আঠারো পেরোনো প্রায় শতভাগ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে

8

সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ এবং আঘাত ও দুর্ঘটনাকে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বছরে সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যান বটে, তবে ৪৫০টির বেশি রোগ ও আঘাতজনিত কারণে ভুক্তভোগী হয়ে অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। কোন কোন রোগে কী অবস্থায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের নেতৃত্বে নেয়া এক সমীক্ষায় এ তথ্য জানা যায়। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়েছেÑ বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রায় ১ শতাংশের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। বলা যায়, এরা রোগমুক্ত। বাকি প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ রয়েছেন কোনো না কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। গত রবিবার রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
দেশে কোনো রোগে কত মৃত্যু: সমীক্ষাটিতে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের প্রথমটি সংক্রামক। সংক্রামক রোগগুলোর মোট ৬২টি আছে বাংলাদেশের ব্যাধির তালিকায়। ৬২টি ব্যাধিকে ৭টি বর্গে ভাগ করা হয়েছে- এইচআইভি এইডস ও যক্ষা; ডায়রিয়া, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও অন্যান্য সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি; অবহেলিত গ্রীষ্মমÐলীয় রোগ ও ম্যালেরিয়া; মাতৃরোগ; নবজাতকের রোগ; অপুষ্টিজনিত রোগ এবং অন্যান্য সংক্রামক; মাতৃ, নবজাতক ও অপুষ্টিজনিত রোগ। অবহেলিত গ্রীষ্মমÐলীয় রোগ ও ম্যালেরিয়ার বর্গে ইয়োলো ফিভার ছাড়া আর সব কটির প্রাদুর্ভাবই বাংলাদেশে আছে। অসংক্রামক রোগের পাল্লা সবচেয়ে বেশি ভারি। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অসংক্রামক রোগগুলোর ১০টি বর্গ। এই বর্গগুলোতে যত রোগ আছে, তার ১৩০টিতে বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যু হয়। এসবের মধ্যে আছে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অস্থিসংক্রান্ত ব্যাধি, সিরোসিস ও অন্যান্য যকৃতের রোগ এবং পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এসবের সঙ্গে আরও আছে মানসিক রোগ।
আঘাত ও দুর্ঘটনাও আছে বহু ধরনের। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত্যু, এমনকি মৃত্যুদÐ পর্যন্ত। এসব ধরন আছে মোট ৩৪টি। এই ৩৪ ধরনকে ৪টি বর্গে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে সড়ক দুর্ঘটনা; অনিচ্ছাকৃত আঘাত; নিজেকে নিজে আঘাত ও আন্তর্ব্যক্তিক সহিংসতা এবং বলপ্রয়োগ; দ্ব›দ্ব ও সন্ত্রাসী কর্মকাÐ; মৃত্যুদÐ ও পুলিশি সংঘাত। মৃত্যুর কারণ হিসেবে নানা ধারা-উপধারার মধ্য থেকে ক্যান্সারের ওপর চোখ বোলানো যাক। বাংলাদেশে প্রতি বছর কত মানুষ কত ধরনের ক্যান্সারে মারা যান, তার পরিসংখ্যান সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারে মানুষ মারা যান।
মৃত্যুর শীর্ষ ১০ কারণ: বাংলাদেশে এক সময় কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু হতো বেশি। বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও রোগ ব্যবস্থাপনার বিকাশের কারণে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। বিপরীতে গড় আয়ু বৃদ্ধি, জীবনযাপনে পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কারণে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এসব রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। ২০০৯ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান ১০টি কারণের তালিকা দিয়েছে দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের। ২০০৯ সালে মৃত্যুর শীর্ষ ১০ কারণ ছিল স্ট্রোক, স্কেমিক হার্ট ডিজিজ, নি¤œ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যক্ষা, ডায়রিয়াজনিত রোগ, সিরোসিস, ডায়াবেটিস, নবজাতকের অসুখ এবং পানিতে ডোবা। ২০১৯ সালে মৃত্যুর প্রধান ১০ কারণ ছিল স্ট্রোক, স্কেমিক হার্ট ডিজিজ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়াজনিত রোগ, য²া, সিরোসিস, ক্যান্সার ও নবজাতকের অসুখ।
