এসএসসি-এইচএসসিতে থাকছে না জিপিএ-নম্বর

45

কাজির বাজার ডেস্ক

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হাবিবা। পছন্দ করে ছবি আঁকতে। যে কাউকে সামনে বসিয়ে মুহ‚র্তেই তার প্রতিচ্ছবি পেন্সিলের কারুকাজে কাগজে ফুটিয়ে তোলে সে। কিন্তু গণিতে বড্ড কাঁচা। প্রচলিত শিক্ষায় পাস নম্বর বলতে যা বোঝায়, তাও টেনেটুনে তুলতে হাঁফিয়ে ওঠে। হাবিবার আগ্রহ চিত্রশিল্পী হওয়া। এসএসসি-এইচএসসির গÐি পেরিয়ে আঁকাআঁকি সম্পর্কিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চায় সে। বাবা-মায়েরও রয়েছে সম্মতি। তার ইচ্ছাপূরণে যেন বড় বাধা প্রচলিত শিক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি। হাবিবার মা বলেন, ‘ও আঁকতে চায়, সুন্দর আঁকেও। চারুকলায় পড়ার স্বপ্ন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে তো এসএসসি-এইচএসসি পাস করতে হবে। অন্য দু-একটা সাবজেক্টে যে কাঁচা, তাতে পাস করবে কি না, তা নিয়ে যত চিন্তা।’ মায়ের এমন চিন্তার পাশাপাশি হাবিবা শিক্ষকদের থেকেও জেনেছে- বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার কোনো বিভাগে ভর্তি হতে হলে তাকে এসএসসি-এইচএসসিতে আগে ভালো ফল করতে হবে, যা নিয়ে মন খারাপ শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এ ছাত্রীর। হাবিবার মতো প্রায় সব শিক্ষার্থী কোনো না কোনো বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। পাবলিক পরীক্ষায় খারাপ ফল করার কারণে এমন অনেক শিক্ষার্থীর মেধা ও দক্ষতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে না। ঝরে পড়ে অনেক মেধাবীরাও। এতদিন ধরে চলা শিক্ষাক্রমে যা ‘অতি বড় সংকট’ বলে বিবেচিত। প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমে এমন সংকট থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনার চেষ্টা করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এ লক্ষ্যে এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন বাদ দেওয়া হচ্ছে। থাকছে না দুই যুগ ধরে প্রচলিত জিপিএ পদ্ধতিও। সমাপ্তি ঘটছে জিপিএ-৫ কিংবা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ার যুদ্ধেরও। এখন থেকে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নে ব্যবহার হবে পারফরম্যান্স ‘ইনডিকেটর’, অর্থাৎ বিশেষ পারদর্শিতার ‘চিহ্ন’। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দিয়ে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন শুরু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, ফল হিসেবে যে ইনডিকেটর বা চিহ্ন দেওয়া হবে, তা থেকে বোঝা যাবে- কোন শিক্ষার্থী কোন বিষয় বা কাজে বেশি দক্ষ। ‘ভালো’, ‘মধ্যম’ বা ‘খারাপ’ ফল বলে কোনো কথা বা বার্তাও সেখানে থাকবে না। কোনো শিক্ষার্থী খেলাধুলায় পারদর্শী হতে পারে, কেউ হতে পারে ছবি আঁকায়। কারও কথা বলার দক্ষতা বেশি থাকতে পারে। তাদের এসব দক্ষতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ পছন্দ করে পড়তে উৎসাহ দেওয়া হবে। এতে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে দক্ষ ও আগ্রহী, সে বিষয়ে পড়বে এবং কর্মজীবনে সেই ক্ষেত্রেই কাজ করবে। চাকরির বাজারে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ কর্মী বাড়লে, কমবে বেকারত্বও।