এমপি হতে পদ ছাড়লেন রেকর্ড সংখ্যক জনপ্রতিনিধি

14

কাজির বাজার ডেস্ক

সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থিতা জমা দিয়েছেন তিনি। বেলকুচি-চৌহালী-কামারখন্দের আংশিক নিয়ে গঠিত এ আসনের বর্তমান এমপি শিল্পপতি আবদুল মমিন মÐল এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন।
দলীয় একজন শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে লতিফ বিশ্বাস বলেন, ‘জেলে থেকে দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছি। আওয়ামী লীগ থেকে দুইবার বেলকুচি উপজেলার চেয়ারম্যান হয়েছি। দুইবার এমপি হয়েছি। পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছি। সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। এলাকার জনগণ এমপি হিসেবে আমাকেই দেখতে চায়। তার পরও আরেকজন অজনপ্রিয় লোক কেমন করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেল, সেটা জানি না। আমি নির্বাচনে আছি। আমি জিতব। জয়ের ব্যাপারে শতভাগ বিশ্বাস আমার আছে।’
তাঁর মতোই জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার মেয়ররা। ভবিষ্যৎ লাভের আশায় হিসাব কষেই ঝুঁকি নিয়েছেন তারা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চেয়ারম্যান-মেয়র হওয়া ৬১ জন জনপ্রতিনিধি পদত্যাগ করে এবার প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান ৫২ জন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চার জন, সদস্য একজন এবং পৌরসভার মেয়র চারজন। তাদের কয়েকজন দলীয় মনোনয়ন পেলেও বেশির ভাগই মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে তারা বলছেন, এবার দল থেকে কোনো বাধা নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তা জানিয়ে দিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভ‚ঁইয়া। এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে শাহজাহান ভ‚ঁইয়া বলেন, ‘এ আসনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দস্তগীর সাহেবের জামানত থাকবে না। আমিই তাঁকে এনে ২০০৮ সালে এমপি বানিয়েছিলাম। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন- এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা সে করেনি। বড়লোকের এত লোভ থাকে জানা ছিল না। আমি যদি জিততে না পারি তাহলে রাজনীতিই ছেড়ে দেব।’
দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়রের পদ ছেড়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন মোহাম্মদ ফয়সাল। মুন্সীগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে লড়ছেন তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের ছেলে ফয়সাল। এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণালকান্তি দাস। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, দলীয় নেতাকর্মী ও জনগণের চাপের মুখে তিনি নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছেন এবং তিনি জয়ী হবেন। এতে কোনো ভুল নেই।
অতীতে এত বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধির পদত্যাগ করে এমপি পদে নির্বাচন করার নজির নেই। তাদের পদত্যাগের ফলে কারা ওই পদে দায়িত্ব পালন করবেন, সে প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি বলেন, জেলা ও উপজেলা পরিষদে একজন প্যানেল চেয়ারম্যান আছেন। আবার পৌরসভায় একজন প্যানেল মেয়র আছেন। পদত্যাগের কারণে এসব প্যানেল চেয়ারম্যান ও প্যানেল মেয়র আপাতত দায়িত্ব পালন করবেন। সময় মতো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠানো হবে। নির্বাচন কমিশন ১৮০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনের মাধ্যমে ওই পদগুলো পূরণ করবে। তবে তা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে। এমপি নির্বাচনে হেরে গেলে পদত্যাগকারীরা আবারও ওই উপনির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
এত বিপুল সংখ্যক জনপ্রতিনিধির পদত্যাগের কারণে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম বা নাগরিক সেবাদানে ব্যাঘাত ঘটবে কিনা- জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিধান আছে। কাজেই এ নিয়ে বলার কিছু নেই। সবাই এমপি হতে চান। কিন্তু এবার একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় প্রার্থীও মনোনয়ন দিচ্ছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদেরও মনোনয়ন দিচ্ছে। এই সংস্কৃতিটা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভালো লক্ষণ নয়।
উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে প্রার্থী : টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ইউনুস মোহাম্মদ তালুকদার, মির্জাপুরের মীর এনায়েত হোসেন মন্টু, ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাদ্দেছ হোসেন, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের নাসিরুল ইসলাম খান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শাহজাহান ভ‚ঁইয়া, রাজবাড়ীর ইমদাদুল হক বিশ্বাস, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের মুশফিকুর রহমান খান, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের মহিউদ্দিন আহমেদ, নরসিংদীর মনোহরদীর সাইফুল ইসলাম খান বীরু, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের কাবির মিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার শফিকুল ইসলাম, বেলকুচির নুরুল ইসলাম সাজেদুল, বগুড়ার শেরপুরের মজিবর রহমান মজনু, আদমদীঘির সিরাজুল ইসলাম খান রাজ, পাবনার চাটমোহারের আব্দুল হামিদ, নাটোরের সিংড়ার শফিকুল ইসলাম, নেত্রকোনার দুর্গাপুরের জান্নাতুল ফেরদৌস, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আবদুল হাই আকন্দ, শেরপুরের শ্রীবরদীর শহিদুল ইসলাম, ঝিনাইগাতির আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের মাহমুদুল হক সায়েম, ঈশ্বরগঞ্জের মাহমুদুল হাসান সুমন, ফুলবাড়িয়ার আব্দুল মালেক সরকার, সুনামগঞ্জের শাল্লার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সফি আহমেদ সালমান, চট্টগ্রামের সীতাকুÐের এম এম আল মামুন, সাতকানিয়ার আব্দুল মোতালেব, পটিয়ার মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, বাঁশখালীর চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব সাদলী, ফটিকছড়ির আবু তৈয়ব, চন্দনাইশের আব্দুল জব্বার চৌধুরী, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের জাহিদুল ইসলাম, হাজীগঞ্জের গাজী মাঈনুদ্দিন, কুমিল্লার দেবিদ্বারের আবুল কালাম আজাদ, চৌদ্দগ্রামের আব্দুস সোবহান ভ‚ঁইয়া, ব্রাহ্মণপাড়ার এম এ জাহের, কক্সবাজারের মহেশখালীর শরীফ বাদশা, রামুর সোহেল সারওয়ার কাজল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফিরোজুর রহমান, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর খন্দকার আল আমিন, মেহেরপুরের ইয়ারুল ইসলাম, সাতক্ষীরা সদরের আসাদুজ্জামান বাবু, শ্যামনগরের এস এম আতাউল হক, কুষ্টিয়ার মিরপুরের কামরুল আরেফিন, খুলনার ফুলতলার শেখ আকরাম হোসেন, রংপুরের মিঠাপুকুরের জাকির হোসেন সরকার, নীলফামারীর সৈয়দপুরের মোখলেছুর মোমিন, গাইবান্ধা সদরের শাহ সারোয়ার কবীর, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর আলী আসলাম, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের তারিকুল ইসলাম তারিক ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের মোহাম্মদ শামসুল আলম।
জেলা পরিষদের পাঁচজন : কুড়িগ্রামের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলী, লালমানিরহাটের মতিয়ার রহমান, হবিগঞ্জের মুশফিক হুসেন চৌধুরী, সিরাগঞ্জের আব্দুল লতিফ বিশ্বাস এবং যশোর জেলা পরিষদের সদস্য আজিজুল ইসলাম। এর মধ্যে আজিজুল ইসলাম ও লতিফ বিশ্বাস ছাড়া অন্যরা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি পদে লড়ছেন।
পৌর মেয়র চারজন : রাজশাহীর তাহেরপুর পৌসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ, মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মোহাম্মদ ফয়সাল, ময়মনসিংহের ত্রিশালের এ বি এম আনিছুজ্জামান ও বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক।