বিজয়ের মাস মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে

19

 

শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এ মাস আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালে এই মাসের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চ‚ড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা। বিজয়ের অনুভ‚তি সব সময়ই আনন্দের, তাই এ মাসটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দময়। তবে একই সঙ্গে অত্যন্ত বেদনারও- বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের জন্য। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের এ স্বাধীনতা, এ বিজয়। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের, যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদেরও। এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের আপামর জনতাকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন একই লক্ষ্যে অবিচল একদল রাজনৈতিক নেতা। তাদের সবাইকেই আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আজ সে স্বপ্ন কতটা পূরণ হয়েছে, তা ভাবনার অবকাশ রাখে। কেননা, এ সময়ের মধ্যে আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই মোকাবিলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায়। জনবহুল ও সীমিত সম্পদের এ দেশকে স্বয়ম্ভর করে তোলার কাজও সহজ ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন দিনগুলোয় রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র চালু করতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল গণতান্ত্রিক ও মুক্ত পরিবেশে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার। সদ্য স্বাধীন দেশের নেতৃত্বের এ বিষয়ে অঙ্গীকারের অভাব ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তী সময়ে এ ক্ষেত্রে মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে, সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, পরে যার খেসারত দিতে হয় গোটা জাতিকে। দেশ প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় চলতে শুরু করে। পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে। যা আমাদের জন্য ছিল অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
দেরিতে হলেও, দেশ আবার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসেছে, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সুযোগ এসেছে আজ বাংলাদেশকে পরিপূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার। একাত্তরের চেতনায় দৃঢ় প্রত্যয়ে জেগে ওঠার। এটা সত্য, নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত আছে। তদুপরি বিভিন্ন সংকটও বিদ্যমান। দেশে দারিদ্র্য আছে। দুর্নীতি রোধ হয়নি। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। উচ্চমূল্যের কবলে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। সামনে নির্বাচন, রাজনৈতিক অঙ্গনেও আছে গভীর বিভক্তি। এর পাশাপাশি জাতীয় প্রশ্নে অনৈক্য এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে। এ বিষয়গুলোকে আমলে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষায় হতে হবে যতœবান ও মনোযোগী।
ভুলে যাওয়া যাবে না, যে কোনো জাতির শক্তির প্রধান উৎস ঐক্য। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্যও তা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল মত-পথ-জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ। যে কারণে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মাত্র নয় মাসে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর আমরা সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি। রাজনৈতিক বিভক্তি দেশে গণতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করার পথে বড় অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের নেতৃত্বকে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির ধারায় আরও এগিয়ে নিতে হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যা মোকাবিলায় সচেষ্ট হলে দেশ ক্রমাগত এগিয়ে যাবে।