পেয়েছি। যেসব গাড়ি নির্বাচনের ডিউটির জন্য ভাড়া করা হয়েছে সেসব গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে এমনটা জেনেছি। এখন তা সত্য প্রমাণিত হল।’
তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে চাই- আওয়ামী লীগের মঙ্গলের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে এই আসনে ভোট বাতিল করে পুনরায় ভোট দিন। প্রবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে সুষ্ঠু নির্বাচন দিন। বিএনপির কর্মীরা ভোট দিতে এসেছিল জানিয়ে মুহিবুর রহমান বলেন, ‘শফিক চৌধুরীর গোন্ডারা তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে রক্তাক্ত নির্বাচন চাই না বলেই আমরা চার জন একযোগে নির্বাচন বর্জন করেছি।’ নির্বাচনে সবমিলিয়ে ৭-৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে মনে করেন এই প্রার্থী।
নিজের ভোটও দিতে পারেননি উল্লেখ করে সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তাকে বলা হলে তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে লিখিত অভিযোগের পরামর্শ দেন। এ পর্যায়ে ভোটকেন্দ্রে কয়েকজন গিয়ে তাদের ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। তাদের ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে বলা হলে তিনি এদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ^াস দেন। কিন্তু, নৌকার এজেন্ট সমর্থকরা আমার সঙ্গে অসদাচরণ করেন। এসব বিষয়ে স্ট্রাইকিং ফোর্সের সহযোগিতা চেয়েও পাইনি।’
একইভাবে নির্বাচনীয় এলাকার সাদীপুর, তাজপুর, খাজাঞ্চি ইউনিয়নের অসংখ্য সেন্টার দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দুপুরে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ^াসে ভোটে এসেছি। উৎসাহ উদ্দীপনায় ভোট করার কথা বলা হয়েছিল। বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল বিশ^াস করতে পারেনি বলে নির্বাচনে আসেনি। আমরা বিশ^াস করেছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি যা হয়েছে আগামীতে আওয়ামী লীগের মানুষও ভোটে আসতে চাইবে না।’ সাবেক এই সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি হয় বাকশাল করেন। আমরা বাকশাল মেনে নেব। কিন্তু এমন প্রহসনের নির্বাচন আমরা চাই না। আমাদের যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে এত টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচন করার কোনো মানে নেই।’
এজেন্টরা বেরিয়ে এলেও স্বাক্ষর জাল করে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এই প্রার্থী। তিনি বলেন, ‘দুপুরে ভোট প্রত্যাখ্যান করেছি। ২টার মধ্যে সবাইকে বের করে নিয়েছি। এজেন্টদের স্বাক্ষর কোথায় পেল তারা। এজেন্টদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। আমরা তাদেরকে বের করে নিয়ে এসেছি। এসব স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।’
বর্তমান সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিশ্চিত করা হয়েছিল যে, সিলেট-২ আসনে অত্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। তাদের কথায় এবং কাজে মিল পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসন ও সরকারের উপর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা নেই। ভোট কেন্দ্রে মানুষই পাওয়া যায়নি। সর্বোচ্চ ৮-১০টি একেক বুথে ভোট পড়েছে।’
ডামি ভোটার লাইনে দাঁড় করিয়ে ভেতরে জাল ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওসমানী মডেল হাইস্কুলে গিয়ে কিছু চিহ্নিত লোক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও ভোটার দেখতে পাইনি। কেন্দ্রের ভেতরে ব্যালটবাক্স প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। আরেক কেন্দ্রে একদল লোককে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও তারা ভেতরে ভোট দিতে যাচ্ছেন না। জানতে চাইলে তারা বলেছেন- তাদেরকে এখানে দাঁড়া করা হয়েছে লাইনে লোক দেখাতে ছবি তোলার জন্য।’
‘সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন যখন একজন বিশেষ প্রার্থীকে জেতানোর জন্য একমত হয়ে কাজ করেন তখন এ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার কোনো মানে নেই।’ সিলেট-২ আসনে এমন প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে বলে মনে করি।’- এসব কথা বলে গণফোরামের এ প্রার্থী বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন।
তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আব্দুর রব মল্লিক বলেন, ‘আমরা চার জনই প্রবাসী। ক্লিন রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে নির্বাচনে এসেছি। প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সবাই প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন তাই বলেছিলেন।’
এই প্রার্থী বলেন, ‘নির্বাচনের দিনে ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর সাদীপুর থেকে ফোন পেলাম, খসরুপুর সেন্টারে ৭ জন এজেন্টকে সকাল থেকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। নানা অজুহাতে আমার সমর্থকদের সঙ্গে এমনটা করা হয়েছে।’
দায়িত্বরত এজেন্টদেরও বের করে দেওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘১০টার দিকে জানতে পারি বিভিন্ন সেন্টারে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। রহমতপুরে আমার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। তারপর আমার বাড়ির সেন্টার থেকে খবর আসে, পিস্তল ঠেকিয়ে বের করে দেওয়া হয়। এমনটা করে তারা নিজের ইচ্ছামত ব্যালটে সিল মেরেছে।’
এসব বিষয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের সহযোগিতা পাননি এই প্রার্থী।
৩৮টি সেন্টারে আগের রাতে ভোট কাস্টিং করে রাখা হয়েছে অভিযোগ করে মল্লিক বলেন, ‘স্বয়ং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সৎ কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পেরেছে। তবে, এই কর্মকর্তার নাম জানাতে চাই না। এখন আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব।’