সময়ের প্রতি যথোচিত গুরুত্ব প্রদান করতে হবে

14

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও মূলবান একটি হলো সময়। মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে নিয়ামতটির যথার্থ মূল্যায়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা, সময়ের যথাযথ মূল্যায়নও ব্যবস্থাপনা ছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্ভব নয়। ইসলামী শরীআত এ কারণে সময় ব্যবস্থাপনাকে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সময়, সময়ের গুরুত্ব।
মহান আল্লাহ অফুরন্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে সময় হচ্ছে অন্যতম। নিশ্চয়ই সময় দিন রাত্রির সমন্বিত রূপ। সময় শব্দটি তিন অক্ষরের ছোট শব্দ হলেও এর ব্যাপ্তিকাল অনেক বড়। সৌর বছরে ৩৬৫ দিন আর চন্দ্র বছরে ৩৫৪ দিন। ঘন্টার হিসেবে ২৪ ঘন্টা এবং মিনিটের হিসাবের দিক দিয়ে ১৪৪০ মিনিট। এ সময় হতে এক ঘন্টা বা এক মিনিট চলে যাওয়া মানে প্রকৃত পক্ষে জীবনের একটা মূল্যবান অংশ কমে যাওয়া। এ কারণে সময়ের যথাযথ ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য। সময়ের সমষ্টিই জীবন। মানুষ তার দুনিয়ার জীবন কীভাবে অতিবাহিত করেছে আখিরাতে সে হিসাব প্রদান করতে হবে। এ কারণে সময়ের সদ্ব্যব্যবহারের জন্য এর যথার্থ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এ প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই জন্ম হয়েছে সময় ব্যবস্থাপনা পরিভাষার।
বর্তমানে উন্নয়ন চিন্তার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত। কেননা, সব ধরণের চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবসম্পদ। তাকে কেন্দ্র করেই সব ধরণের উন্নয়ন চিন্তা পরিচালিত হয়। এ উন্নয়ন চিন্তার স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতার জন্য সময় ব্যবস্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। ইসলাম মানুষের সার্বিক কল্যাণ, চিন্তা ও পরকালীন সুখ সমৃদ্ধির বিষয় সামনে রেখে মানুষকে সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন, এর সদ্ব্যবহার ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থাপনার নির্দেশ প্রদান করে। আরবীতে সময়ের প্রতিশব্দ ওয়াক্তুন। এর বহুবচন আওক্বাতুন। ইংরেজীতে সময়ের প্রতিশব্দ ঞরসব, ঢ়বৎরড়ফ, যড়ঁৎ। সময় বা কাল একটি পুরাতন পরিভাষা। তা দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট মেয়াদে নানা ঘটনার অতিক্রমকে বোঝানো হয়। এ কারণে এ সময় থেকে যা অতিক্রান্ত হয় তা আর কখনো ফিরে আসে না। সময় হচ্ছে এই সংক্ষিপ্ত দুনিয়াতে মানুষের প্রধান সম্পদ। এটা তার আয়ূষ্কালের সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তার কাঁেধ একটা বড় দায়িত্ব। যদি সে সময়ের দ্বারা উপকৃত হয়, তাহলে সে তার উত্তম প্রতিফল পেল। আর যদি সে তার কাঁধে সময় নামক অর্পিত বস্তুর আমানত ও দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করে, তাহলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঞরসব রং ধ সবধংঁৎব রহ যিরপয বাবহঃং পধহ নব ড়ৎফবৎবফ ভৎড়স ঃযব ঢ়ধংঃ ঃযৎড়ঁময ঃযব ঢ়ৎবংবহঃ রহঃড় ঃযব ভঁঃঁৎব, ধহফ ধষংড় ঃযব সবধংঁৎব ড়ভ ফঁৎধঃরড়হং ড়ভ বাবহঃং ধহফ ঃযব রহঃবৎাধষং নবঃবিবহ ঃযবস.
