নির্বাচনে সংঘাতে উদ্বিগ্ন আ.লীগ

22

কাজির বাজার ডেস্ক

বিএনপিবিহীন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক করতে দলীয় মনোনীতদের পাশাপাশি দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে নামিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে তৃণমূল পর্যায়ে বেড়েছে সহিংসতা। যারা মারছে, তারা যেমন আওয়ামী লীগ; যারা মার খাচ্ছে, তারাও আওয়ামী লীগ। মারামারিতে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩ কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে এমন সংঘাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নৌকা ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের কেউ হারতে চান না। কারণ, এর মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরের এলাকার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটা ঠিক হবে। তবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে আরও প্রাণহানি ও কোন্দল বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন ভোটাররা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, ‘নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। সমস্যাটা হলো, শুধু আমাদের নয়, প্রতিবেশী ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতেও নির্বাচনে সহিংসতা হয়। তবে এবার যেহেতু আমরা নিজেরা নিজেরা, তাই এসব হওয়া উচিত ছিল না। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
আওয়ামী লীগ এসব ঘটনায় চিন্তিত কি না, এমন প্রশ্নে শাজাহান খান বলেন, ‘সামনের দিনে সহিংসতা বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। এটা নির্ভর করছে আমাদের মানসিকতার ওপর। সবার উচিত দলীয় সভাপতি যে নির্দেশনা নেতা-কর্মীদের দিয়েছেন, তা অনুসরণ করা। তবে এ ধরনের ঘটনায় আমরা অবশ্যই চিন্তিত।’
দলের পক্ষ থেকে বারবার সহিংসতা পরিহারের কথা বলা হলেও মাঠের বাস্তবতা হলো, কেউ কাউকে মানছে না। আওয়ামী লীগ সহিংসতাকারীদের প্রশ্রয় দেবে নাÑ মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এমনটাই বলেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গায় নৌকা ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলার বেশির ভাগই হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর। প্রতীক বরাদ্দের পর সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুর-৩ আসনে। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের এ কে আজাদের সমর্থকদের ওপর নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা চারবার হামলা চালিয়েছেন।
এ পর্যন্ত ৩ জন নিহত : নির্বাচনী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছেন, যাঁদের সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। ৯ ডিসেম্বর পিরোজপুর আসনের নৌকার ও মৎস্যমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আবদুল আউয়ালের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় লালন ফকির নামের এক যুবক মারা যান। ১৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ সদর উপজেলার গুতাপাড়া গ্রামে দুপক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী রফিকুল ইসলাম নিহত হন। সর্বশেষ গত রোববার মাদারীপুরের কালকিনিতে প্রতিপক্ষের হামলায় মারা যান স্বতন্ত্র প্রার্থী তহমিনা বেগমের সমর্থক ও আওয়ামী লীগের কর্মী এসকেন্দার খাঁ।
অভিযোগ বাড়ছে স্বতন্ত্রদের : বর্তমান সংসদের ১৭ জন এমপি নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই এবার নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের তোপের মুখে পড়ছেন। গত রোববার নির্বাচন কমিশনে এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন বরিশাল-৪ আসনের ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি পঙ্কজ নাথ। তাঁর অভিযোগ, নেতা-কর্মীদের নৌকার প্রার্থী শাম্মী আহমেদের (প্রার্থিতা স্থগিত, আপিল শুনানি ২ জানুয়ারি) সমর্থকেরা হুমকি-ধমকি দিয়ে নির্বাচনী ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়েছেন।
নোয়াখালী-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শিহাব উদ্দিন শাহীন অভিযোগ করেছেন, প্রচারের শুরুতে কোনো ধরনের সমস্যা না হলেও ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, তত তাঁর সমর্থকদের নৌকার প্রার্থীর পক্ষ থেকে হুমকি-ধমকি বাড়ছে। একইভাবে শিহাবের নির্বাচনী সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান নাছেরের বাড়িতেও ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে।
নির্বাচন পর্যন্ত সহিংসতা চলতে থাকলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। নির্বাচনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে রাখার মাশুল আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ মেয়াদে দিতে হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। একজন বলেন, দলের মধ্যে ফাটল ধরে গেল, ভাগাভাগি হয়ে গেল। দলটি সেটা কীভাবে সামাল দেবে, তা দেখার বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচনে সব সময় কম-বেশি সহিংসতা ছিল। এটা ১৯৭৩ সাল থেকে দেখে আসছি। এখানে যার জোর বেশি, সে অন্যদের ওপর দাপট দেখায়। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ তার দলের লোকদের কাছে নির্বাচন ওপেন করে দিয়েছে, তাই যে যেভাবে পারে, পিটিয়ে-ফাটিয়ে নির্বাচিত হতে চায়। এ রকম চলতেই থাকবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা সহিংসতায় বিশ্বাস করি না। সহিংসতা নির্বাচনী আচরণবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিষয়গুলো আমরা কখনো সমর্থন করি না, করার প্রয়োজনও নেই। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে। এখানে প্রতিযোগিতা থাকবে, প্রতিদ্ব›িদ্বতাও থাকবে। জনগণ যাকে ভালো মনে করবে, তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।’