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘জিপিএ পদ্ধতি যে থাকছে না, এটা আমরা চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হবে, সেটা নিয়ে আমাদের শিক্ষাক্রম প্রণেতারা কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভালো একটা মডেল দাঁড় করাবে বলে আশা করছি। ২০২৫ সালের আগেই আমরা এটাকে কাঠামোভিত্তিক মডেলে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’
জিপিএ পদ্ধতিতে নম্বরের ওপর ভিত্তি করে গ্রেডে বিভক্ত করে ফল প্রকাশ করা হয়। যেমন- কেউ বাংলায় ৭০-৭৯ পেলে সেটাকে ‘এ গ্রেড’ এবং ৪.০০ পয়েন্ট ধরা হয়। গণিতে ৮০ বা তার বেশি পেলে ‘এ প্লাস’ গ্রেড এবং ৫.০০ পয়েন্ট ধরা হয়। প্রাপ্ত গ্রেড পয়েন্টকে কোর্সের ক্রেডিট দিয়ে গুণ করে বের করা হয় তার যোগফল। এবার সব বিষয়ের ক্রেডিট যোগ করে ওই যোগফল দিয়ে গ্রেড পয়েন্ট বের করা হয়। সেখানে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত জিপিএ কত, তা উঠে আসে।
কেউ গোল্ডেন জিপিএ-৫ (সব বিষয়ে ৮০ নম্বরের ওপরে) পেলে তাকে সবচেয়ে মেধাবী বলে বিবেচনা করা হয়। আবার কেউ জিপিএ-৪ বা ৩.৫ পেলে তাকে ততটা মেধাবী নয় বা ফল ভালো হয়নি বলে বিবেচনার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এটিকে ‘নন-সেন্স’ ও ‘ইডিয়টিং’, অর্থাৎ ‘কাÐজ্ঞানহীন’ ও ‘নির্বুদ্ধিতা’ বলে মনে করেন নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘দেশে ২০ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিলো। তারা সবাই কিশোর-তরুণ। কাঁচা মন। অথচ তাদের মধ্যে এক লাখ শিক্ষার্থীকে আমরা বলে দিলাম- তুমি জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছ, তুমিই সেরা। তুমিই প্রকৃত মেধাবী। সংবর্ধনা-পুরস্কার কত কী! বাকি ১৯ লাখ বাচ্চাকে বুঝেয়েছি- তুমি খারাপ। তোমাকে দিয়ে পরিবার, দেশের কোনো কাজ হবে না। গ্রেডিং সিস্টেমে এভাবে আমরা নন-সেন্স, ইডিয়টিং কতগুলো কাজ করেছি। এটার কোনো অর্থ হয় না। আমরা ঠিক এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।’
ড. মশিউজ্জামানের বক্তব্যের সঙ্গে ‘তীব্রভাবে দ্বিমত’ জানিয়েছেন ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গ্রেডিং সিস্টেম এখনো বিশ্বের বহু উন্নত দেশে রয়েছে। তারা মূল্যায়ন করছেন, তারা তো এটাকে নন-সেন্সিং মনে করছেন না। এটাকে সংস্কার বা উন্নয়ন করা যায়। এভাবে তুলে দেওয়াটা যায় না, উচিতও নয়। উনি (অধ্যাপক মশিউজ্জামান) গ্রেডিংয়ে মূল্যায়ন নিয়ে যে কথা বলছেন, সেটাই কাÐজ্ঞানহীন কথা।’
যেমন হবে চিহ্নভিত্তিক ফল
চলতি বছর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। গত জুলাইয়ে ষান্মাষিক একটি মূল্যায়নও হয়েছে তাদের। তাদের যে রিপোর্ট দেওয়া হয়, সেখানে বিষয়গুলোর পাশে পিরামিড বা ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেখা যায়। অভিভাবকরা তো বটেই অনেক শিক্ষকও এ পারফরম্যান্স ইনডিকেটরগুলোকে সঠিকভাবে ব্যাখা করতে পারেননি। ফলে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিও তুলেছেন তারা।