সময় হলো একট মানদন্ড, যেখানে ঘটনাসমূহ অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের পানে বা অতীত বর্তমান ভষ্যিতে সন্নিবেশ করা যায় এবং ঘটনাসমূহের ব্যাপ্তিকাল ও তাদের মধ্যকার বিরামকালের ও পরিমাপক। মানব জাতির জীবন পরিচালনার আদর্শ গাইডলাইন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে সময় অপচয় ও অনর্থক কাজে ব্যয় করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা সময় বোঝানোর জন্য কুরআনে অনেক প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এর প্রতি গুরুতারোপ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি সূর্যকে করেছেন তেজোদ্দীপ্ত, আর চন্দকে করেছেন আলোকময়। আর তার (হ্রাস-বৃদ্ধির) মানযিলসমূহ সঠিকভাবে নির্ধারণ করেছেন, যাতে তোমরা (এনিয়ম দ্বারা) বছরের গণনা এবং দিন তারিখের হিসাবটা জানতে পার; (আসলে) আল্লাহ তা‘আলা যে এসব কিছু সৃষ্টি করে রেখেছেন (তার) কোনটাই তিনি অনর্থক সৃষ্টি করেনটি; যারা (সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে) জানতে চায় তাদের জন্যে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্দেশ গুলোকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : কালের শপথ। মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে তা বুহ সৃষ্টিকে নিয়ে কসম করেছেন, এতে এগুলোর মর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। তেমনি সময় নিয়ে কসম করায় এটি প্রত্যেক মানুষের জন্য কত গুন গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: আমি রাত আর দিনকে দুটো নিদর্শন বানিয়েছি। আমি রাতের নিদর্শনকে জ্যোতিহীন করেছি, আর দিনের নিদর্শনটিকে করেছি আলোয় উজ্জ্বল, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার। আর যাতে বছরের সংখ্যা ও হিসাব জানতে পার; আমি সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছি। সময়ের সাথে রয়েছে হিসাববিজ্ঞান (অপপড়ঁহঃরহম) ও জ্যোতিবিদ্যার (অংঃৎড়হড়সু) অনন্য সম্পর্ক। কুরআনে সময়ের কথা উল্লেখ করতে যেয়ে আল্লাহ তা‘আলা একাধিক স্থানে এই দুই জ্ঞানের কথা উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আর তিনি দিবা রাত্রিকে পরস্পরে অনুগামী করেছেন। যে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায় তার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের কাজে লাগিয়ে রেখেছেন, তারা অনুগত হয়ে নিজ নিজ পথে চলছে। আর তিনি রাত ও দিনকে তোমাদের কাজে লাগিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ আরো বলেন: সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রজনীর পক্ষে সম্ভব নয় দিবসকে অতিক্রম করা এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে। আল্লাহ আরো বলেন: নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃজনে এবং দিবস রাত্রির পরিবর্তনের জ্ঞানবানদের জন্যে ষ্পষ্ট নির্দেশাবলি রয়েছে। আল্লাহ আরো বলেন: আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি। আল্লাহ আরো বলেন: আল্লাহ দিবস ও রাত্রির পরিবর্তন ঘটান, এতে শিক্ষা রয়েছে অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্নদের জন্যে।
আল্লাহ আরো বলেন: সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাবের অধীনে। আল্লাহ আরো বলেন: তারা তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বল, এগুলো হচ্ছে জনসমাজের ও হজ্জের সময় নিরূপক…..। আল্লাহ আরো বলেন: মানুষের উপর অন্তহীন মহাকালের এমন এক সময় কি এসেছিল, যখনসে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। আল্লাহ আরো বলেন: তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রজনী, দিবস, সূর্য এবং চন্দকে; আর নক্ষত্ররাজিও অধীন হয়েছে তাঁরই হুকুমে; অবশ্যই এতে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে রয়েছে নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝানোর জন্য আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সময়ের কসম করেছেন। যেমন: শপথ রজনী, যখন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়, শপথ দিনের, যখন তার আলোকিত হয়। আল্লাহ আরো বলেন: শপথ ফজরের, শপথ দশটি রাতের।
আল্লাহ আরো বলেন: সকালের উজ্জ্বল আলোর শপথ, রাতের শপথ যখন তা হয় শান্ত নিঝুম। মহান আল্লাহ কোন তুচ্ছ বিষয়কে নিয়ে শপথ করেন না। আর তার সময়কে নিয়ে কসম করাতে সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মহানবী স. সময়কে গুরুত্ব দিতে এবং একে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে অনেক তাকিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি সর্তক করে দিয়েছেন, প্রতিটি মানুষকে সময়ের হিসাব কিয়ামতের দিন দিতে হবে। তিনি আরো বলেন: কিয়ামতের দিন কোন বান্দা চারটি প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত সামনে যেতে পারবে না- সে তার জীবনকালে কোন কাজে ব্যয় করেছে, তার যৌবনকাল কোথায় ক্ষয় করেছে, তার সম্পদ কোথা থেকে আয় করে কোথায় ব্যয় করেছে এবং তার অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি না। উল্লিখিত হাদীসের চার বিষয়ই সময়ের সাথে সম্পর্কিত।
