শিশুশ্রম বন্ধে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে

21

 

শিশুশ্রম দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এটি বাংলাদেশের একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে অপ্রাপ্ত বয়সে কায়িকশ্রম অর্থাৎ অপরিণত অবস্থায় অর্থের বিনিময়ে কাজ করা শিশুশ্রমের আওতাধীন। দৈনন্দিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আমাদের আশপাশে প্রায়ই শিশুশ্রমের যে উদাহরণের আমরা সাক্ষী হচ্ছি তা কল্পনাতীত এবং নির্যাতনের বিষয়টাও আমাদের দৃষ্টির বাহিরে নয়। শিশুশ্রম যেমন সমাজের জন্য ক্ষতিকর ঠিক তা আমাদের দেশের জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই এটিকে দ্রæত নিরসন করতে হবে।
শিশুশ্রম নিরসন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমরা অনেকেই অবহেলার চোখে দেখি এবং অনেকে তা আবার কর্ণপাত পর্যন্ত করি না। শিশুর অপ্রাপ্ত বয়সে কায়িকশ্রমের ফলে যেমন তার শারীরিক উন্নতি সাধনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঠিক তেমনি মানসিকভাবেও বিকারগ্রস্ত হয়। একটি শিশুর মননশীল ও বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক যে বয়স সেই বয়সটাতে বিদ্যালয়মুখী না হয়ে বরং শ্রমমুখী হয় এবং এতে তারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুশ্রমের ফলে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে অতি স্বল্প বয়সেই অর্থ উপার্জনে ধাবিত হয়। তাই এটি নিরসন করতে হবে কারণ আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ও কর্ণধার। ভবিষ্যৎ এই কর্ণধারকে সুদৃষ্টিতে রাখতে হবে এবং তবেই আমরা উন্নয়নের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছাতে পারব। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, অন্তর্ভুক্ত আইন ও কনভেনশন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইন তৈরি করা হয়েছে যার মাধ্যমে শিশুর অধিকার সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত থাকে। বাংলাদেশের অনেক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, এসবের নিয়মিত মূল্যায়ন, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ এবং সেই সঙ্গে শিশুশ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা উচিত। শিশুদের সমতা ও বৈষম্যহীন পরিবেশে যোগ্য নাগরিকরূপে গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হবে।
শিশুশ্রমের অনেকগুলো কারণের মধ্যে ব্যক্তি সচেতনতার অভাব কিছুটা দায়ীবদ্ধ। এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য হলো কেউ পিছনে থাকবে না। এই লক্ষ্য অর্জনার্থে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। শিশুশ্রম একধরনের শোষণ ও নিপীড়ন। বাংলাদেশে শিশুশ্রম ধীরে ধীরে কমছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজে শিশুশ্রম না থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়মিত এই হার সর্বদা ক্রমহ্রাসমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুর মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব বিবেচনা করে শিশুশ্রম নিরসন অতীব জরুরি। শিশুশ্রম নিরসন কল্পে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে হবে। শিশুশ্রমের ফলে একটি শিশু শিক্ষার সুযোগ সুবিধা চিরতরে হারিয়ে ফেলে। ফলে সে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। শিশুশ্রম উন্নয়নের অন্তরায়। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাই শিশুশ্রমের প্রধান কারণ। পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েকে শিশুশ্রমে যুক্ত করতে বাধ্য করে। শিশু পারিবারিক অভাব ও অনটনের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয় বিভিন্ন প্রকার কলকারখানা, গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি, ইটভাটা, হোটেলসহ আরও অনেক শ্রমসাধ্য কাজে। কম মজুরিতে অধিক সুযোগ-সুবিধার জন্যই শিশুকে নির্বিঘেœ বেছে নেয় কলকারখানার মালিকরা যা ঘোর অপরাধ। অনেক মালিক আছেন যারা কম টাকায় অনেক বেশি মুনাফা করতে চান এবং বেশি বেতন দেওয়ার ভয়ে বড়দের না নিয়ে শিশুদের এগুলো কাজে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সে কোনো শিশু কাজ করতে পারবে না। যদি কাজ করে তাহলে সেটা হবে শিশুশ্রম। এক বিশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যেসব পরিবারে অভিভাবক শিক্ষিত নয় অর্থাৎ নিরক্ষর এবং দরিদ্রদের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের ছেলেমেয়েরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের সম্মুখীন হয়। পোশাক শিল্প ছাড়াও শিশুরা অনেক চামড়া, ট্যানারি, জুতা, যানবাহন, ভিক্ষাবৃত্তিসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কাজে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক শিশুকে মাদক ও নানা অসামাজিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে তারা তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনসহ সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা সুরক্ষা ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমাজসেবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমাদেরও সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ এবং আমাদের সবার উচিত শিশুদের সুরক্ষিত রাখা।