সেবা ও চিকিৎসা পরিস্থিতি: দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা নিয়মিত নতুন নতুন বিষয় সামনে আনছেন। কোন দেশ কতটা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ) অর্জন করেছে, ২০২০ সালের অক্টোবরে তারা তা প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও টিকাদানসহ ২০টি রোগের চিকিৎসা-পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ৫৪ শতাংশ।
এই গবেষণার গুরুত্ব কোথায়: ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের এই উদ্যোগের মাধ্যমে বৈশ্বিক রোগ-পরিস্থিতির একটি সার্বিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। তারা প্রায় সাড়ে ৪০০ রোগ ও আঘাতের কারণ এবং প্রায় ১০০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। রোগ ও আঘাতের কারণে বিশ্বের কোন দেশে মোট কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কোন রোগে কত প্রাণক্ষয় ঘটছে, কত মানুষকে প্রতিবন্ধিতার দুঃসহ জীবন বরণ করে নিতে হচ্ছে, রোগের কারণে মানুষের আয়ু কতটা কমে আসছে, এসবের একটি অনুমিত হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। এই অনুমিত হিসাব পদ্ধতিগত ও বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকর বলে বিশ্বস্বীকৃতিও পাচ্ছে।
প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় সবাই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে: দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় সবাই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। মাত্র এক ভাগের নেই কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি। বলা চলে, এরা রোগমুক্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় দেশব্যাপী স্বাস্থ্যঝুঁকির এই বিষয়টি জানা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচটি বিষয়কে স্বাস্থ্যঝুঁকির তালিকায় রেখেছে- উচ্চ রক্তচাপ, স্থ‚লতা, ধূমপান, পর্যাপ্ত ফল না খাওয়া এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকা। কেউ একটি ঝুঁকির মধ্যে আছেন, কেউ একাধিক ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বয়স যাদের বেশি, তাদের ঝুঁকিও বেশি।
অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রেদুয়ানুর রহমান। তিনি বলেন, ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সী মানুষের ৯৬ শতাংশ প্রয়োজনমতো ফলমূল বা শাক-সবজি খান না। একই বয়সী ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম করেন না বা তারা শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় নন। এই বয়সী মানুষের ২০ শতাংশ ধূমপান করেন। ২৫ শতাংশ পান-জর্দা ব্যবহার করেন। এই বয়সী শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মদ্যপান করেন। পাশাপাশি ২৪ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। অন্যদিকে দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পদ্ধতিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। দেশের আটটি বিভাগের শহর ও গ্রামে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় মোট ৭ হাজার ৬৮০ জনের তথ্য নেয়া হয়েছে। এদের বয়স ১৮ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। অনুষ্ঠানে বলা হয়, দিনে মোট পাঁচবার ফলমূল বা শাক-সবজি খাওয়া দরকার।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা দিনে শূন্য দশমিক ৪ বার এবং ১ দশমিক ৯ বার শাক-সবজি খান। ৩৭ শতাংশ মানুষ খাওয়ার সময় খাবারে কাঁচা লবণ নেন এবং ১৩ শতাংশ মানুষ প্রচুর লবণযুক্ত ফাস্ট ফুড খান। অনুষ্ঠানে মোট ১৭টি গবেষণার ফলাফল চারটি পৃথক অধিবেশনে প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ছিল পাঠ্যক্রমে অসংক্রামক রোগ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দান, মহামারীর সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, উপক‚ল এলাকার মানুষের অসংক্রামক রোগ পরিস্থিতি ইত্যাদি। অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচক বলেন, দেশে ৭০ শতাংশ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক রোগ।