রাসূল স. আরো বলেন; পাঁচটি বস্তু আসার পূর্বে পাঁচটি বস্তকে সুযোগ মনে করো। বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে, দারিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে। রাসূল স. আরো বলেন: দুটি নিয়ামতের (ব্যবহারের) অধিকাংশ মানুষই ধোকার, রোযা ও হজ্জ সময়ের সাথে সম্পর্কিত। এছাড়া আরো বিভিন্ন ইবাদত নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সীমাবদ্ধ। এগুলো বেশির ভাগ নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা ওযর ছাড়া দেরিতে আদায় করার কোন নিয়ম ইসলামে নেই। সুতরাং এগুলো বিশেষভাবে সময়ের সাথে জড়িত। যেমন, রাসূল স. ইবাদতগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আল্লাহর নিকট কোন আমল অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথাসমায়ে সালাত আদায়। একইভাবে রোজা শুরুর ব্যাপারে রাসূল (স.) বলেছেন। তোমরা চাঁদ দেদেখ রোযা করো এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো। যদি মেঘের কারণে তা দেখা না যায়, তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে। আবূ বাকরাহ তারঁ পিতা হতে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোন মানুষ উত্তম? জবাবে তিনি বললেন: যার বয়স বৃদ্ধির সাথে তার আমলও উত্তম হলো। আবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো যে, কোন মানুষ নিকৃষ্ট? তিনি বললেন: যার বয়স বেশি হলো: কিন্তু আমল খারাপ হলো। সুতরাং হাদীসে ও সময়ের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আর তারা তোমাকে আযাব ত্বরান্বিত করতে বলে। অথচ আল্লাহ কখনো তাঁর ওয়াদা খেলাফ করেন না। আর তোমার রবের নিকট নিশ্চয়ই একদিন তোমার গণনায় হাজার বছরের সমান। আল্লাহ আরো বলেন: ফেরেশতাগণ ও রূহ এমন একদিনে আল্লাহর পানে উর্ধ্বগামী হবে, যার পরিমান পঞ্চাশ হাজার বছর।
বর্তমানে আপেক্ষিক তত্ত্ব (ঞযব ঃযবড়ৎু ড়ভ ৎবষধঃরাব) প্রমাণ করেছে যে, সময় হল একটি আপেক্ষিক ধারণা। এ কারণে তা পরিবেশ ও অবস্থা অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দেখিয়েছেন, সময় ভর ও গতিবেগের উপর নির্ভরশীল এবং তা অভিকর্ষশক্তির ওপরও নির্ভর করে। এখন এটা প্রমাণিত যে, পৃথিবীতে ও মহাশূন্যে সময়ের ব্যাপারটি একই রকম হয়। কুরআন মাজীদ সময়ের এই আপেক্ষিকতার কথা বলেছে আইনস্টানি তা আবিষ্কার করার ও শত শত বছর আগে। পূর্ববর্তী যুগের মুসলমানরা এসব আয়াতকে কুরআনের রহস্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যতদিন তারা এসব রহস্যের পাঠোদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেনি, তারা সেগুলোকে আল্লাহ তা‘আলার কালাম বলে গ্রহণ করে নিয়েছিল। মানুষের জ্ঞানের পরিধি (ঈরৎপষব) বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী যুগের মুসলমানরা তাদের জ্ঞানের পরিসীমা অনুসারে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা দেন। এভাবে প্রত্যেক যুগের মুসলমানরাই কুরআন মাজীদের কিছু কিছু রহস্যকে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বাস্তবতায় রূপায়িত করেন। এভাবেই কুরআন মাজীদ সকল প্রজন্মের মানুষের জন্যে একটি জীবন্ত মুজিয়া হিসেবে চলমান থেকেছে। কুরআন মাজীদ সর্বদাই তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে এবং তা ভবিষ্যতে সর্বদা মানব জ্ঞানের পরিধিকে ছাপিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখবে। এটি মানুষের জন্যে সর্বদা একটি শাশ্বত চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজমান থাকবে। সব যুগের মানুষই কুরআন মাজীদের মুজিয়া উদঘাটন ও পর্যবেক্ষনের চেষ্টা করেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
প্রচলিত সময় ব্যবস্থাপনা পরিভাষাটি একটি সমসাময়িক পরিভাষা, যা বিংশ শতাব্দির পঞ্চাশের দশকের শেষভাবে ও ষাটের দশকের প্রথম দিকে উদ্ভাবিত হয়। সম্ভবত জেমস ম্যাকি (ঔধসবং ঞ. গপঈধু) প্রথম ব্যক্তি যিনি এ বিষয়ে কলম ধরেন। তিনি ১৯৫৯ সালে তার বিখ্যাত ঞযব গধহধমবসবহঃ ড়ভ ঃরসব” গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়কে বিভিন্ন বই পুস্তক প্রণয়ন ও গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়। গবেষকগণ সময় ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন গ্রন্থাবদ্ধ সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো: জধু এ. ঐবষসবৎ বলেন. ঞরসব সধহধমবসবহঃ ঃযধঃ রহপষঁফবং ফবঃবৎসরহরহম ধহফ ঢ়ৎরড়ৎরঃরুরহম ড়ঁৎ ড়নলবপঃরাবং বহধনষবং ঃড় ফবাড়ঃব সড়ৎব ঃরসব ঃড় রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঃধংশং ধহফষবংং ঃড় ঁৎমবহঃ ড়ৎ ঃৎরারধষ ঃধংশং.
