মৌলভীবাজার মাছের মেলায় ৫ কোটি টাকার কেনাবেচা

29

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার শেরপুরে ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় প্রায় ৫ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছে। গত দু’বছর করোনার কারণে না হলেও এবার উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হচ্ছে মাছের মেলা।
মেলাকে নিয়ে এ অঞ্চলের মানুুষ অধীর আগ্রহে থাকেন কখন বছর ঘুরে শুরু হবে মাছের মেলা।
মাছে মেলাটি শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) শুরু হয়েছে, শেষ হয় গতকাল রবিবার সকালে।
মাছে মেলায় ২ মণ ওজনের বাগাই মাছ নিয়ে এসেছেন সুনামগঞ্জের এক বিক্রেতা। তিনি মাছটি সুরমা নদী থেকে ধরেছেন। মেলায় মাছটির দাম হাঁকাছেন ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত তিনি ২ লক্ষ টাকা হলে মাছটি বিক্রি করবেন বলে জানিয়েছেন।
মেলায় ৩০টি মৎস্য আড়ত এ হাক-ডাকের মধ্যে পাইকারি মাছ বিক্রি চলছে এবং খুচরা সহ¯্রাধিক দোকানে মাছ বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবারের মেলায় ২০ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মেলা আয়োজকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুইশ’ বছর আগে সদর উপজেলার মনোমুখ এলাকার মথুরা বাবু নামক জমিদার এ মাছের মেলা মনু ও কুশিয়ারা নদীর মিলন স্থলে শুরু করলে তার ওই ধারাবাহিকতায় ১৫০ বছর চলে।
১৯৭২ সালে উপজেলার মনোমুখে এ মেলা নিয়ে সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই জেলা সদরের ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুরের অদূরে ব্রাহ্মণ গ্রামের কুশিয়ারা নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মেলা। তখন মেলাটি ছোট ছিল কিন্তু তা দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে বিশাল আকার ধারণ করেছে। যা দেশের সর্ববৃহৎ মাছের মেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মেলাটি সনাতন ধর্মাবলম্বীর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে শুরু হলেও বর্তমানে তা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হচ্ছে।
মেলায় মৎস্য ব্যবসায়ীরা বাঁশ দিয়ে মাচান তৈরি করে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সৌখিন ও ভোজন বিলাসীদের দৃষ্টি কাড়তে বিশাল আকারের পাকারুই, কাতলা, বাগাই, কালবাউস, মৃগেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। এতে অনেক ভোজন বিলাসী তরতাজা মাছ আনন্দের সাথে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই আবার স্মৃতি ধরে রাখতে মোবাইল দিয়ে বড় বড় মাছের সেলফি তুলছেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় মাছ বিক্রি শুরুর পর থেকেই সময়ে সময়ে বেচাকেনা বাড়তে থাকে। ক্রেতা বিক্রেতার পদচারণে মুখরিত হয় মাছের মেলা। মাছগুলো সাধারণত পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা নদীসহ মৌলভীবাজারের হাকালুকি, হাইল হাওর, কওয়াদিঘী হাওর, সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওর এবং দেশের ছোট বড় হাওরের মাছ। এর মধ্যে টাংগুয়ার হাওর, হাকালুকির হাওরের মাছ মেলায় বেশী প্রধান্য পেয়েছে। হাওরে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় তরতাজা মাছ নিয়ে আসেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
মেলায় এক কেজি মাছ থেকে শুরু করে ২০০ কেজি ওজনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। যার বাজার মূল্য লক্ষাধিক টাকা।
এছাড়া, বর্তমানে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছের দেখা মিলছে এ মেলায়।
এদিকে, মেলাকে কেন্দ্র করে মৎস্য ব্যবসায়ীরা প্রস্তুত করছেন বড় বড় দোকান। নানা ধরনের গৃহস্থালি ও বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, সৌখিন জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা পুতুল, টাট্রু ঘোড়া নিয়েও বসেছেন অসংখ্য দোকানি।
মেলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আড়তদাররা মাছ নিয়ে এসেছেন। মজুত করে রাখা হয়েছে ছোট-বড় নানা জাতের মাছ। আছে বাগাড়, বোয়াল, আইড়, চিতল, কাতলা, রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এছাড়া নানা ধরনের গৃহস্থালি ও বিভিন্ন ধরনের আসবাব, সৌখিন জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা নিয়ে বসেছে অসংখ্য দোকান। অন্যদিকে কাঠের তৈরি খাট, আলমারি, আলনাসহ নানা আসবাবপত্র নিয়েও বসেছেন কয়েকজন দোকানি।
মাছ ব্যবসায়ী শামীম মিয়া বলেন, বাজার জমেছে। আশা রাখি ভালো বেচাকেনা হয়েছে। ১০ লাখ টাকার মাছ মজুত করেছি। আট লাখ টাকার বিক্রি করেছি।
আরেক মাছ ব্যবসায়ী নাজমুল মিয়া বলেন, গত দুই বছর মাছের মেলা বন্ধ ছিল। এবার জমে উঠেছে। নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ এসেছে।
শেরপুর আড়তের ঠিকাদার তপু ভৌমিক বলেন, প্রতি বছর এখানে নিলামের মাধ্যমে মাছের আড়ত পরিচালনা করা হয়। এ বছর মাছের সংখ্যা বেশি। এবার কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। মাছের মেলা ছাড়াও শেরপুরে বড় ২০টি আড়ত রয়েছে। মূলত স্থানীয় কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওর, কাউয়া দিঘি হাওরের মাছ এ মেলায় বেশি দেখা যায়।
মাছের মেলা কমিটির সাবেক সভাপতি অলিউর রহমান বলেন, ১৩ জানুয়ারি রাত থেকে ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলার জন্য কম করে হলেও ৩-৪ লাখ টাকা ইজারা মূল্য দিতে হয়েছে। করোনার কারণে গত বছর মাছের মেলা হয়নি। হাওর-বাঁওড়, নদী, বিল ভরাট হওয়ার কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গত বর্ষায় সিলেট বিভাগে বন্যা হওয়ায় সবকটি হাওর-জলাশয়ে মাছের বিচরণ বৃদ্ধির কারণে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন হয়েছে। গত অর্থ বছরে মৌলভীবাজারে মাছের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৫৫২ টন। এবার এর উৎপাদন আরও বেড়েছে। আগামী জুনে এর হিসাব আসবে।