চিহ্নভিত্তিক ফলের প্রকৃত অর্থ কী, তা নিয়ে শিক্ষাক্রম প্রণেতা তিনজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। প্রত্যেকে জানান, চিহ্নগুলো দিয়ে ‘ভালো বা মন্দ’ অর্থ করা হয়নি। অথচ অভিভাবক ও শিক্ষকরা এটিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেক ধরনের গুজবও ছড়িয়েছেন। বিশেষজ্ঞ একজন শিক্ষাক্রম প্রণেতা উদাহরণ দিয়ে চিহ্নভিত্তিক ফল বোঝানোরও চেষ্টা করেন। তার মতে, ৮ বছর বয়সী একজন শিশু সাইকেল চালানো শিখতে চায়। তার বড় ভাই সাইকেলের পেছনে ধরে তাকে চালানো শেখাবে। এরপর তাকে একা চালাতে হবে। এটা একটা সাধারণ ধারণা। বেড়ে ওঠার পরতে পরতে এমন ধারণা শিশুর মনে গড়ে ওঠে। এমন সাধারণ ধারণা যার মধ্যে রয়েছে সেটাকে বলা হচ্ছে ‘চতুর্ভুজ’।
সাইকেল চালানো শিখে যখন সে বাড়ির গলি বা আশপাশের রাস্তায় যাতায়াত শুরু করছে, তখনও সে পুরোপুরি দক্ষ হয়ে ওঠেনি। তার প্রচেষ্টা রয়েছে, সে আগ্রহী- এমন অবস্থাকে ‘বৃত্ত’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে।
যখন ওই শিশু সাইকেল চালানোটা রপ্ত করে ফেলেছে, সে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে। বেশ সাবলিল। সাইকেলের ওপর তার বেশ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্রমে তা বাড়ছে এটাকে ‘পিরামিড’ বা ‘ত্রিভুজ’ চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে সে উত্তরোত্তর উন্নতি করবে এবং সর্বোচ্চ শিখরে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকবে।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘চিহ্নগুলো শুধু যে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার মাত্রা নির্ণয় বা নির্ধারণ করবে তাও ঠিক নয়। বরং শিক্ষার্থীর আগ্রহ-দক্ষতা কোনদিকে তাও বোঝানো হবে। এটা আরও মডিফাই করা হবে।’
নম্বর বলে কোনো শব্দ থাকবে না উল্লেখ করে ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিশু-কিশোর-তরুণদের আমরা মূল্যায়ন করবো, পরীক্ষার মুখে ফেলবো না। পরীক্ষা নিয়ে দেওয়া হয় নম্বর। আর মূল্যায়নে জানানো হবে পারফরম্যান্স, তার অ্যাক্টিভিটি, তার আগ্রহ। প্রত্যেক বিষয়ের পাশে পারফরম্যান্স ইনডিকেটর (পারদর্শিতা চিহ্ন) থাকবে, তার বিপরীতে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থান কোথায়, সেটা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হবে। এখন যেমন লেখা হয়- বাংলায় ৭০ নম্বর বা এ গ্রেড, ইংরেজিতে ৮০ নম্বর বা এ প্লাস গ্রেড, এসবের কিছুই থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আমরা ষান্মাষিক মূল্যায়ন করেছি। এখানে তিনটি ইনডিকেটর বা চিহ্ন ছিল। ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চর্তুভুজ। এটা দিয়ে আমরা খুব ভালো, মধ্যম ও খারাপ বোঝাইনি। এগুলো অনেকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে ছড়িয়েছে। সিম্বলগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার মাত্রা নয় বরং কোনদিকে কার পারফরম্যান্স কেমন, তা বোঝানো হয়েছে। আমরা ভাবছি- আগামী বছর এ চিহ্নগুলো উলট-পালট করে দেওয়া হবে।’
তবে এ মডেল নিয়েও এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এটি আরও স্পষ্ট করে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অপব্যাখ্যা ও গুজব ছড়ানো রোধেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন শিক্ষাক্রম প্রণেতা ও শিক্ষাবিদরা।