সময় ব্যবস্থাপনা মূলত আমাদের উদ্দেশ্যসমূহকে এমনভাবে নির্দিষ্ট করা ও অগ্রাধিকার প্রদান করা, যাতে অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আরও বেশি এবং জরুরী কাজের জন্য কম সময় ব্যয় করা লাগে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালাঈকাহ সময় ব্যবস্থাপনার প্রচরিত ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় পূর্বক এর সংজ্ঞা দেয়ার প্রয়াস নিয়েছেন। তিনি বলেন. সময় ব্যবস্থাপনা হলো. সময় ব্যয়ের পরিকল্পনা ৃও তা ব্যবহারের এমন পন্থা, যাতে আমাদের জীবন উৎপাদনশীলন হয় এবং আমদের নিজেদের ও আমাদের চারিপাশের সম্ভাব্য সকলের, অনন্তর আমাদের অধীন ব্যক্তিদের ও দুনিয়া ও আখিরাত কল্যাণময় হয়। অতএব সময় ব্যবস্থাপনা হলো অভীষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সময়ের যথাযথ ব্যবহার। সময় ব্যবস্থাপনার মৌলিক উপাদান ঃ সময় ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য সময়ের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা। মনীষীগণ সময় ব্যবস্থাপনার পাঁচটি মৌলিক উপাদান বর্ণনা করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
পরিকল্পনা : সময় ব্যবস্থাপনার প্রথম ও প্রধান উপাদান সুষ্ঠু পরিকল্পনা। মানুষের ব্যাক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি কাজ সময়মাফিক ও যথাসময়ে পরিকল্পনামাফিক করলেই কেবল অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়। অন্যদিকে স্বল্প বা মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদী একটি সফল পরিকল্পনার জন্য উপযুক্ত সময ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা আবশ্যক। এ কারণে নির্ধারিত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পরিকল্পনা ও সময়ের যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন।
শৃঙ্খলা : সময় ব্যবস্থাপনার জন্য শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিক গুরুত্বপূণ। গবেষণায় দেখা গেছে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতার অনুসরণ সময় হ্রাস করে। নিয়মানুবর্তিতার অপর নাম সময়ানুবর্তিতা, যা ব্যাক্তি ও সমষ্টিকে সচেতন করে। এর কারণে পরস্পরের সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয় এবং ব্যক্তি তার নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়।
নির্দেশনা : সময় ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথ নির্দেশনা ও সময় মতো নির্দেশনা উভয়টিই অত্যন্ত গুরুত্বসহ। বিশেষত প্রশাসনিক ও সামষ্টিক উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে। কেননা সঠিক পরিস্থিতিতে সঠিক নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমেই উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মানসিকতা অনুযায়ী নির্দেশনা প্রদান জরুরী। সঠিক নির্দেশনা প্রদানে বিলম্বিত হলে সময় ব্যবস্থাপনার বিঘœ ঘটে। এ কারণে যথা সময়ে অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে যথাযথ নির্দেশনা অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য।
পর্যবেক্ষণ : সফলভাবে সময় ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মাতান্ত্রিকতার সাথে সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে কি তা পর্যবেক্ষন জরুরী। পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যথ সময়ে কাঙ্কিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পতে কোন ভুল ভ্রান্তি বা এ বিষয় কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে কিনা তা যাচাই বাছাই করতে হবে। কার্যক্রম সঠিক হলে সাধারণত পর্যবেক্ষণের সময় দীর্ঘ হয়। পক্ষান্তরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আন্তরিক ও দৃঢ়সংকল্প হলে এবং পরিপূর্ণ আস্থা থাকলে পর্যবেক্ষণের সময় হ্রাস করা সম্ভব।
যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ : সময় মত যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহন সময় ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কোন বিষয়ে দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সময় অপচয় রোধ হয়। পক্ষান্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময় অপচয় হয়। আবার যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রঞন না করলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছা যায় না। ফলে সম্পূর্ণ কার্যক্রম ব্যর্থ হয়।
