পাঁচ দিনে ৩৩ নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত ৩ আহত ১৫০

13

কাজির বাজার ডেস্ক

বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে মাঠে নামিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা করেছিলেন বিশ্লেষকেরা। এখন সেই আশঙ্কাই সত্য হতে চলেছে। নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর প্রতিদিনই প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলায় এরই মধ্যে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন অন্তত দেড় শ’।
নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ হয় ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন থেকে শুরু হয় প্রচার কার্যক্রম। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মারামারিও। আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যমতে, প্রতীক বরাদ্দের পর গত শনিবার পর্যন্ত মোট সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩৩টি। এসব হামলার বেশির ভাগই হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর। তাঁদের ওপর নৌকা প্রার্থীর সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছেন ৩১টি। র্বাচনের মাঠে সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম। এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী বা দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ের প্রশ্নে কেউ কাউকে ছাড় দেবে নাÑএটা জানা কথা। বর্তমানে নির্বাচনের মাঠে এই চিত্রই ফুটে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যাঁর যতটুকু সামর্থ্য আছে, সব নিয়ে মাঠে নেমে গেছেন। তাঁরা নিজেরাই সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন, প্রাণ ঝরছেন। নির্বাচনকে ঘিরে সামনের দিনগুলোতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। এতে নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগই ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে ইসি ব্যর্থ হয়েছে। তারা বড় বড় কথা বলছে, কিন্তু কার্যকর ভ‚মিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
সংঘর্ষে প্রাণহানির সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার। এ দিন মাদারীপুরের কালকিনিতে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক কর্মী। তাঁর নাম এসকেন্দার খাঁ। ৭০ বছরের এই বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
এসকেন্দার ল²ীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোসা. তাহমিনা বেগমের কর্মী। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে তাহমিনা বেগম বলেন, ‘আমাকে প্রতিহত করার জন্য এবং অন্য কর্মীদের বিরত রাখার জন্য এ হত্যাকাÐের ঘটানো হয়েছে। আমি এখন আতঙ্কিত।’ যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌকার প্রার্থী আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ।
কুপিয়ে হত্যার এ ঘটনা ছাড়াও আরও সাত সংসদীয় আসনে সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। এতে আহত হয়েছেন ১৮ জন। প্রতীক বরাদ্দের পর সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুর-৩ আসনে। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের এ কে আজাদের সমর্থকদের ওপর নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা তিনবার হামলা চালিয়েছেন। এতে মোট আহত হন ১৩ জন। এ ছাড়া গাজীপুর-২ ও কুষ্টিয়া-৪ আসনে দুটি করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা হয়েছে। গাজীপুর-২ আসনে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও শরীয়তপুর-২ আসনের পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের সমর্থকেরা এ হামলা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে হামলার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। উপজেলার জামপুর বেলাব এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় বাংলাদেশ জনদলের মহাসচিব সেলিম আহমেদের ওপর হামলা হামলা হয়েছে। শুক্রবার রাতে ফতুল্লার কাঠেরপুল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, নৌকার প্রার্থীর সমর্থকেরা এ হামলা করেছেন।
চট্টগ্রাম-১৪ আসনের চন্দনাইশ সাতবাড়িয়া এলাকায় শুক্রবার নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল জব্বার চৌধুরীর এক সমর্থক আহত হয়েছেন। এ দিন রাতে একই এলাকার নৌকার নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় পাহারাদারকে মারধর করা হয়।
কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে দিন দিন পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। গত শুক্রবার রাতে কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের জয় বাংলা বাজার এলাকায় নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক প্রতীকের আব্দুর রউফের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন। এর আগে বুধবার রউফের সমর্থকের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে নৌকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। শনিবার রাতে খোকসার এখতারপুর বাজারে তাঁর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করেন নৌকার সমর্থকেরা। রাজশাহী-৬ আসনের বাঘায় নৌকার সমর্থক আজিজুল ইসলামের বাড়িতে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এ ছাড়া নওগাঁ-৪ আসনের নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম ব্রহানী সুলতান মামুদ গামার (ট্রাক প্রতীক) নির্বাচনী অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মান্দা উপজেলার মৈনম বাজারে এ ঘটনা ঘটে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর তিন কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন।
নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনসের কর্মকর্তা সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, আমাদের পুলিশ সব সময় সতর্ক রয়েছে, যেকোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেউ আইনশৃঙ্খলার অবনতি করলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রæত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।