সময় নষ্ট করার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অলসতা। অবসর সময় আমরা লম্বা ঘুম দিয়ে, পরিবারের সদস্যদের সাথে অযথা গল্প করে, টিভিতে শিক্ষামূলক নয় এমন প্রোগ্রাম দেখে, বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করে থাকি। সিরিয়ার একজন বিজ্ঞ ইসলামিক স্কলার বলেছেন যে, সুবহাাল্লাহ! যদি এদের কাছ থেকে সময় কিনে নেয়া যেত, তাহলে অবশ্যই তা আমরা ক্রয় করে নিতাম। ইসলাম পরিশ্রম, উপার্জন করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে; অলসতা, ভিক্ষাবৃত্তি ও নিজকে দূর্বল মনে করাকে তিরস্কার করেছে। আল্লাহ বলেন: নামায সমাপ্ত হলে তোমার পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (অর্থ্যাৎ জীবননোপকরণ) সন্ধান করবেও আল্লাহে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও। সময় নষ্ট করার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে জীবনে লক্ষ্য না থাকা। জীবনে টার্গেট না থাকার কারণে আমাদের সময় নষ্ট হয়। এমনকি আমরা অনেকেই জানি না, দুনিয়াতে আমাদের কেন আগমন। সময় অপচয়ের জন্য দায়ী আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ভুল পরিকল্পনা। অনেক লোক আছে যারা নিজেই সব কাজ করে, অন্যের উপর ভরসা করতে পারে না। তাই সে ছোট কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে থাকে। অথচ সে পরিবারের অন্য সদস্য- ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রীর দ্বারা সে কাজ করাতে পারত। সে এমন কাজ করবে, যে কাজটা পরিবারের অন্য সদস্যের দ্বারা সম্ভব নয়। সুতরাং যে কাজটা অন্যের দ্বারা করানো যায় সে কাজটা আপনি করলে তা হবে ভুল পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। ঈমানের দূর্বলতার কারণে সময় অপচয় হয়। আর এই দূর্বলতার কারণে যা হতে পারে: ঈমানের দূর্বলতার কারণে প্রবৃত্তির অনুসরণের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ কারণে আপনার মন যা খুশি তা-ই করতে চাইবে। ফলে আপনার সময় অপচয় হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। দুর্বল ঈমানের কারণে প্রত্যাশা বেড়ে যায়। এতে ভাল আমল করার ইচ্ছা কমে যায়। হাসান বসরী রহ. বলেন; বান্দার আশা বেড়ে যাওয়ার কারণে আমল নষ্ট হয়ে যায়। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন: আখিরাতের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে অন্তর নষ্ট হয়ে যায় আর দীর্ঘ প্রত্যাশার কারণে সময় নষ্ট হয়। যে ব্যক্তি দৃঢ় ইচ্ছার অধিকারী সে বৃথা সময় চলে যাওয়াতে খুশি হয় না। আর দূর্বল ইচ্ছা পোষণকারী সময় চলে যাওয়াকে গুরুত্ব দেয় না। জীবনে খারাপ বন্ধুর সাথে চলাফেরা করা যাবে না। কেননা, তারা সময়কে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে নষ্ট করে। আমরা একে অপরের অনেক কথা বলে থাকি। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে এর অধিকাংশ অনর্থক হয়ে থাকে বা প্রয়োজনীয় হতে পারে; কিন্তু সে সময়ের জন্য প্রয়োজ্য নাও হতে পারে। রাসূল স. বলেছেন: যে ব্যক্তি আমাকে তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের সঠিক ব্যবহারের নিশ্চয়তা দিবে, আমি তার জান্নাতের গ্যারান্টি দিচ্ছি।
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দিন রাত দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তাঁর কিতাব আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সময়কে নিয়ে শপথ করেছেন, আর নবী মুহাম্মদ স. জানিয়েছেন যে, অচিরেইে মানুষের সময় ও বয়সের হিসাব নেয়া হবে। আর আল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে, মানুষ কিয়ামতের দিন তার আমলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে দুনিয়াতে আবার ফিরে এস ভাল আমল করার ইচ্ছা পোষণ করবে। সুতরাং সময়কে এমন কাজে ব্যয় করা উচিত, যা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণক হয়। এজন্য প্রত্যেক ব্যক্তিরই গ্রহণ করা উচিত সুনির্দিষ্ট সময় পরিকল্পনা। (অসমাপ্ত)